পাহাড়ি গ্রামে আতঙ্ক, ‘শরণার্থী গুজব’

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জুম্ম জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার (এমএন লারমা) নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস)। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে গঠিত হয় জেএসএসের সামরিক শাখা ‘শান্তি বাহিনী’।

এরপর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জেএসএসের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে (সন্তু লারমা) সরকারের সাথে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সম্পাদনের মধ্য দিয়ে অবসান হয় শান্তি বাহিনীর গেরিলা আন্দোলনের।

সরকারের সাথে করা চুক্তির দুই শতক পার হয়ে গেলেও চুক্তির মূল বিষয়গুলো এখনও বাস্তবায়ন হয়নি-এমন কথা বিভিন্ন মিটিং-মিছিল সভাবেশে বলেই চলছে জেএসএস।

তবে আওয়ামী লীগের নেতারাও বিভিন্ন সময় বলেছেন, চুক্তি করেছে আওয়ামী লীগ; চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নও করবে আওয়ামী লীগ।

চুক্তি পরবর্তী দুই শতকে পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টিয়েছে। এক জেএসএস ভেঙে হয়েছে চারটি আঞ্চলিক সংগঠন। আর আধিপত্য বিস্তার ও এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চারটি সংগঠনের মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থা চলছেই। এতে করে ভালো নেই সাধারণ পাহাড়িরাও।

রক্তপাতে আতঙ্ক এখন পাহাড়ি গ্রাম-শহরে। জঙ্গলে-জঙ্গলে সংঘাত, রক্তপাতের স্রোতের ধারা পৌঁছে গেছে শহরেও। এর মধ্যে দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতেও দানা বেধেছে ‘গুজব’।

রাঙ্গামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চলছে পাহাড়িদের ভারতে ‘শরণার্থী যাওয়ার গুজব’।

যদিও স্থানীয় পাহাড়িরা বিষয়টি সত্য হিসেবে ভেবে নিলেও অনেকেই বলছেন ‘গুজব’।

অনেকেই ‘গুজবে’ কান দিয়ে নিজেদের সর্ব সামর্থ্য বিক্রি করে নগদ অর্থ হাতে রাখছেন। প্রস্তুতি হিসেবে বড় বড় ব্যাগও কিনেছেন কেউ কেউ। আর এসব ব্যাপারে সাধারণ পাহাড়িরা মুখ খুলছেন না।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বাঘাইছড়ি উপজেলার দুরছড়ি বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের বাজারেই অনেক পাহাড়ি এসে চাল বিক্রি করেছে। তাদের নাকি ভারতে শরণার্থী হিসেবে যেতে হতে পারে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই কম দামে তাদের কাছ থেকে চাল-ডাল কিনে ফেলছে।’

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির প্রত্যন্ত গ্রামে এসব গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামে গ্রামে একটি আঞ্চলিক দলের নেতারা বিভিন্ন এলাকার মুরুব্বিদের জড়ো করে মিটিং করেছেন। এরপর থেকেই পাহাড়ি গ্রামে এ ধরনের গুজব আরও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে ভয়ে অনেকেই ঘরের অতিরিক্ত চাল-ডাল বিক্রি করে দিচ্ছেন্ আবার অনেকেই শরণার্থী হওয়ার গুজবকে বিশ্বাস করে বড় বড় ব্যাগ কিনে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছেন।

সূত্রটি আরও জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্ব প্রথম সশস্ত্র আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) দলের পক্ষ থেকে এসব ‘গুজব’ ছড়ানো হচ্ছে। তারা এখন বাঘাইছড়িতে নিজেদের সাংগঠনিক এলাকায় এ বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। আর সাধারণ পাহাড়িরা একে বিশ্বাস করছেন।

সূত্রটি বলছে, গত আগস্ট মাসের প্রথম থেকে বাঘাইছড়ি উপজেলার জীবতলী, বাঘাইছড়ি, লাইল্যাঘোনা, শিজক, সার্বোয়াতলী, খাগড়াছড়ি, দোসর এলাকায় মিটিং করে এ প্রচারণা চালানো হয়। আর এর নেতৃত্বে ছিলেন জেএসএস বাঘাইছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক বড়ঋষি চাকমা, জেএসএস নেতা খোকন চাকমা, বুদ্ধাংকুর চাকমা, দয়াসিন্ধু চাকমা ও আবিষ্কার চাকমা।

একটি বিশেষ সূত্র বলছে, সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জেএসএসের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এখন আত্নগোপনে। এরমধ্যে রয়েছে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও।

এ ঘটনার পর থেকেই পাহাড়ি গ্রামের বাসিন্দারা উৎকণ্ঠায় আছেন। তবে এ ব্যাপারে ওইসব এলাকার বেশ কয়েকজন পাহাড়ি লোকজনের সাথে কথা বললেও তারা প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এ ধরনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে স্থানীয় জেএসএসের নেতারা এ তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অনেকেই শরণার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে চাল-ডাল, গুরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বিক্রয় করেছেন। কেউ কেউ গাছপালা ও জায়গা বিক্রি করতেও চাইছেন। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের এসব জায়গা কে কিনবে?’

জানা গেছে, বাঘাইছড়ি এলাকায় মূলত তিনটি পাহাড়ি সংগঠনের আধিপত্য রয়েছে। এর মধ্যে মারিশ্যা, বাঘাইছড়ি, সার্বোয়াতলী ইউনিয়ন রয়েছে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) দলের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া খেদারমারা, রুপকারী ও বাঘাইছড়ি পৌর এলাকা রয়েছে জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) নিয়ন্ত্রণে।

অন্যদিকে, বঙ্গলতলী ও সাজেক ইউনিয়ন রয়েছে ইউপিডিএয়ের নিয়ন্ত্রণে। এরমধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনগুলো গোপনেও সংগঠনের কাজ পরিচালিত করতে পারে। আর বিশেষ করে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নিয়ন্ত্রিত এলাকা গুলোতেই এই ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বাঘাইছড়ি উপজেলার সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা বলেন, ‘এই ঘটনাটি আমিও শুনেছি, পরে স্থানীয় প্রশাসনকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মিটিং করেছি আমরা। কিন্তু কোনও ভিকটিম পাওয়া যায়নি।’

জেএসএসের এই নেতা বলেন, ‘জেএসএসের প্রতিপক্ষরাই এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে পাহাড়িদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।’

এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) তথ্য ও প্রচার বিভাগে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবীর বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কথা শুনেছি। যারাই রাষ্ট্র-বিরোধী চক্রান্ত করছে, তাদের খোঁজ নিয়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিবো।

জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য অনেক আগেই আমাদের নলেজে এসেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে কাজ করছে। পাহাড়িরা যে চাল-ডাল বিক্রি করছে এগুলা গুজবও হতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর