আরেকজন অতিরিক্ত ডিআইজির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের মধ্যেই পুলিশের আরেকজন অতিরিক্ত ডিআইজির বিরুদ্ধে অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারের অন্তত ৬০ কোটি টাকা মূল্যের ৬২ বিঘা তাদের জমি ও গাড়ি-বাড়ি লিখে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগে মামলা হয়েছে এবং বিচারিক তদন্তও শুরু হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা মিলে এই কাজ করেছেন। আর জমি লিখে নেওয়ার পর একাধিক মামলায় তাদের কারাগারে রাখা হয়েছে। ছাড়া পাওয়ার পর তাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে হয়রানির ভয়ে।

এই ঘটনায় অতিরিক্ত ডিআইজি (উন্নয়ন-২) গাজী মোজাম্মেল হক, তার স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেলসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আদালতে। অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন পুলিশ কর্মকর্তাদের আবাসিক প্রকল্প আনন্দ হাউসিংয়ের পরিচালক চৌধুরী মো. জাবের সাদেক, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক দীপক কুমার দাস, রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান, ডেমরার সাবরেজিস্ট্রার আফসানা বেগম, ইউনাইটেড ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমান, দলিল লেখক জাকির হোসেন, জসিম উদ্দিন, আনন্দ পুলিশ হাউসিংয়ের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক এ বি এম সিদ্দিকুর রহমান, খোরশেদ আলম, তরিকুল মাস্টার, পুলিশ সদস্য সিদ্ধার্থ, গনেশ, পলাশ এবং সৈতক।

গত ১৪ মার্চ মামলাটি করেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ৭০ বছরের বৃদ্ধ জাহের আলীর ছেলের স্ত্রী আফরোজা আক্তার আঁখি। আর এরপর আদালতের নির্দেশে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দায়িত্বরত একজন হাকিম এরই মধ্যে চারজনের স্বাক্ষী গ্রহণ করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে মোজাম্মেল হকের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি। এসএমএস পাঠানো হলেও জবাব আসেনি।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, জাহের আলী ও তার ছেলেকে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে আটকে রেখে জমিজমা লিখে নেয়া হয়। এরপর সাজানো প্রতারণার মামলায় তাদের দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রাখে পুলিশ।

এজাহারে বলা হয়, রূপগঞ্জ বক্তবাড়ি এলাকার বাসিন্দা জাহের আলীকে ফোন করে থানায় ডেকে নেয়ার পর থেকে তিনি বেশকিছু দিন নিখোঁজ ছিলেন। গত বছর ১০ জুলাই রূপগঞ্জ থানার ওসি মনিরুজ্জামান মনির ফোন করে তাকে থানায় যেতে বলেন।

এরপর জাহের আলী কয়েকজন বন্ধু ও মেয়ের জামাই আবু তাহেরকে সঙ্গে নিয়ে থানায় যান। সেখান থেকে তাদের পুলিশ সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর থেকে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। রাতে তারা ফিরে না আসায় পরিবারের সদস্যরা থানায় সাধারণ ডায়েরি-জিডি করতে যান। কিন্তু থানা জিডি না নিয়ে উল্টো তাদের এ নিয়ে আর ‘বাড়াবাড়ি না করার’ পরামর্শ দেওয়া হয়। ‘বাড়াবাড়ি করলে’ পরিবারের সবাইকে মেরে গুম করে নদীতে ফেলার হুমকিও আসে।

কয়েকদিন পর পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, পুলিশ সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়ার পর জাহের আলী ও তার জামাইকে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি আটক থাকাবস্থায় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের সব জমিজমা লিখে নিতে চাচ্ছে পুলিশ।

জাহের আলীর ছেলে শফিকুল ইসলাম সাংবাদিককে বলেন, ‘আমার বাবাসহ পরিবারে অন্য সদস্যদের পুলিশ সদরদপ্তরের চার তলায় অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেলের রুমে নিয়ে যায় রূপগঞ্জ থানা পুলিশ। সেখানে সবার হাতে হাতকড়া পরানো হয়। রাতে পুলিশ সদরদপ্তরে ডিবির লোকজন এসে হাজির হয়। তারা আমার বাবাসহ অন্যদের চোখে কালো কাপড় বেঁধে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানোর পর জমিজমা লিখে দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে পুলিশ।’

‘ডিবির পরিদর্শক দীপক কুমার দাস আমাদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার ভয়ও দেখান। একপর্যায়ে ডিবি কার্যালয়ে আটক অবস্থাতেই তারা মোট ১০টি দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য হই। ১১ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৩ দিন আমার বাবা জাহের আলী এবং আমার বড় ভাই আবদুল মতিন ও আমার দুলাভাই আবু তাহের ডিবি অফিসে আটক ছিলাম। প্রতিদিনই তাদের নির্মমভাবে পেটানো হতো।’

‘ভয়ভীতি ও নির্যাতনের মুখে তাদের মালিকানায় যেসব ব্যক্তিগত জমি ছিল তার সবই অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল ও তার স্ত্রীর নামে লিখে দিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সবকিছু লিখে দেওয়ার পরও তারা মুক্তি পাই নাই। ১৬ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি প্রতারণার মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। ২৫ জুলাই ফের তাদের রিমান্ডে নিয়ে আসে ডিবি পুলিশ। ২৬ জুলাই আদালতের আদেশে আনুষ্ঠানিক রিমান্ডে থাকা অবস্থাতেই তাদের কাছ থেকে আরও দুটি দলিল রেজিস্ট্রি করে নেয়া হয়। এভাবে আমাদের বসতভিটাসহ মোট সাড়ে ৬২ বিঘা জমি লিখে নেয়া হয়েছে। যার মূল্য অন্তত ৬০ কোটি টাকা।’

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জমিজমাসহ সর্বস্ব লিখে দেয়ার পরও আমার পরিবারের সদস্যদের জেলে পাঠানো হয়। আমার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একের পর এক প্রতারণার মামলা হতে থাকে। ঢাকার শাহবাগ, ডেমরা থানায় একটি করে দুটি এবং ১১টি প্রতারণার মামলা হয় রূপগঞ্জ থানায়। আদালত একটি মামলায় জামিন দিলেই আরেকটি পেন্ডিং মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতো। ফলে জামিনের শত চেষ্টা করেও তারা কারাগার থেকে বের হতে পারিনি। প্রায় এক বছর তাদের কারাগারে থাকতে হয়েছে।’

বাচ্চাসহ পরিবারের সবাই এখন পলাতক বলে জানান ভুক্তভোগী এই মানুষটি। বলেন, ‘পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে খেয়ে না খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমরা তিন ভাই আবদুল মতিন, রফিকুল ইসলাম ও আমি; আমার ভাতিজা আনিস, দুলাভাই আবু তাহের, আমার ভাবী ও মামলার বাদী আফরোজা আক্তার আঁখি ও আমার বৃদ্ধ স্ত্রী ফিরোজা বেগম। এমনকি ১০ বছরের ভাগনি তাসনিম পুলিশের ভয়ে এক বছর ধরে স্কুলেও যেতে পারছে না। পাঁচ বছরের ভাগনে ভাগনি হামিম, ও আমার বোন হেলেনা বেগমের রাত কাটছে এখানে-সেখানে। পুলিশের ভয়ে আমরা একেক দিন একেক এলাকায় থাকি।’

আদালতে গাজী মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে মামলা করার পর বাদী আফরোজা আক্তার আঁখিকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। এ ছাড়া মামলার সব সাক্ষীর নামেও একাধিক মামলা দেয়া হয়েছে। জমিজমা ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত তিনটি গাড়িও লিখে নেয়া হয়। গাড়িগুলোর নম্বর হচ্ছে- ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৯২৫১ (টয়োটা হ্যারিয়ার), ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-২৫২৮ (হোন্ডা-সিআরভি), ঢাকা মেট্রো ঘ-৩৩৪৬৫২ (টয়োটা এলিয়ন)।

বাসার গ্যারেজ থেকে পুলিশ যখন একে একে তিনটি গাড়ি বের করে নিয়ে যায় তখন সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। আদালতে সেই ফুটেজ জমা দেয়া হয়েছে। তিনটি গাড়ির মধ্যে হ্যারিয়ার মডেলের গাড়িটি এখন নিজেই ব্যবহার করছেন গাজী মোজাম্মেল হক এবং তার তার স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেল। হোন্ডা সিআরবি মডেলের আরেকটি গাড়ি ব্যবহার করছেন মোজাম্মেলের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া ডেমরা সারুলিয়া এলাকায় গাজী মোজাম্মেলের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে অপর একটি গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে।

মামলার এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়- এরা একদলভুক্ত, ঠগ, প্রতারক, আইন অমান্যকারী, ভূমিদস্যু এবং অপরাধচক্রের সক্রিয় সদস্য। অপরাধ আমলে নিয়ে আদালতের কাছে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি অথবা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ চাওয়া হয়। শুনানি শেষে আদালত ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেয়। মামলাটি এখন মহানগর হাকিম ১৫-এর আদালতে বিচারাধীন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আদালতের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ মামলায় বেশিরভাগ আসামি পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় গোপনীয়তার সঙ্গে তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে চারজন সাক্ষীর বক্তব্য শুনেছে আদালত।’

আইনজীবী হাসনাত খাতুন হিয়া সাংবাদিককে বলেন, ‘রিমান্ডে থাকাবস্থায় জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়ার অভিযোগ উপস্থাপন করা হলে আদালত বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এটা কীভাবে সম্ভব? তখন আমরা সংশ্লিষ্ট জমির দলিল থেকে শুরু করে অন্যান্য সব প্রমাণপত্র আদালতে উপস্থাপন করি। পুরো ঘটনা শুনে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেয়।’

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর