প্রভাবশালী দেখলেই ‘নীরব দর্শক

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকিতে আইন আছে, কিন্তু আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারার প্রয়োগ নেই। আইনের বিভিন্ন ধারার আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা বিধিমালা এবং সার্কুলারগুলোও অনেক ক্ষেত্রে মানা হয় না। বিশেষ করে প্রভাবশালী গ্রাহক দেখলে তো কথাই নেই। এসব বিধিবিধান যেন ‘নীরব দর্শকের ভূমিকা’য় অবতীর্ণ হয়। তখন আইন ও সার্কুলারের ব্যাখ্যা হয়ে যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন।

‘ব্যাংক-গ্রাহক’ বা ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান-গ্রাহক’র সম্পর্কের ভিত্তিতে বদলে যায় সব আইন-কানুন। এতে বাড়ছে জালজালিয়াতি ও প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো আর্থিক খাত। আমানতকারীদের অর্থ চলে যাচ্ছে জালিয়াতদের পকেটে। ঋণের একটি অংশ বিদেশে পাচারও হয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আর্থিক খাতে সব গ্রাহকের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ সমানভাবে হওয়া উচিত। এখানে প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের চাপ সব সময়ই আর্থিক খাতের ওপর রয়েছে। এগুলোকে মোকাবিলা না করে বিভিন্নভাবে তাদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকভেদে আইনের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার নজিরও রয়েছে। এর প্রভাবে প্রথমত আর্থিক খাতে সুশাসনের বড় ঘাটতি হয়েছে। এর অভাবে বেড়েছে জালজালিয়াতি।

তিনি আরও বলেন, আর্থিক খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হলে অবশ্যই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে তদারকির ক্ষেত্রে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে বেশ কঠোর করা হয়েছিল। সেই অবস্থায় আবার ফিরে যেতে হবে। কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ না হলে সুশাসন নিশ্চিত করা কঠিন হবে। মনে রাখতে হবে আর্থিক খাতে সুশাসনের ঘাটতি থাকলে বা দুর্বল হলে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। বিদেশি ব্যাংক এলসি নিতে চাইবে না। তখন তৃতীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি দিয়ে এলসি খুলতে হলে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাবে।

সূত্র জানায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত হয় ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২’ দ্বারা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’, সরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় ‘ব্যাংকস জাতীয়করণ অধ্যাদেশ ১৯৭২’ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলা নিয়ন্ত্রিত হয় ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩’-এর আওতায়। সব খাতেই নজরদারি করতে রয়েছে ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০০২’।

প্রতিটি আইনেই আর্থিক খাত তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের বিধি ও নীতিমালা প্রণয়েনর ক্ষমতাও রয়েছে। এর আলোকে নানা ধরনের বিধি ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আরও প্রায় এক ডজন নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে।

দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কার্যকর হয়েছে ২০০২ সাল থেকে। এর আওতায় প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও পরে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) একাধিক সার্কুলার জারি করে ব্যাংক হিসাব খোলার বিধিবিধান সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ফলে এখন আর ব্যাংকিং খাতে বেনামি হিসাব খোলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও ব্যাংকগুলোতে অনেক বেনামি হিসাব রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে।

শুধু ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের প্রায় ৮৩টি বেনামি হিসাবের হদিস পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ফাস ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের বেনামি হিসাব ব্যবহার করা হয়েছে। এ বিষয়ে এখন আলাদা তদন্ত হচ্ছে। বেসিক ব্যাংক জালিয়াতিতে ছিল বেনামি হিসাবের আধিক্য।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের চট্টগ্রামের একটি শাখায় বেনামি হিসাব খুলে ৩৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়েছে। আরও একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঢাকার একটি শাখার বেনামি হিসাবের মাধ্যমে ৮৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়লে পরে গ্রাহক তা স্বীকার নেয়। এ রকম আরও অনেক বেনামি হিসাবে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা তদন্তে উঠে এসেছে। এসব বেশির ভাগ ঘটনার সঙ্গেই পরিচালকদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের গ্রাহকদের সম্পর্কে তথ্য জানার বিধান রয়েছে। এর আওতায় গ্রাহকরা বছরে বা মাসে কেমন লেনদেন করবেন সে তথ্য ব্যাংককে জানাতে হবে। এর চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত বেশি লেনদেন হলে গ্রাহককে প্রশ্ন করতে পারবে ব্যাংক।

এই বিধান মানলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জালজালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এই বিধান মানা হয় না। যেসব হিসাবে এসব বিধিবিধান মানা হয় না সেগুলোতেই ঘটে জালজালিয়াতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের ঘটনা।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মানি লন্ডারিং আইন মেনে চললে বেনামি হিসাব খোলার কোনো সুযোগ নেই। কোনো হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেনও করলেও তা ধরা পড়বে। এই আইন থাকার পরও কীভাবে একটি অখ্যাত শিল্প গ্রুপ একটি ব্যাংক থেকে ৫-৬ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করছে। তার মানে হচ্ছে আইনের প্রয়োগ করছে না ব্যাংক কর্মকর্তারা। বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতির ক্ষেত্রে এ রকম আইনের প্রয়োগ না করার নজির রয়েছে। যা আর্থিক খাতের জন্য কোনো শুভ লক্ষণ নয়।

তিনি আরও বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটে গেছে এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক থাকলে এত বড় জালিয়াতি কোনোক্রমেই ঘটতে পারত না। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে হবে। তাহলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

জানা গেছে, প্রচলিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ৩০ শতাংশের বেশি অর্থ কোনো একক গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই বিধান ভঙ্গ করে অনেক গ্রাহককে মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ফলে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে গুটিকয়েক গ্রুপের হাতে। অথচ ভালো গ্রুপ বা উদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী কোনো পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে তার মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারেন না। কিন্তু অনেক পরিচালক এ বিধি ভঙ্গ করে বেশি ঋণ নিয়েছেন। এর বেশির ভাগই নিয়েছেন বেনামে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে সেগুলো ধরাও পড়ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের বিষয়ে আগে কঠোর বিধান ছিল। রাজনৈতিক চাপে এগুলো শিথিল হতে হতে এখন আর কঠোরতা বলতে কিছু নেই। আগে পর্ষদে পরিচালক থাকতে পারত নয়জন। এখন তা বেড়ে ২০ জনের বেশি থাকতে পারছে। একই পরিবার থেকে ২ জনের বেশি থাকতে পারত না। এখন আরও বেশি থাকছে। পরিচালকের মেয়াদ আগে ছিল ছয় বছর। এখন তা হয়েছে নয় বছর। এসব শিথিলতায় পরিচালকরা অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছেন। আর ব্যাংকে ঋণখেলাপি বা জালজালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে পরিচালকদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো রোধ করতে হলে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যে খাতে ঋণ নেওয়া হবে, সেই খাতেই ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এমন অনেক ঘটনা ধরা পড়ছে। শিল্প স্থাপনের জন্য ঋণ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার ঘটনা ধরা পড়েছে। এলসির বিপরীতে নিয়ে বিদেশে পাচার করার ঘটনাও শনাক্ত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাস্টার্ড সার্কুলার অনুযায়ী তিন দফার বেশি খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের আওতায় খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে এর চেয়ে বেশি। একটি সরকারি ব্যাংকে একজন গ্রাহকের ঋণ ১৭ দফা এবং অপর একটি সরকারি ব্যাংকে ৮ দফা নবায়নের নজির রয়েছে।

রপ্তানি আয় তিন থেকে চার মাসের মধ্যে দেশে আনার বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক রপ্তানি আয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশে আসছে না। একটি পর্যায়ে তা বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে এমন প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার রপ্তানি আয় দেশে আসেনি। এর একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

একইভাবে আমদানি পণ্যও তিন থেকে চার মাসের মধ্যে দেশে আনার কথা। কিন্তু সেগুলোর একটি অংশ দেশে আসছে না। আমদানির এসব একটি অংশ বিদেশে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে।

আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্য ঘোষণা দেওয়ার কথা। কিন্তু এটিও মানা হয় না। বিশেষ করে রপ্তানির মূল্য কম ও আমদানির মূল্য বেশি দেখিয়ে দেশ থেকে টাকা পাচার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে আমদানির বিপরীতে আরোপিত শুল্ক ও অন্যান্য রাজস্ব।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রকাশিত গত বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ব্যাংকিং খাতের নীতি প্রণয়ন ও তদারকি করবে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না মুদ্রানীতি। বিশেষ করে তদারকির অভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠনগুলোতে প্রায়ই জালজালিয়াতির ঘটনা ঘটছে।

করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে চলতি মূলধন ঋণের জোগান দিতে তিনটি প্যাকেজের আওতায় ২৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দিতে উৎসাহী হলেও কুটির, ক্ষুদ্র শিল্পে দিতে ইচ্ছুক নয়। ফলে প্রণোদনা প্যাকেজের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়েও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর