করোনার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে কওমি শিক্ষার্থীরা

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গতকাল রবিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি শেষ হওয়ার পর ফের তা বাড়ানো হয়েছে। কওমি মাদরাসা ছাড়া সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে গত ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে খোলার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়ায় শিগগিরই স্কুল-কলেজ খুলবে বলে মনে করেছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু এর পরও দুই দফায় ছুটি বাড়ানো হলো।

জানা যায়, করোনার মধ্যেই গত ১২ জুলাই থেকে কওমি মাদরাসাগুলোর হিফজ বিভাগ খুলে দেওয়ার অনুমতি দেয় সরকার। গত ৮ জুলাই এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরও আগে গত ১ জুন থেকে দেশের কওমি মাদরাসায় ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে অফিস খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

এরপর গত বছরের ২৫ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগ কওমি মাদরাসার কিতাব বিভাগ খোলার অনুমতি দেয়। এ সময় ছয়টি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেগুলো হলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ও মাথায় নিরাপত্তা টুপি পরিধান করা আবশ্যক; মাদরাসায় প্রবেশের আগে প্রবেশদ্বারে স্যানিটাইজ করতে হবে; শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ কক্ষে অবস্থান করবে, বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-সেদিক চলাফেরা করা যাবে না; একজন শিক্ষার্থী থেকে অন্য শিক্ষার্থী কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্বে অবস্থান করবে; কভিড-১৯-এর কারণে কোলাকুলি ও মুসাফাহা করা যাবে না এবং শিক্ষক ও কর্মচারীরাও একইভাবে সরকারি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ক্লাস নেবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হচ্ছে—কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আবাসিক। তারা নিজেরা তাদের সীমানার বাইরে যায় না। এ ছাড়া অনেক মাদরাসায় এতিম ও দুস্থ ছাত্ররা পড়ালেখা করে বলে মাদরাসা বন্ধ থাকলে তাদের থাকা-খাওয়াও কষ্টকর হয়ে পড়বে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার কারণে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর সাত মাস ধরে পুরোপুরিভাবেই চলছে কওমি মাদরাসা। এতে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় এগিয়ে যাচ্ছে। তারা নিয়মিত পরীক্ষা দিতে পারছে। তাদের শিক্ষাবর্ষের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। একই ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই সম্পূর্ণ আবাসিক। অনেক স্কুল-কলেজও আবাসিক। অথচ সেগুলো প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কওমি মাদরাসাগুলো বেশির ভাগই আবাসিক। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবার বেশির ভাগই অনাবাসিক। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার আবাসিক। কিন্তু করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে আবাসিক-অনাবাসিক কোনো বিষয় নয়। এখন কবে দেশ করোনামুক্ত হবে আর তখন স্কুল-কলেজ খুলবে, এটা একটা অনিশ্চিত যাত্রা।’

এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সব কিছু চলছে। সবচেয়ে বেশি ভিড় বাজারে, সেখানে মানুষ ধাক্কাধাক্কি করে যাচ্ছে। এর চেয়ে স্কুল-কলেজে অনেকটাই স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব। শিক্ষার্থীরাও তো ঘরে বসে নেই, তারা নানা জায়গায় যাচ্ছে। তবে এটা ঠিক, সবার আগে আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা। এর পরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিত।’

গতকাল রবিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কভিড-১৯ মহামারির কারণে কওমি মাদরাসা ছাড়া দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতেও সরকারি প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেনের ছুটি আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে জানানো হয়।  জানা যায়, কওমি মাদরাসার শিক্ষকরাও নিয়মিতই মাদরাসার বাইরে যাচ্ছেন। রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিতরা বাজারসহ নানা জায়গায় যাচ্ছেন। তবে সেসব প্রতিষ্ঠানে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর খুব বেশি পাওয়া যায়নি।

করোনার রেড জোন হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল নারায়ণগঞ্জ। সেখানেও সারা দেশের মতো প্রায় সাত মাস ধরে খোলা রয়েছে দুই হাজার মাদরাসা। এসব মাদরাসায় পড়ালেখা করছে প্রায় আড়াই লাখ ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু মহামারি করোনা এখন পর্যন্ত তাদের স্পর্শ করতে পারেনি।

নারায়ণগঞ্জের মাদানীনগর মাদরাসায় রয়েছে দুই হাজার ৫০০ শিক্ষাথী, দেওভোগ মাদরাসায় দেড় হাজার, আমলাপাড়ায় ৫০০, হাজীপাড়া মাদরাসায় এক হাজার, কাশীপুর মাদরাসায় ৮০০, সিদ্ধিরগঞ্জের মুক্তিনগর মাদরাসায় এক হাজার, আলীরটেক মাদরাসায় ৫০০, হাজীগঞ্জ মাদরাসায় ৫০০, সাইনবোর্ডের হাজী সাইজুদ্দিন মাদরাসায় ৫০০ ও হাজী ইব্রাহিম মাদরাসায় রয়েছে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী। এসব মাদরাসায় ভয় এড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে পাঠদান। গত সাত মাসে নিঃসংকোচে পাঠদান চলছে। কোনো ছাত্র-ছাত্রীর অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর ওলামা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনা আল্লাহ তায়ালর গজব। এই গজব থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় আল্লাহর কাছে পানা চাওয়া। এ জন্য মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ করে লকডাউনে থাকলে চলবে না। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। নাফরমানি, পাপাচার থেকে মুক্ত থাকতে হবে।’

কেন্দ্রীয় বেফাকের আমেলা সদস্য ও দেওভোগ মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আবু তাহের জিহাদী বলেন, ‘আমরা মাদরাসা চালাতে গিয়ে প্রথমে আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা রেখেছি। তারপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তাই মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেফাজত করছেন।’

নারায়ণগঞ্জ বেফাকের সভাপতি ও আমলাপাড়া মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল কাদির বলেন, ‘মাদরাসাগুলোতে প্রতিনিয়ত ইবাদত-বন্দেগি হচ্ছে। নামাজ, কোরআন পাঠ এমনকি তাহাজ্জুদের নামাজ হচ্ছে; যে কারণে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে আমাদের ওপর। তিনিই আমাদের করোনা থেকে মুক্ত রেখেছেন।’

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর