দলের ভেতরে জঞ্জাল

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড, কাউয়া, বসেন্তের কোকিল, বিতর্কিত, অপকর্মকারীদের বাদ দেয়ার শুদ্ধি অভিযানে ভাটা পড়েছে। শত চেষ্টার পরও জঞ্জালমুক্ত হতে পারছেন  ক্ষমতাসীনরা। গত বছর ক্যাসিনোতে অভিযানের মধ্য দিয়ে শুদ্ধি অভিযানের শুরু হলেও তা গতি হারিয়েছে। গত বছর থেকে অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে বাদ দেয়া হবে বলে নেতারা ঘোষণা দিলেও কার্যত কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাই অপকর্মকারীরা আবারও সর্বত্র সক্রিয় হয়েছে। এ বছরের মাধ্যে পাপিয়া, সাহেদ ও ফরিদপুর জেলায় অপকর্মকারীদের গ্রেফতার করা হলেও বেশিরভাগ রাজনৈতিক অপরাধীরা ধোরা ছোয়ার বাইরে। আর প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান না হওয়াতে রাজনৈতিক মহলে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ নেতাদের মন্ত্রী, এমপি করা নিয়েও বেশ সমালোচনা রয়েছে দলের ভেতর। এমতাবস্তায় দলের কমিটিতে ত্যাগী ও যোগ্যদের নিয়ে নিয়ে আসা এবং তৃণমূলের সমস্যা সমাধানের জন্য এ মাসের শুরুতে আটটি সাংগঠনিক টিম গঠন কেেরছ আওয়ামী লীগ। কিন্তু সম্প্রতি ঘোষিত সহযোগী সংগঠনের কমিটিতে বিতর্কিতরা স্থান পেয়েছে।

এদিকে ত্যাগীদের সামনের কাতারে আনার জোর প্রচেষ্টা করা হলেও অপকর্মে পিছিয়ে নেই তারাও। যাদেরকেই দলের পদের দায়িত্ব বা চেয়ারম্যান, মেয়র, এমপি পদে মনোনয়ন দেয়া হয় তারাই অপকর্ম শুরু করে, এ নিয়ে বেশ চিন্তিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এছাড়া দলের ভেতরের অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিডদের বাদ দেয়া নিয়ে নেতারা বেশ গরম বক্তব্য দিলেও এ নিয়ে কার্যত কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি কখনো। এ বিষয়ে দলের গঠনতন্ত্রেই ফাঁকফোকড় থাকায় তা নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। কোন কোন প্রক্রিয়া না মানলে দলের কোন নেতাকে অনুপ্রবেশকারী বা হাইব্রিড বলা হবে এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা বা ব্যাখা নেই আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে। আর কোন প্রক্রিয়া মানলে তা অনুপ্রবেশ নয়, দলে যোগদান হবে সেই ব্যাখ্যাও নেই। সেজন্য একে ওপরকে যখন তখন অনুপ্রবেশকারী, বিএনপি-জামায়াত, হাইব্রিড আখ্যা দিয়ে প্রচারণা চালায়। সঠিক নির্দেশনা না থাকায় তৃণমূল সংগঠনের নেতারাও এ নিয়ে নানান অপকর্ম করেন, টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি করেন। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আওয়ামী লীগের মত বড় দলে কে কখন প্রবেশ করে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তবে দলে যোগ দিয়েই যেন কেউ পদ বা নির্বাচনের মনোনয়ন না পায় সেদিকে কড়া নজর রাখা দরকার। এজন্য একটি নীতিমালা করা প্রয়োজন।

তিনি আরো বলেন, দলীয় পরিচয়ে অপকর্ম বা অপরাধ রোধে আইনের শাসন জরুরী। কারণ হাইব্রিডদের থেকে ত্যাগীরাও অপরাধ-অপকর্মে পিছিয়ে নেই। চেন্ডারবাজি, চাকরী বাণিজ্য, ভূমিদখলসহ সকল অপরাধের সঙ্গে ত্যাগী নেতারা জড়িত। অনুপ্রবেশকারী বা হাইব্রিডদের দিয়ে অপরাধমূলক কাজ করায় ত্যাগী নেতারাই। তাই দলের ভেতর অপরাধীদের বাদ দিতে শুদ্ধি অভিযান এবং দলের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে কঠোর বার্তা দেয়া প্রয়োজন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ইনকিলাবকে বলেন, শুধু অনুপ্রবেশকারীরা যে দলের পরিচয়ে অপরাধ করছে তা নয়, অনেক ত্যাগী নেতারা রয়েছেন যাদের সৎ হিসেবে দেখে এসেছি, দলের জন্য অবদান অনস্বীকার্য; এমন লোকদের দায়িত্ব দেয়ার পর তারা পরিবর্তন হয়ে যান। নানান অপরাধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে আমরা নিজেরাই বিব্রত হই।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মিজানুর রহমান বলেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে জনবিচ্ছিন্নরা দলের পদ বা নির্বাচনের মনোনয়ন পেলেই বিএনপি জামায়াতের লোকজনকে কাছে টেনে আনে। টাকার বিনিময়ে দলের পদ বিক্রি করে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে। তাই দলের পদ বা মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে ৫ বছর বা ১০ বছর সদস্য থাকতে হবে এমন নীতিমালা করা প্রয়োজন।

এদিকে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিডদের নিয়ে বেশ সোচ্চার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আাব্দুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। এই নেতারা সবেচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে বক্তব্য দেন।

কিন্তু দলের গঠনতন্ত্রে অনুপ্রবেশ বা হাইব্রিডদের নিয়ে কোন ব্যাখ্যা নেই। কোন পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া যাবে এ নিয়েও সঠিক ব্যাখ্যা নেই। ইউনিয়নের অনুপ্রবেশ হাইব্রিডদের নিয়ে উপজেলা নেতারা সমালোচনা করেন, উপজেলার বিষয়ে জেলা নেতারা সমালোচনা করেন, জেলার বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা সমালোচনা করেন। আবার কেন্দ্রীয় সংগঠনেও অনুপ্রবেশ হচ্ছে। তাই পুরো বিষয়টি নিয়ে ধোয়াশা রয়েছে। নিরেট ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের পদ দেয়া হয়েছে। তিনি এর আগে আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের কোন পদে ছিলেন না। এছাড়া গত নির্বাচনের আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে দলে যোগদান করেছেন। কিন্তু ইউনিয়ন, উপজেলা বা জেলা নেতাদের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপি বা অন্য দলের কেউ আওয়ামী লীগে যোগ দিলেই দলের মধ্যে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ছোট পদ থেকে বড় পদে গেলেই হাইব্রিড বলে সমালোচনা হয়। এ নিয়ে নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় তৃণমূলে যে কেউ একজন আরেকজনকে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড বানিয়ে হেয় ও কোনঠাসা করছে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলীর ৫নং ধারার অনুচ্ছেদ (১)-এ আছে- এই গঠনতন্ত্রের ২ ধারায় বর্ণিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’ বিশ্বাস করিয়া নির্ধারিত ফরমে প্রদত্ত ঘোষণাপত্রে দস্তখতপূর্বক ত্রি-বার্ষিক ২০(বিশ) টাকা চাঁদা প্রদান করিয়া ১৮ বৎসর বা তদূর্ধ্ব বয়স্ক বাংলাদেশের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক, যাহারা-

(ক) বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখন্ডত্ব, জাতীয় সংহতি, রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জননিরাপত্তা-বিরোধী এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত রহিয়াছেন বলিয়া প্রতীয়মান নহেন; (খ) বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগকারী বা নাগরিকত্ব বাতিলকৃত ব্যক্তি নহেন; (গ) অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নহেন; (ঘ) ধর্ম, পেশা এবং জন্মগত শ্রেণি ও বর্ণের ভিত্তিতে কোনো প্রকার বৈষম্যে বিশ্বাস করে না; (হ) আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থি কোনো সংগঠনের সদস্য নহেন; (চ) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনিবাহী সংসদ কর্তৃক নির্দেশিত ন্যূনতম প্রশিক্ষণ গ্রহণে ও যে কোনো নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকিবেন। এবং (ছ) ত্রি-বার্ষিক চাঁদা নিয়মিত পরিশোধ করিবেন- তাহারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদস্য হইতে পারিবেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অনুপ্রবেশকারীর বিষয়ে দলে কোন ব্যাখ্যা নেই কিন্তু কারা দল করতে পারবে এ নিয়ে কিছু বক্তব্য রয়েছে। হাইব্রিড এর বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষিবিদ হিসেবে হাইব্রিড সম্পর্কে যা বুঝি তা ভাল জাত বা উন্নত বিষয়।

আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ইনকিলাবকে বলেন, গঠনতন্ত্রে অনুপ্রবেশ বা হাইব্রিড নিয়ে ব্যাখ্যা নেই। তবে আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহি দল, অলিখিতভাবে অনেক রীতিনীতি দলে পালন হয়ে আসছে।

দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, জেলা বা উপজেলা নেতাদের হাত ধরে তাদের কিছু আত্মীয়-স্বজন রাজনীতি না করেও পদ পায়; সঙ্গে বিএনপি জামায়াতের লোকজনও দলের কমিটিতে পদ পায়। এ বিষয়টি এবার কঠোরভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। সভাপতিমন্ডলীর সদস্যদের প্রধান করে আট বিভাগে আটটি টিম ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন।

গত বছর আওয়ামী লীগের নেতারা ঘোষণা করেছিল অনুপ্রবেশকারীদের বাঁছাই করে দল থেকে বাদ দেয়া হবে। এ নিয়ে সে সময় বিভিন্ন জেলার অনুপ্রবেশকারীদের তালিকাও এসেছিল গণমাধ্যমের হাতে। কিন্তু সে তালিকা নিয়েও নানান সমালোচনা হয়। পরে সেই তালিকার কোন অগ্রগতি হয়নি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, ধর্ষক ও নারী নির্যাতনকারীদের জন্য আওয়ামী লীগের দরজা চিরদিনের মতো বন্ধ ঘোষণা করা হল। দলীয় পরিচয়ে কোন অপরাধীর আত্মরক্ষার ঢাল হতে পারে না, অপরাধীর পরিচয় তারা অপরাধীই।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর