নারিকেলের ২০ গাছ, বছরেই লাখপতি

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  গাছে না উঠে মাটিতে বসেই এবার পাড়া যাবে নারিকেল। শুনে অসম্ভব মনে হলেও বিষয়টি সম্ভব করেছেন কৃষিবিদরা। বনসাই আকৃতির এ নারিকেলের চাষ তাই ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চাইলে যে কেউ হতে পারেন বছরেই লাখপতি।

দেশে নারিকলের চাহিদা ৩০০ মিলিয়ন হলেও প্রতিবছর উৎপন্ন হয় ১০০ মিলিয়ন পিস। সুতরাং বাকিটা আনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। এই ঘাটতি পূরণের কথা মাথায় রেখে এবং ভিয়েতনামের আদলে নারিকেলভিত্তিক পরিবার বা সমাজ তৈরি করতে ২০১৫ সালে ওপেন পলিনেটেড ইনব্রিড ডুয়ার্ফ ভ্যারাইটির নারকেলের চারা বাংলাদেশে আনা হয়। ইনব্রিড ভ্যারাইটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ থেকে বংশবিস্তার সম্ভব। যেটা হাইব্রিড ভ্যারাইটিতে হয়না। পাশাপাশি যেখানে ন্যাচারাল ভ্যারাইটির গাছ লাগানোর ৬ থেকে ৭ বছর পর প্রতি বছরে  ফলন আসে ৫০ টা নারকেলের, সেখানে মাত্র ২ থেকে আড়াই বছরের মাথায় এই জাতের গাছ ফল দেয় ২৫০ টি নারকেল। তাছাড়া বেঁটে প্রজাতি হওয়ায় ঝড়ে এই গাছ ভাঙার কোনো ভয় নেই।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের জন্য ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পের অধীনে প্রথম ধাপে ভিয়েতনাম থেকে ২০ হাজার নারিকেলের চারা আনা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে আনা হবে আরো ৭ লাখ ৫০ হাজার চারা।

আমদানিকৃত চারাগুলো দুই জাতের। এর একটি হল সিয়াম গ্রিন কোকোনাট। এটি ডাব হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই জনপ্রিয়। এ জাতের ডাবে ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিলিটার পানীয় পাওয়া যায়। তবে ফলের আকার কিছুটা ছোট। আরেকটি জাতের নাম সিয়াম ব্লু কোকোনাট। এটিও অতি জনপ্রিয় জাত। বাংলাদেশে থাই পেয়ারার প্রবক্তা কৃষিবিদ মো. কামরুজ্জামান ভিয়েতনামে গিয়ে উচ্চ ফলনশীল নারিকেলের এই দুটি জাত শনাক্ত করেন।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টাডিজের ডিন প্রফেসর ড.পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, প্রতি বিঘাতে এই জাতের ৪৫টি গাছ লাগানো যাবে। প্রতিটি গাছের মধ্যবর্তী দূরত্ব রাখতে হবে ৬ মিটার। মধ্যবর্তী দূরত্বের ফাঁকা জায়গায় পেয়ারা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, বিভিন্ন ধরণের সবজি লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে যে কেউই লাভবান হতে পারবেন।

তিনি বলেন, বাগান থেকে এই জাতের প্রতিটি নারকেল ২০ থেকে ২৫টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। এক বছরে ১টা গাছ থেকে ৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। যেখানে স্থানীয় জাত থেকে পাওয়া যায় ১৫০০-২০০০টাকা।

সাধারণত কোস্টাল এরিয়ার নারিকেলের স্বাদ বেশি ভালো হয়। কারণ সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানির লেভেলটা সমতল ভূমির থেকে ভালো থাকে। এ কারণে বাংলাদেশে ভিয়েতনামের এই জাতটি প্রথমে সমুদ্র তীরবর্তী ২২টি জেলার জন্য আনা হয়। যেগুলোর চারা ডিএই বিনামূল্যে জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করে। পরবর্তীতে এই চারা সমতল ভূমির জন্যেও আনা হয়। সমতল ভূমির এলাকাগুলো হচ্ছে টাংগাইল, ময়মনসিংহ, নাটোর, নওগাঁ ও দিনাজপুর।

ড.পরিমল কান্তি বলেন, ইনব্রিড ডুয়ার্ফ জাতের এই নারিকেলের দুটি ‘উল্লেখযোগ্য’ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটি উচ্চফলনশীলতা এবং অপরটি মাকড়শা প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ন্যাচারাল ভ্যারাইটির একটি গাছ যেখানে ৮০-৯০ ভাগ মাকড়শা দ্বারা আক্রান্ত হয়, সেখানে এই জাতের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় মাকড়শা আক্রমণ করতে পারেনা।

বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে নারিকেল গাছের পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, শিকড় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নানারকম মুখরোচক খাবার তৈরিতেও নারিকেলের জুড়ি নেই। পাশাপাশি সুস্বাদু পানীয় ও রোগীর পথ্য হিসেবে ডাবের গুরুত্ব তো রয়েছেই।

স্থানীয় জাতের নারিকেল গাছ আকারে লম্বা। এগুলো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ঝড়ো হাওয়া সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ইনব্রিড ডুয়ার্ফ জাতের ভিয়েতনামের এই নারিকেল গাছ আকারে ছোট। অনেকটা বনসাইয়ের মত। এ কারণে গাছ ঝড়ে ভেঙে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া ফল আহরণেও লাগেনা কোন জনবল। চাইলে যে কেউ সহজে মাটির সঙ্গে লেগে থাকে এ ফল সংগ্রহ করতে পারে।

বাংলাদেশে ডাব বিক্রির পরিমাণ বেশি। এ কারণে নারিকেল গাছের বীজ প্রাপ্তির সংখ্যা দিনদিন কমে আসছে। ভিয়েতনামের এই জাতটি হতে পারে আমাদের জন্য সহায়ক। কারণ এর বীজ থেকে বংশবিস্তার বা এক্সপেন্ড সম্ভব।

ভিয়েতনামের বেঁটে জাতের এ গাছের ডাব খুবই সুস্বাদু। আকারে ছোট হলেও এ ডাবে পানির পরিমাণ থাকে বেশি। সব ধরনের মাটিতেই এ গাছ লাগানো যায়। আকারে ছোট হওয়ায় এর পরিচর্যা করাও সহজ।

ইতোমধ্যে বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ খাটো জাতের নারিকেলগাছ লাগানো হয়েছে। পাহাড়ি এলাকাতেও লাগানো হয়েছে এই গাছ। রাঙামাটির বিভিন্ন পাহাড়ে এমনভাবে এ চারা রোপণ করা হয়েছে, ওপর থেকে দেখলে মনে হবে পাহাড় যেনো তার পায়ে নূপুর পরে আছে।

ভিয়েতনামে এ জাতের ডাব ও নারিকেল বিক্রি করে অনেক পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই জাতের চাষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে-এমনটাই মনে করছেন কৃষিবিদসহ সংশিষ্টরা।

প্রফেসর ড.পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, জাতটি আমাদের দেশের জন্য সম্ভাবনাময়। সঠিকভাবে চাষ করতে পারলে দেশের কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন।

তিনি বলেন, এই জাতের চারা চাষাবাদ থেকে ফল আহরণ পর্যন্ত একটু ভালোভাবে পরিচর্যা ও বাগান পাহারায় সতর্কতা অবলম্বন করলে কৃষক সর্বোচ্চ ফলন পাবে। যেটি দেশের নারিকেলের ঘাটতি মেটাবে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর