দুই স্ত্রীতে বিদ্রোহের ইঙ্গিত

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে, সিনিয়র নেতাদের দূরে রেখে, লন্ডন নেতা ও মহাসচিবের সিদ্ধান্তে গত সপ্তাহে মির্জা ফখরুল ছাড়া শপথ নিলেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। সেই থেকে তারেক-ফখরুলের ওপর চরম ক্ষোভে গত শনিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও অংশ নেননি খালেদা জিয়ার আস্থাভাজনরা। সিনিয়র নেতারা মনে করছেন, বিএনপির এ পরিস্থিতিতে এখন মাঠপর্যায়ের কর্মীরা স্থায়ী কমিটির নেতাদের নাজেহাল করে ছাড়বে। পথেঘাটে লাঞ্ছিত করতেও আর চিন্তা করবে না।

তাছাড়া দলের এক সিনিয়র নেতা সমপ্রতি ঘরোয়া এক বৈঠকে ঘোষণা দিয়েছেন, মির্জা ফখরুলকে যেখানেই পাবেন; তিনি লাঞ্ছিত করবেন। মাঠপর্যায়ের নেতাদের মত, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির ভূমিকা ছিল এরশাদ চরিত্রের। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করবে না, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে নির্বাচনে যাবে না, অবশেষে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামালের নেতৃত্বে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি নির্বাচনে গেলো! আটটি আসনও পেলো!

এরপর নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানালো। ঘোষণা দিলো, বিএনপি সংসদে যাবে না। বিএনপিকে রেখে ড. কামালের দুই অনুসারী সংসদে যাওয়ায় তাদের বেইমান আখ্যায়িত করলো দলটি। কিন্তু দিন শেষে দলীয় সিদ্ধান্তে সেই বিএনপিও সুলতানের পথ ধরলো! একের পর এক, এমন সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষের কাছে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। হাস্যরসের খোরাকে পরিণত হচ্ছেন দলটির সিনিয়র নেতারা।

এমন পরিস্থিতে আশার বাণী ছিল বিএনপির পাঁচ নেতা সংসদে গেলে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে। ১৫ মে-র আগে খালেদা জিয়া প্যারোল নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছেন; এমন একটি উড়ো খবরও ছিল। কিন্তু এখন তারও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। দলীয় নেতাদের ভাষ্য, খালেদা জিয়াকে মুক্তির সমঝোতায় ক্ষমতাসীন সরকারকে বিশ্বাস করে নাটকীয়তায় শপথ নেয়াটাই বিএনপির চরম ভুল ছিল। শপথ নেয়ার মাধ্যমে সরকারকে বৈধতা দেয়া হলো।

এখন খালেদা জিয়ার যদি মুক্তিই না মিলে, তাহলে কেন এই শপথ? এর জবাবও অনেকে ফখরুলের কাছে চাচ্ছেন। একদিকে ফখরুলকে আর মহাসচিব হিসেবে গ্রহণ করছেন না স্থায়ী কমিটির সদস্যরা, অন্যদিকে জনগণের কাছে সব রাজনৈতিক জবাব হারিয়ে ফেলছে দলটি। এমন পরিস্থিতিতে মহাসংকটে পড়তে যাচ্ছে বিএনপি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়াসহ তার অনুসারীদের মাইনাস করে বিএনপির চূড়ান্ত নেতৃত্ব গ্রহণ করতে ফখরুলকে হাতে রেখে নিজ ছকেই হাঁটছেন তারেক জিয়া। আর তার এই স্বার্থবাদী চরিত্রকে গ্রহণ করছে না স্থায়ী কমিটিসহ স্বয়ং জিয়া পরিবার। এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথিকে নিয়ে দলের সক্রিয় একটি অংশ মাঠে নেমেছে। জানা গেছে, এ অংশটি তারেক রহমানকে মাইনাস করে সিঁথিকে নেতৃত্বে আনার ‘স্বপ্ন’ দেখছে।

এ অংশটির ভাষ্য, গত ২৯ মার্চ দুই সন্তানসহ দেশে এসেছিলেন শর্মিলা। দেশে মোট পাঁচবার খালেদা জিয়ার সাথে কারাগার ও হাসপাতালে দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন তিনি। ১৮ দিন দেশে অবস্থানের পর লন্ডন ফিরে গিয়ে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে খালেদা জিয়ার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। মুক্তির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলেছেন।

কিন্তু তারেক জিয়া তার কোনোটিই করেননি। খালেদা জিয়ার নির্দেশনা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারেকের উল্টোপথে হাঁটাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন জিয়া পরিবারের শর্মিলা সমর্থকরা। উল্লেখ্য, কোকোর মৃত্যুর পর শর্মিলা সিঁথি তার দুই কন্যাকে নিয়ে লন্ডনে বসবাস করছেন।

এদিকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়া যদি কোনো সমঝোতায় মুক্তি পান তা হলে শর্ত হিসেবে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হওয়ার শর্ত থাকবে। তখন তারেক জিয়াকে চেয়ারম্যান করার বড় একটি দাবি উঠবে। সেই আলোকে তারেক জিয়া এখন থেকে তার কর্মপরিচালনা করছেন। যদি কোনো কারণে তিনি সিনিয়র নেতাদের বাধাপ্রাপ্তও হয়ে যান, তখন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের নাম প্রস্তাব করা হবে চেয়ারপারসন করার জন্য।

সাবেক নৌবাহিনী প্রধান রিয়াল অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের মেয়ে হিসেবে জোবাইদা রহমানের বাড়তি জনপ্রিয়তাও রয়েছে দলে। তাছাড়া সমপ্রতি শেখ হাসিনাও জোবায়দার প্রশংসা করেছেন। যদিও ভিসা ও পাসপোর্ট জটিলতায় ডা. জোবাইদা রহমান বাংলাদেশে আসা নিয়ে এখনো জটিলতায় রয়েছেন।

তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বয়ং নেতৃত্ব নিয়ে জিয়া পরিবারেই বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। কেননা, ইতোমধ্যে তারেক জিয়া স্থায়ী কমিটিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না, খালেদা জিয়ার বার্তাও তিনি গ্রহণ করে কার্যত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান ও তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে নেতৃত্বে আনতে বড় আকারে নতুন সংকটে পড়তে যাচ্ছে দলটি- এমন মত দলের ভেতরে ও বাইরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, ইতোমধ্যে বিএনপিতে বড় আকারে সংকট চলছে। গত শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও কেউ অংশগ্রহণ করেননি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে প্রতি শনিবারই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। গত শনিবারই তার ব্যত্যয় ঘটল।

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস প্রায় ১৫ মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তার এ মুক্তি দলের জন্য নতুন কোনো অশুভ বার্তা কি না, এ নিয়েও গুঞ্জন রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণও হতে পারে। কেননা, অতীতে দেখা গেছে শিমুল বিশ্বাস সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করে আসছিলেন।

তবে রাজনৈতিক সূত্রগুলোর দাবি, বাংলাদেশে যেহেতু দীর্ঘ সময় নারী নেতৃত্বে চলে আসছে, সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারের যদি কোনো গতিপথ পরিবর্তন হয়; তাহলে জোবায়দা অথবা শর্মিলার হাতেও যে নেতৃত্ব আসতে পারে এটি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

এদিকে গত শুক্রবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। প্রশ্ন উঠেছে, সবাই পার্লামেন্টে গেলেন, মহাসচিব গেলেন না কেন? এটা আমার কাছেও খটকা লাগে। দলে আলাদা করে কারো হিরো হওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই পরবর্তীতে তিনি ব্যাখ্যা দেবেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নিজেও স্বীকার করেন, বিএনপির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের পাঁচজন গেছেন পার্লামেন্টে। নেত্রীর কথা, দেশের কথা বলবেন। ওই পাঁচজন বলছেন, জনগণের চাপ। আমরা কেউ কেউ বেকুবের মতো বলছি, সরকারের চাপ। জনগণের চাপ সত্যি, নাকি সরকারের চাপ? আমরা এলোমেলো কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছি। শপথ ইস্যুতে আমাদের সবাইকে এক সুরে কথা বলতে হবে। তবে বিএনপির নেতৃত্বে ভুল ছিল বলে দাবি দলটির মহাসচিবের। অতীতে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।

কিন্তু এখন যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তারেক রহমান সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

তবে বিএনপি নিরাশ নয়। সংসদের ভেতরে ও বাইরে আন্দোলন করতে হবে বলেও জানান ফখরুল। তিনি বলেন, সস্তা স্লোগান দিলে হবে না, ঘরে-বাইরে দুই দিকেই সংগ্রাম করতে হবে। তবে যেকোনো পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাজনীতির পরিবর্তন গ্রহণ করতে হবে বলেও জানান বিএনপির এই নেতা।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর