আদর্শ সমাজ গঠনে সিয়াম সাধনা

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ রমজান সংযম ও সাধনার মাস। রোজা পালনের মধ্য দিয়ে আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে মুমিনের জীবনে যে পরিশুদ্ধি আসে তার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে পুরো সমাজে। তাই আদর্শ সমাজ গঠনে রমজানের ভূমিকা ও অবদান অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

আদর্শ সমাজ গঠনে রমজানের গুরুত্ব

আল্লামা ইউসুফ আল-কারজাভি (রহ.) লেখেন, রমজানের সামাজিক কল্যাণের অন্যতম দিক হলো ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা ও অসহায় মানুষের অসহায়ত্বের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করা। রোজাদার তা অর্জন করে যকৃৎ ও নাড়ির আকুতি থেকে এ অভিজ্ঞতা লাভ করে। কেননা যারা প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছে, তারা ক্ষুধার জ্বালা, তৃষ্ণার কষ্ট অনুভব করতে পারে না। তারা মনে করে, সবাই তাদের মতো। কোনো সন্দেহ নেই, আল্লাহ সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য রোজার বিধান দিয়েছেন। তিনি ক্ষুধাকে ধনী ও গরিব সবার জন্য সমান করেছেন। বর্ণিত আছে, ইউসুফ (আ.) রাষ্ট্রের সম্পদ ও খাদ্য ভাণ্ডারের দায়িত্বশীল হওয়ার পরও বেশি বেশি রোজা রাখতেন। তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ভয় পাই যখন আমি তৃপ্ত থাকব, তখন অসহায় মানুষের ক্ষুধার কথা ভুলে যাব।’ (আল ইবাদাতু ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৭৭)

আদর্শ সমাজ গঠনে রমজানের ভূমিকা

রমজানের রোজা আদর্শ সমাজ গঠনে নানামুখী ভূমিকা পালন করে। যেমন—

১. আল্লাহভীতি : আদর্শ মানুষ ও সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান নিয়ামক তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। আল্লাহভীতি মানুষকে অন্যায় কাজ পরিহার এবং আল্লাহর আনুগত্যে উদ্বুদ্ধ করে। রমজান আল্লাহভীতি অর্জনের মাস। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

২. পাপ পরিহার : পাপ ও পাপাচার থেকে ফিরে আসা রমজানের অন্যতম প্রধান দাবি। পাপ পরিহারের মাধ্যমেই ব্যক্তির সিয়াম সাধনা পূর্ণতা পায়। এ জন্য মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)

৩. সাম্য ও সহমর্মিতা : রোজা রাখার মাধ্যমে মুমিন অসহায় ও ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট অনুধাবন করতে পারে। ফলে তার ভেতর সাম্য ও সহমর্মিতার চিন্তা জাগ্রত হয়। সে অন্যের কষ্ট ভাগ করে নেয়। সাম্য ও সহমর্মিতার চিন্তা জাগ্রত করতে ইসলাম রমজানে বেশি বেশি দান করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল। রমজানে যখন জিবরাইল তাঁর সঙ্গে দেখা করত তখন তাঁর দানশীলতা আরো বেড়ে যেত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬)

৪. সহনশীলতা : রমজান মুমিনকে সহনশীল হতে শেখায়। ফলে সে অন্যের অন্যায় ও অবিচার উপেক্ষা করে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ। তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রোজা পালন করে, তখন সে যেন অশ্লীল বাক্য ব্যবহার না করে এবং উচ্চৈঃস্বরে কথা না বলে ও কারো ওপর রাগান্বিত না হয়। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসে, তখন সে যেন বলে, আমি রোজা পালন করছি।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২১৭)

৫. অন্যায় থেকে আত্মরক্ষা : রোজা শুধু অন্যের প্রতি সহনশীল হতে শেখায় না, বরং অন্যদের অন্যায় থেকে আত্মরক্ষারও উপায়। মারিয়াম (আ.)-কে সমাজের কুৎসিত প্রশ্ন ও অন্যায় আচরণ থেকে বাঁচতে বলা হয়েছিল, ‘মানুষের মধ্যে কারো যদি তুমি দেখো তখন বোলো, আমি দয়াময়ের উদ্দেশে রোজা তথা মৌনতা অবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করব না।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৬)

৬. পবিত্রতা লাভের অনুপ্রেরণা : রোজা মানুষকে পাপমুক্ত পবিত্র জীবনের অনুপ্রেরণা জোগায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস রেখে সওয়াবের নিয়তের রমজানে রাত জাগরণ করে (তারাবি ও তাহাজ্জুদ) আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব পাপ মার্জনা করে দেন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২০২)

৭. সামাজিক সম্প্রীতি : রোজা মানুষের অন্তর থেকে বিদ্বেষ দূর করে। তাই সমাজে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা তৈরি হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজান ধৈর্যের মাস। প্রতি মাসে তিন দিন রোজা পালনে অন্তরের ক্রোধ ও বিদ্বেষ দূর হয়।’ (মুসনাদে আহমদ)

৮. ফিতনা থেকে আত্মরক্ষা : রোজা পালনের মাধ্যমে বান্দা ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা পায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষ নিজের পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পাড়া-প্রতিবেশীদের ব্যাপারে যে ফিতনায় পতিত হয়; নামাজ, রোজা, দান, (ন্যায়ের) আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ তা দূরীভূত করে দেয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৫)

আদর্শ সমাজ গঠনে করণীয়

উল্লিখিত কল্যাণ লাভের জন্য যথাযথভাবে রোজা পালন করা আবশ্যক। জাবির (রা.) বলতেন, ‘তুমি যখন রোজা রাখো, তখন যেন রোজা রাখে তোমার কান, তোমার চোখ, তোমার জিহ্বা মিথ্যা ও হারাম থেকে। তুমি প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া ছেড়ে দাও এবং তোমার জন্য আবশ্যক হলো স্থিরতা ও প্রশান্ত মন। তোমার রোজা রাখা দিন এবং রোজাহীন দিন যেন সমান না হয়।’ (খাওয়াতিন আওয়ার রমজানুল মোবারক, পৃষ্ঠা ১৮)

আল্লাহ সবাইকে যথাযথভাবে রোজা রাখার তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর