অপেক্ষায় খালেদা জিয়া, সরকার সিদ্ধান্ত জানাবে আজ

সরকারের অনুমতি পেলেই উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাঁর পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। তবে সরকারের অনুমতি পেতে দেরি হওয়ায় বিএনপিতে কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে।

খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে অনুমতি চেয়ে তাঁর পরিবারের আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তাঁকে বিদেশে যেতে দেওয়ার বিষয়ে আইনগত মতামত নিতেই আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আজ রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিতে পারে।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মতামত দিয়ে আগামীকাল (রবিবার) ফাইলটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’

সরকার নির্বাহী আদেশে সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে বিদেশ যেতে অনুমতি দিতে পারে কি না, এ জন্য আদালতের অনুমতির প্রয়োজন আছে কি না-এমন আলোচনা চলছে। আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী বলছেন, আদালতের মতামত নিতে হবে।

অন্যদিকে খালেদা জিয়ার পাসপোর্টও গতকাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, পাসপোর্ট ও সরকারের অনুমতি একই সূত্রে গাঁথা। অনুমতির ‘সবুজ সংকেত’ গেলে পাসপোর্টও সঙ্গে সঙ্গেই দেওয়া হবে।

পাশাপাশি ব্রিটিশ ভিসা খালেদা জিয়ার জন্য কোনো কঠিন বিষয় নয় বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগ রাখছে তাঁর দল। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। লন্ডনে বসবাসরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ জন্য তৎপর রয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, লন্ডনে যেতে খালেদা জিয়ার কোনো অসুবিধা হবে না বলেই তাঁরা মনে করেন। তাঁরা জানান, বিশেষ বিবেচনায় খালেদা জিয়াকে ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করবে বলেই তাঁদের মনে হয়েছে।

সূত্র মতে, প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ব্রিটিশ ভিসা পাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে কথা বলে রাখার পাশাপাশি বিমান ভাড়া করার বিষয়েও খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে কথা বলে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারা লন্ডনে যাবেন, সে বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে। গৃহকর্মী ফাতেমা ছাড়া নার্স ফারজানা রূপা, একজন চিকিৎসক ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য তাঁর সঙ্গে লন্ডনে যেতে পারেন। বিএনপির দু-একজন নেতাও তাঁর সঙ্গে যেতে পারেন বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব কিছু সরকারের অনুমতির ওপর নির্ভর করছে। সরকার অনুমতি না দিলে কিভাবে ম্যাডাম যাবেন।’ তিনি বলেন, ‘অনমুতির পর পাসপোর্ট, ভিসা—এগুলো প্রযোজন হবে। দেখি, আমরা অপেক্ষায় আছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের স্বাস্থ্যের অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে।’

দুর্নীতির দুটি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি ছিলেন খালেদা জিয়া। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের আবেদনে সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাঁকে গত বছর ২৫ মার্চ মুক্তি দেয় সরকার। এরপর খালেদা জিয়া রাজধানীর গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজায়’ ওঠেন। তাঁর মুক্তির মেয়াদ আরো বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর গত ২৭ এপ্রিল তাঁকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিতে সরকারের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে তাঁর পরিবার ও বিএনপি।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে সাময়িকভাবে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। সুতরাং তাঁকে বিদেশ নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার সরকারের। তিনি বলেন, সরকার যদি মনে করে যে ৪০১(২) ধারা অনুযায়ী আদালতের অনুমতির প্রয়োজন আছে, তবে সরকারের হাতে সে সুযোগ রয়েছে। আর সরকার যদি মনে করে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন নেই, সে ক্ষেত্রেও সরকারকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ফৌজদারি কার্যবিধি দিয়েছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চূড়ান্ত।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইলে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যাহা মানিয়া নেয়, সেই শর্তে তাহার দণ্ড কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখিতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করিতে পারিবেন।’ আর একই কার্যবিধির ৪০১(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যখন কোনো দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করিবার জন্য সরকারের নিকট আবেদন করা হয়, তখন যে আদালত উক্ত দণ্ড দিয়াছিলেন বা অনুমোদন করিয়াছিলেন সেই আদালতের প্রিসাইডিং জজকে সরকার উক্ত আবেদন মঞ্জুর করা উচিত কিংবা মঞ্জুর করিতে অস্বীকার করা উচিত কি না সে সম্পর্কে তাহার মতামত ও মতামতের কারণ বিবৃত করিতে এবং এই বিবৃতির সহিত বিচারের নথির নকল অথবা যে নথি বর্তমানে আছে সেই নথির নকল প্রেরণ করিবার নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবেন।’

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আমি বরাবরই বলে আসছি যে দুটি দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। নির্বাহী আদেশে তাঁকে যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে তা আইনসিদ্ধ হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী আদালতের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। আর এখন তাঁকে বিদেশ নিতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় সরকারকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটা সরকারের মামলার ক্ষেত্রে। দুদকের মামলার ক্ষেত্রে সরকারকে কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একমত পোষণ করে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, যেহেতু নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন বাইরে আছেন, সেই কারণে তাঁকে বিদেশ যাওয়ার জন্য আদালতের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সরকার অনুমতি দিলেই চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশ নেওয়া যাবে।

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ আমিনুল ইসলামও সেটাই মনে করেন। তবে তিনি বলেছেন, এ ক্ষেত্রে সরকার যদি মনে করে যে তারা আদালতের অনুমতি নেবে, আইনে সে সুযোগও রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর