রোহিঙ্গা সংকট এবং বাংলাদেশ

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মায়ানমারের মতিগতি ভালো নয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টিতে কোনো গতি নেই। যেটুকু আছে তা কচ্ছপতির চেয়েও কম। এক্ষেত্রে মায়ানমারের সরকারের অলিখিত প্রধান অং সান সুচির অবস্থানে কোনো বদল নেই। তাই তার সরকারের সদিচ্ছায় ঘাটতি এখনো প্রবল। তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাইছে না। তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করতে গড়িমসি করছে। অতি সম্প্রতিও সু চি বাংলাদেশের উপর দায় চাপিয়ে নিজেরা পার পেতে চাইছেন।

তার মতো একজন শান্তির নোবেলজয়ী বাস্তববিবর্জিত হয়ে বলেছেন, মিয়ানমার থেকে সামরিক অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনে ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ দায়ী। ভিয়েতনামের হ্যানয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও জানুয়ারিতে এই প্রক্রিয়া শুর” করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত ছিল না। তিনি আরও বলেন, রাখাইনে যেভাবে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছে, এখন ভাবলে মনে হয় তা হয়তো ভিন্নভাবে সামাল দেয়া যেতো।

আমরা জানি, গত বছরের আগস্ট মাসে রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান শুর”র পর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সেনাবাহিনীর বির”দ্ধে তারা গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। তবে কাগুজে হিসেবে সাত লাখ হলেও বাস্তবে হিসেবটা ১০ লাখের উপরে। তাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়ে বিশজুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এককালের নোবেলজয়ী সু চি এখন বিশের বুকে অনেকটাই নিন্দিত এক নেত্রী।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের একটি সমঝোতা হলেও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি। জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থার কর্মীরা বলছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। এক্ষেত্রে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলেও বলেছেন কর্মকর্তারা। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বার্মিজ সেনাবাহিনীর হত্যাকা-নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশকারী দুই সাংবাদিককে সাত বছরের কারাদ-দেয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে অং সান সু চি তারপরও হ্যানয়ে বলেন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য নয়, বরং আইন ভঙ্গ করার জন্য তাদের শাস্তি হয়েছে। অং সান সু চি মিয়ানমারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নন, কিন্তু তাকেই দেশটিতে ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হয়। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং দুই সাংবাদিককে কারাদ-দেয়ার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য চেয়ে বিশ্বব্যাপী দাবি ওঠে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর সেই নীরবতা ভেঙ্গে অং সান সু চি হ্যানয়ে এসব বিষয়ে বক্তব্য দেন।

এরমধ্যেই কিন্তু জাতিসংঘের একটি সংস্থা মিয়ানমারের বির”দ্ধে অভিযোগ তুলেছে যে দেশটি সাংবাদিকদের বির”দ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। আর অং সান সু চির সাম্প্রতিক বক্তব্যের জবাবে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, তিনি সবকিছুই ভুল বুঝেছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বির”দ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তদন্ত করা উচিত বলে সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ওই রিপোর্টে সেনাবাহিনীর বির”দ্ধে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব এবং দাসত্বে বাধ্য করার বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে এসবের সঙ্গে সেখানে নিরাপত্তা হুমকির কোন সম্পর্ক নেই। তবে জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি মিয়ানমারের নেত্রী।

সু চি অবশ্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুর” থেকেই নির্লজ্জভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদীর পক্ষাবলম্বন করেছেন। তিনি এতে বাংলাদেশের উপর দোষ চাপানোর খেলায় মেতে আছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি বাংলাদেশের উপর নির্ভর করছে-সিঙ্গাপুরেও ২১ আগস্ট এম  কথা বলেন তিনি। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি ফের বাংলাদেশের উপর চাপালেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী। সু চি বলেন, তাদের (রোহিঙ্গা) ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের। আমরা তাদের কেবল সীমান্তে স্বাগত জানাতে পারি। তার মত হচ্ছে, ‘আমি মনে করি কতো দ্রুত তাদের ফিরিয়ে দিতে চায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে’। তবে এ প্রক্রিয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া কঠিন বলেও উল্লেখ করেন সু চি। এসব বলে বলে তিনি আসলে মূল সংকট আড়াল করতে চাইছেন। আর নিয়ে সময়ক্ষেপণের কূট-কৌশল।

এর বিপরীতে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মানবিকতাকে সবার উপরে স্থান দিয়ে যাচ্ছে। তাই তো পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম দিন কয়েক আগেই জোর দিয়ে বলতে পেরেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়েই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক সঙ্কট মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আন্তর্জাতিক চাপ না দিলে মিয়ানমার কখনই কোনো বাধ্যবাধকতা পূরণ করেনি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে অনুরোধ করছি।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের মতোই মানবিকতার বিষয়ে কোনো ছাড় দিচ্ছে না। তারাও রোহিঙ্গাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। আসন্ন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বিশ্বের প্রভাবশালী পাঁচটি দেশ রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি দেশ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরে সমাধানের প্রত্যাশা করবে। সে কারণে আসন্ন অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকটই আলোচনায় প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশন সামনে রেখে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা সংকট বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরবে। এসব দেশ ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এছাড়াও তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, আলজেরিয়া, মরক্কো, সুদান ইত্যাদি দেশগুলোর পক্ষ থেকে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানা গেছে।

রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই এ সংকট সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ় ভূমিকা পালন করে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই রাখাইন অভিযানে অংশ নেওয়া মিয়ানমারের সৈনিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন সামনে রেখে দেশটি ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে জাতিসংঘ অধিবেশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরার বিষয়ে জানিয়েছেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট জানিয়েছেন, জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরবে। এছাড়া তিনি জানান, চলতি মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সে কারণে নিরাপত্তা পরিষদের ফোরামেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক সচিব জেরেমি হান্ট জানিয়েছেন, আসন্ন জাতিসংঘ অধিবেশন সামনে রেখে দেশটির পক্ষ থেকে প্রস্তুতি চলছে। জাতিসংঘ অধিবেশন চলাকালে যুক্তরাজ্য মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেরও আয়োজন করবে। সেখানে রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরা হবে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই একজন বিশেষ দূত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কানাডার বিশেষ দূত বব রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদনও পেশ করেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন সামনে রেখে কানাডা সরকার বিশেষ প্রস্তুতিও নিচ্ছে। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেশটি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের অধিবেশনেও কানাডা এই সংকট তুলে ধরবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে ফ্রান্স ও মালয়েশিয়াও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দৃঢ় ভূমিকা পালন করে আসছে। আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে  ফ্রান্স ও মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনের আগেই গত ১২ সেপ্টেম্বর ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সংসদীয় প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন সামনে রেখেই এই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছে। তারা নিজ নিজ দেশের সরকারের কাছে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি জানাবেন। সে অনুযায়ী দেশগুলোর পক্ষ থেকে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরা হবে।

গত বছর জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরা হয়েছিলো। এ বছরও সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকটই প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গত বছর জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাঁচ দফা পেশ করেছিলেন। চলতি বছরও প্রধানমন্ত্রী এই সংকট বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবেন। ২৩-২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অধিবেশন চলবে।

এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এরইমধ্যে এ দাবি জানিয়েছে যে, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে। এ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত দোষীদের আশু বিচার করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) দোষীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছে সংস্থাটি। খসড়া প্রস্তাবের একটি কপির বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকো ১৫ সেপ্টেম্বর এমন খবর দিয়েছে। জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদে দুই সপ্তাহব্যাপী চলমান এক অধিবেশনে ইইউর পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি তোলা হয়। গত মাসে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের ইউরোপের প্রভাবশালী সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপ নেয়া হল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গণহত্যার উদ্দেশ্যেই রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ভয়াবহ গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়া দেশটির সেনাপ্রধান মিং অং হ্লাইংসহ শীর্ষ ছয় জেনারেলকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের জন্য সুপারিশ করা হয়। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার পরিষদে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টটি প্রকাশ করা হবে। ইইউর খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘনে দায়ীদের জরুরি ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন ফৌজদারি আদালতের মাধ্যমে এই বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে।’

এতে আরও বলা হয়, হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া মিয়ানমারকে অবশ্যই মানতে হবে। এর আগে ১০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাসেলেট দোষীদের বিচারে জাতিসংঘকে নতুন কমিটি গঠন ও প্রস্তাব পাসেরও অনুরোধ করেন। সম্প্রতি আইসিসি এক রায়ে জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে বিচার করার এখতিয়ার তাদের রয়েছে। এক্ষেত্রে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে বিতাড়ন গণহত্যা সম্ভাব্য উপাদান কিনা তা খতিয়ে দেখবে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছে আইসিসির বিশেষ আইনজীবী ফাতো বেনসুদা। তবে মিয়ানমার আইসিসির এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিচারের এখতিয়ার আইসিসির নেই। এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর ইইউর পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান কূটনীতিক ফেদেরিকো মোঘেরিনি বলেন, রোহিঙ্গা গণহত্যা বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমারের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এক্ষেত্রে দেশটির সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট শীর্ষ দুটি কোম্পানির ওপর সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করছে অর্থনৈতিক জোটটি।

বিশ^ সম্প্রদায় যে মিয়ানমারের প্রতি কঠোর হতে চাইছে, তার কারণ রোহিঙ্গাদের প্রতি নিষ্ঠুরতার নিত্যনতুন তথ্য উঠে আসা। দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের নতুন এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসা প্রতি দুই রোহিঙ্গা শিশুর একজন মা অথবা বাবাকে হারিয়েছে এবং পরিবারহীন হয়েছে। এর মূল কারণ সহিংসতা। এ প্রসঙ্গে সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, বর্তমানে প্রায় ছয় হাজারের বেশি পিতৃ-মাতৃহীন রোহিঙ্গা শিশু কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে। এসব শিশু খাদ্যের অভাব, শোষণ ও নির্যাতনের ঝুঁকিতে রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজ করার সময় প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, এসব শিশু হয়তো তাদের মা-বাবা কিংবা অভিভাবককে হারিয়েছে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পথে। কিন্তু পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ শিশুই মিয়ানমারের নৃশংস হত্যাকামো-বাবা বা অভিভাবককে হারিয়েছে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের এই গবেষণা ১৩৯ জন অভিভাবকহীন রোহিঙ্গা শিশুকে নিয়ে করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, যেসব শিশু এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের ৭০ শতাংশই অভিভাবকহীন এবং তারা অভিভাবক হারিয়েছে মিয়ানমারের নৃশংস হত্যাকা-ে। ৬৩ শতাংশ শিশু অভিভাবকদের হারিয়েছে তাদের গ্রামে সরাসরি আক্রমণের সময়। আর ৯ শতাংশ শিশু তাদের পরিবার ও অভিভাবকদের হারিয়েছে বাংলাদেশে আসার পথে।
সংস্থাটি বলছে, গবেষণায় অংশ নেওয়া অর্ধেক শিশু জানিয়েছে, তাদের অভিভাবক ও পরিজনদের হত্যা করা হয়েছে। এতে তারা মা-বাবা হারিয়েছে এবং অনেক শিশুই এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সেভ দ্য চিলড্রেনের বাংলাদেশে কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্ক পিয়ারস বলেন, ‘১২ মাস আগে আমাদের কর্মীরা স্বচক্ষে দেখেছেন এসব শিশুকে বাংলাদেশে আসতে। তারা ছিল দুর্দশাগ্রস্ত, ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। কথা বলার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট ছিল না তাদের। আমরা এসব বিচ্ছিন্ন শিশুর জন্য জায়গা তৈরি করছি, যেখানে তারা ২৪ ঘণ্টা সুরক্ষিত থাকতে পারে এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের খোঁজ করেছি। এক বছর পর এটি মোটামুটি পরিষ্কার যে তারা তাদের পরিবার-পরিজন সবাইকে হারিয়েছে। তারা এখন অনাথ।’

মিয়ানমারে সংঘটিত এমন ঘটনাকে ‘নিয়মানুগ, নিষ্ঠুর ও ইচ্ছাকৃত হামলা’ বলে অভিহিত করেছে সেভ দ্য চিলড্রেন। এসব ঘটনায় অপরাধীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুযায়ী শাস্তির আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে জাতিসংঘে সব দেশের প্রতিনিধিদের এ উদ্যোগকে সমর্থন জানানোর আহ্বানও জানানো হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের মিয়ানমারে কান্ট্রি ডিরেক্টর মিসেল ম্যাকগ্রাথ বলেন, এই শিশুদের শৈশব ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার এক বছর হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এক হয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকার বের করতে হবে, যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে একটি নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের সুযোগ দেবে।

আমরা চাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্ভূত সংকটের আশু সমাধান। আর তা করতে হবে মিয়ানমারকে। কারণ এটা বাংলাদেশের সংকট নয়। সমস্যা যাদের তাদেরই তো সমাধানের পথ বের করতে হবে। এমনিতেই দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এক জনবহুল দেশ বাংলাদেশে নানান সমস্যায় জর্জরিত। তার মধ্যে যদি আবার বাড়তি রোহিঙ্গাদের বোঝা চেপে বসে থাকে তা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। তাই রোহিঙ্গাদের ফেরাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বিশসম্প্রদায়কে। কারণ বাংলাদেশের পক্ষে দিনের পর দিন রোহিঙ্গা নামের বোঝা বহন সম্ভবপর নয়।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর