বিদেশের চাকরী ছেড়ে ইউএসবাংলা এয়ারলাইনসের মালিক

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বিদেশে গেলে একেক সময় একেক এয়ারলাইনসে উঠতাম। দেখতাম, বিদেশি এয়ারলাইনের বেশির ভাগ যাত্রীই বাংলাদেশি। দেশের টাকা বিদেশিরা নিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকায় থাকতে একটি এয়ারলাইনসে কাজ করেছিলাম। মাথায় এল একটি ভালো এয়ারলাইনস করলে কেমন হয়। তখন দেশে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

সবাই বলল পাগলামি। তারপরও সাহস করে নেমে পড়লাম। শুরুতে ছিল দুটি এয়ারক্রাফট, পরে আরেকটি-এখন ১৩টি এয়ারক্রাফট বহরে। মাসে ১৭০০ অভ্যন্তরীণ আর ৪০০ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছি। হাঁটি হাঁটি পা পা করে নিজেদের বেড়ে ওঠার গল্প বলছিলেন দেশে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা ইউএস–বাংলা এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন।

বারিধারায় নিজের কার্যালয়ে বসে চল্লিশ পেরোনো এই ব্যবসায়ী সেদিন যেন তাঁর ‘স্বপ্ন সত্যি হওয়া’ গল্পের ঝুলি খুলে দিলেন। স্ত্রী দিলরুবা পারভীন পাশেই ছিলেন, গল্পে ছেদ পড়লে ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। দিলরুবা নিজেও কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দুই সন্তানের জননী সংসার সামলানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ী স্বামীকে সহায়তা করেন নিয়ম করে।

ইউএস-বাংলা গ্রুপে এখন প্রতিষ্ঠান সাতটি, আছে একটি মেডিকেলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। তিন হাজারের বেশি মানুষ এখানে কাজ করেন। আবদুল্লাহ আল মামুন স্বপ্ন দেখেন ইউএস-বাংলা গ্রুপে একদিন ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। নিজে একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর করবেন, হাইটেক পার্ক হবে—যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থাকবে।

দূষণমুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠবে আগামীর শিশুরা। এসব স্বপ্নের বীজ তিনি বপন করেছিলেন ২৬ বছর আগে, যে স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর আমেরিকায়। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার বড় আবদুল্লাহ আল মামুনের জন্ম ১৯৭৭ সালের ৫ জানুয়ারি, চাঁদপুরে। বাবা তোফাজ্জল হোসেন ঢালি সরকারি চাকুরে হওয়ার সুবাদে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন।

বাবার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে স্কুল ও কলেজ শেষ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পাস করেন। পরে সমাজবিজ্ঞানেও স্নাতক করেন। আইন বিষয় নিয়েও ডিগ্রি নেন তিনি। এরপর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ১৯৯৩ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় বিষয়ে দুই বছরের একটি ডিগ্রি নেন। সঙ্গে চাকরি করতে থাকেন।

প্রথম চাকরি ছিল ইউএস এয়ারওয়েজে। সেখানে কাজ করতে করতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় নেমে পড়েন। বাড়ি কেনাবেচা থেকে প্রচুর আয় করতে থাকেন। মামুন বললেন, আমেরিকায় গিয়ে আমার মন বসেনি। প্রতিদিনই দেশে আসতে মন চাইত। ২০০৯ সালে একেবারে ফিরে এলাম। এর আগে আমেরিকায় আয় করা টাকা দিয়ে ২০০৩ সাল থেকে পূর্বাচলে জমি কিনেছিলাম।

সেটাই হলো ইউএস-বাংলা অ্যাসেটসের পূর্বাচল আমেরিকান সিটি। ২০০৯ সালে এটাকে আবাসিক প্লট হিসেবে জমি কেনাবেচা শুরু করি। ২০১১ সালে গড়ে তুলি ইউএস-বাংলা লেদার প্রডাক্টস লিমিডেট। ১০০ ভাগ রপ্তানিমুখী এই প্রতিষ্ঠান ব্যাগ ও ফুটওয়্যার তৈরি করে। ওই সময় গ্রিন ইউনিভার্সিটিরও দায়িত্ব নেয় ইউএস-বাংলা গ্রুপ। বর্তমানে সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করে।

দেশে জাপানি ভাষার পরীক্ষা নেওয়ার একমাত্র কেন্দ্রই হলো গ্রিন ইউনিভার্সিটি। এরপরই আসে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। এ ছাড়া ইউএসবি এক্সপ্রেস নামে আমরা একটা কুরিয়ার সার্ভিস চালু করি। দেশের ৬৪ জেলায় তার শাখা রয়েছে। ভাইব্রেন্ট নামে আমাদের একটি জুতা ও ব্যাগের ব্র্যান্ড আছে। যার ১৯টি শোরুম আছে। ইউএস–বাংলা এগ্রো গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।

ইউএস–বাংলা মেডিকেলে কলেজও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে। প্রতিবছর ৫০ জন করে ছাত্র ভর্তি করছি আমরা। সেখানে একটি বড় হাসপাতাল হচ্ছে। আবদুল্লাহ আল মামুন বললেন, ২০১৪ সালে আমরা যখন উড়োজাহাজ খাতে বিনিয়োগ করি, তার আগে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। শুধু টিকে ছিল রিজেন্ট। জিএমজি ধুকধুক করে চলছিল।

উড়োজাহাজ পরিচালনায় অভিজ্ঞতা ছিল এমন লোক নিয়ে একটি দল তৈরি করলাম। তাদের দায়িত্ব দিলাম কেন বেসরকারি উড়োজাহাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তার কারণ খুঁজে বের করতে। নতুন সংস্থা টিকবে কি না খতিয়ে দেখতে। তারা মার্কেট যাচাই করতে শুরু করলেন। সেই যাচাই হয়তো সঠিক ছিল না। তারপরও নেমে পড়লাম।

ওই সময় উড়োজাহাজ পরিবহন খাতে দেশ-বিদেশ মিলে ১০-১২ হাজার কোটি টাকার বাজার ছিল। আমাদের লক্ষ্য ছিল সেই বাজারে ভাগ বসানো। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে আমরা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস চালু করলাম। মাত্র আট মাসের মাথায় সব ধরনের শর্ত পূরণ করে আমরা উড়োজাহাজ পরিচালনের অনুমতি পেলাম। এর আগে কোনো এয়ারলাইনস এত কম সময়ে আকাশে উড়তে পারেনি।

শুরুতে আমাদের নিজস্ব ও ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়ন মিলে বিনিয়োগ ছিল ৫০ মিলিয়ন ডলার। আমরা এসেই যশোর ও সৈয়দপুরে সকালে ও বিকেলে দুই বেলা করে ফ্লাইট দিতে শুরু করলাম। যাতে মানুষ সময় চিন্তা করে ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে পারেন। প্রথম বছরে দুটি, এর এক বছরের মাথায় আরেকটি এয়ারক্রাফট বহরে যোগ করি।

এখন সব মিলে আমাদের বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা ১৩, আরও ২টি নতুন উড়োজাহাজ খুব অল্প দিনে বহরে যুক্ত হবে। ইউএস–বাংলায় প্রথম একেবারে আনকোরা (ব্র্যান্ড নিউ) উড়োজাহাজ কিনে সেবা দিচ্ছে। আরও যে দুটি যুক্ত হবে, সেগুলোও একেবারে নতুন উড়োজাহাজ। দেশের যেখানেই চালু বিমানবন্দর আছে, আমরা সেখানেই যাচ্ছি। বন্ধ হওয়া ঈশ্বরদী বিমানবন্দরেও আমরা ফ্লাইট চালাতে চাচ্ছি।

এ জন্য সিভিল এভিয়েশনকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন বন্দরটি সংস্কার করে খুলে দেন। ইপিজেডের কারণে ঈশ্বরদী এখন ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সাতটি বিমানবন্দরে আমরা সর্বাধিক ফ্লাইট পরিচালনা করছি। এখন দেশি ও আন্তর্জাতিক মিলে প্রতিদিন ৫৮টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস–বাংলা।

ইউএস-বাংলা এখন মাসে ১ হাজার ৭০০ অভ্যন্তরীণ ও ৩৯৬টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালাচ্ছে। সংস্থায় এখন কর্মরত জনশক্তি আছে ১ হাজার ২৫০। মামুন বললেন, ইউএস–বাংলা হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি করার কাজ শুরু করেছি আমরা। এই কারখানায় টিভি, ফ্রিজসহ নানা ধরনের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম তৈরি হবে। আগামী বছরেই তার কাজ শুরু হবে।

এ ছাড়া যানবাহনের চেচিস তৈরির একটি কারখানাও করছি আমরা। এই শিল্পকারখানাগুলো হবে পরিবেশবান্ধব। শুধু এই কারখানা হলে পূর্বাচল আমেরিকা সিটিও হবে আধুনিক বসবাসের স্থান। এই স্মার্ট সিটিতে আন্তর্জাতিক মানের স্কুল হবে। সেখানে লেক, পার্ক, গাছপালা দিয়ে ঘেরা দূষণমুক্ত সুন্দর পরিবেশে বেড়ে উঠবে আগামীর প্রজন্ম। প্রকল্পের রাস্তায় বাতি হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে।

মামুন বললেন, আমি স্বপ্ন দেখি নিজের জমিতে একটি বিমানবন্দর করার। অনেক দেশে বেসরকারি বিমানবন্দর আছে। আমাদের দেশে সে রকম বিমানবন্দর করার অনুমতি দিলে আমরা একটি বিমানবন্দর গড়ে তুলতে পারব। এর সম্ভাব্যতা যাচাইও করছি আমরা। দেখা যাক কী হয়। হয়তো একটি আমরা ছোট আকারের উড়োজাহাজও সংযোজনও করব।

মামুন বললেন, প্রতিদিন খুব সকালে তাঁর দিন শুরু হয়। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে খবরের কাগজ পড়েন। এরপর শুরু হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেলিফোনে যোগাযোগ। নিয়ম করে দুই বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কখনো বিমানবন্দর, কখনো আমেরিকান সিটি, কখনো গ্রিন ইউনিভার্সিটি, কখনো ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে।

বাসায় ফিরতে রাত ৯-১০টা বেজে যায়। বললেন, ঘুমিয়ে নয়, আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আমার স্বপ্নে আসে ইউএস–বাংলা গ্রুপে কর্মরত শত শত কর্মীর মুখ। এরা ভালোবেসে প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিচ্ছে। একদিন হয়তো এই কর্মীর সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। আবদুল্লাহ আল মামুন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউএস–বাংলা এয়ারলাইনস। তথ্যসূত্র: প্রথমআলো।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর