কমলা রোদে এঙ্কর ওয়াট

চারিদিকে শান্ত বাতি — ভিজে গন্ধ — মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল; –
এশিরিয়া ধুলো আজ— বেবিলন ছাই হয়ে আছে।“ –জীবনানন্দ দাশবুদ্ধদেব গুহের ‘মাধুকরী’ উপন্যাসে উল্লেখ আছে, নগর যেমন সুযোগ পেলেই অরণ্যকে গ্রাস করে, ঠিক তেমনি মানুষ দ্বারা পরিত্যাক্ত হলে অরণ্যও পুনরায় এসে নগরকে গ্রাস করে থাকে।

১৯৮৫ সালে মিখায়েল গরবাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন। তার ক্ষমতারোহনের অব্যবহিত পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৬ সনে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনার শিকার হয় রাশিয়ার চেরনোবিলের পরমাণু চুল্লি ও প্রিপিয়াত নামের শহর। দায়িত্বরত কর্মীদের ভুলের কারণে রি-অ্যাক্টরটি উত্তপ্ত হয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট মেঘ ইউক্রেন, বেলোরাশিয়া, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের ওপর দিয়ে উড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়া, ব্রিটেন, এমনকি পূর্ব-আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দুর্ঘটনার পর তেজস্ক্রিয়তা থেকে আশপাশের বসতি রক্ষার নিমিত্তে চুল্লির চারপাশে এক হাজার বর্গ কিলোমিটারের একটি নিরাপত্তা জোন তৈরি করা হয় এবং ইউক্রেন ও বেলারুশের সীমান্তবর্তী চেরনোবিল ও প্রিপিয়াত শহর থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। তবে উল্লেখ করার মত বিষয় হল যে, দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত চেরনোবিল ও প্রিপিয়াত শহর পার্শ্ববর্তী রেড ফরেস্টের আগ্রাসনে বর্তমানে ক্রমেই জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর পূর্বে প্রিপিয়াত শহরের উপর থেকে বিমান হতে তোলা ছবিতে দেখা যায় যে, আশেপাশের জঙ্গলের বিস্তারে অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে শহরটির অবকাঠামো। এক সময়ে হয়ত বোঝাই কষ্টকর হয়ে যাবে যে, এখানে কোন কালে জনপদ বলে কিছু ছিল।

কম্বোডিয়ায় আমার অবস্থানকাল ছিলো প্রায় এক বছর। ১৯৯২ সনের মে মাস থেকে ১৯৯৩ সনের মার্চের শেষ পর্যন্ত। এই সময়কালের শেষে বাংলাদেশ থেকে নতুন একদল সামরিক পর্যবেক্ষক আমাদেরকে প্রতিস্থাপন করেছিল। তাদের সময়কালেই জাতিসংঘের অধীনে কম্বোডিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯৩ সনের মে মাসে। নির্বাচনের পর আনটাকের শান্তিরক্ষী বাহিনীকে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৯৩ সনের নভেম্বর মাসের মধ্যে।

কম্বোডিয়াতে আমার অবস্থানকালে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে নমপেন ও স্টুং ট্রেং প্রদেশ ব্যতীত কম্বোডিয়ার অন্য কোনো প্রদেশ বা অঞ্চলে আমার গমনাগমন ছিল না। এমনকি সিয়েমরিয়েপে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নেও আমি গিয়েছি দীর্ঘ ৯ মাস পর। অথচ এই ইউনিটে আমার অন্তত ১৩ জন কোর্সমেট ছিলো। সবাই ক্যাপ্টেন পদবীর।

সিয়েমরিয়েপের অবস্থান ছিল রাজধানী নমপেন থেকে ৩২০ কিলোমিটার উত্তরে। কম্বোডিয়ার কেন্দ্রস্থলে। নিবিড় অরণ্যানী বেষ্টিত একটি জায়গা। হেলিকপ্টারে করে তোনলে স্যাপ সরোবরকে লম্বালম্বি অতিক্রম করে এখানে আসতে হয়। এই জায়গাকে কেন্দ্র করেই খ্রিষ্টীয় নবম থেকে পঞ্চদশ শতক সময়কালে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের বিশাল এলাকা জুড়ে বিকশিত হয়েছিলো এক অনন্য সভ্যতা । নাম খেমার সভ্যতা। সেই সময়ে সিয়েমরিয়েপের নাম ছিল যশোধরা পুর। তৎকালীন খেমার রাজ্যের রাজধানী।

এংকর ওয়াট মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিলো রাজা সূর্যবর্মন-২ এর সময়ে। আনুমানিক ১১১৩ থেকে ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভেতরে। তিনি এংকর রাজ্যের সবচেয়ে বড় রাজা ছিলেন। সম্রাট আকবরের মতো। ৪০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। এংকর নগরী, এমনকি কম্বোডিয়ার অনান্য মন্দির থেকে এংকর ওয়াট মন্দিরটির পার্থক্য হলো যে, এটাতে প্রবেশ করতে হয় পশ্চিম দিক থেকে এবং শিবের পরিবর্তে বিষ্ণুকে এই মন্দিরটি নিবেদন করা হয়েছে। এটা ছিলো রাজা সুর্যবর্মন-২ এর রাষ্ট্রীয় মন্দির। তার সমাধিক্ষেত্রও। হিন্দু মন্দির হিসেবে নির্মিত হলেও চতুর্দশ শতকে এটাকে বৌদ্ধ মন্দিরে রুপান্তরিত করা হয়। মেরু পর্বতের আদলে তৈরী এই ধরণের মন্দিরটিকে বলা হয় মন্দির-পর্বত বা Temple Mountain। হিন্দু পুরাণ অনুসারে মেরু পর্বত হিমালয় পর্বতের অন্যদিকে অবস্থিত, যেখানকার অধিবাসী ছিলেন দেবতারা।

প্রায় ১২০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে প্রাচীন সিয়াম রিয়েপ শহরের বিস্তৃতি ছিল। বলা হয়ে থাকে শিল্পবিপ্লবের পূর্বে এটাই ছিলো পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মেগাসিটি। প্রায় এক মিলিয়ন জনসংখ্যা ছিলো এতে। এই পুরো জায়গা জুড়েই বর্তমানে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই নগরীর ধ্বংসাবশেষ। মজার ব্যাপার হলো, এই ধ্বংসাবশেষ এখনো ধারণ করে আছে মানব সৃষ্ট সবচেয়ে বিখ্যাত কীর্তিস্তম্ভগুলোর কয়েকটি। যারই অন্যতম এই এংকর ওয়াট মন্দির। এংকর ওয়াট সহ এই মন্দিরগুলোই এক সময়ে প্রতিনিধিত্ব করতো এক সুবিশাল নাগরিক সভ্যতার, যা ধর্মীয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমসাময়িক কালের পৃথিবীতে ছিলো মহীরুহের মতো। শুধু মন্দির বা মানমন্দিরই নয়, এই বিশাল নগরী জুড়ে ছিলো হাজারো প্রজাদের বাসস্থান। কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরী এই বাসস্থান সমূহ তৈরী হবার কারণে এদের কোন স্মৃতিচিহ্ন বর্তমানে নেই।

আবার একটু ইতিহাসে ফিরে যাই। পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে থাইল্যান্ড বা শ্যামদেশ উপর্যুপরি খেমার রাজ্য আক্রমণ করে। তাদের ধ্বংসমত্ততা ও লুন্ঠনের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বিশাল এংকর নগরী। খেমাররা পালিয়ে যায় দক্ষিণে। তুনলে স্যাপ সরোবরের দক্ষিণে রাজধানীকে স্থানান্তর করে। এটাই বর্তমানের নমপেন শহর। অতঃপর ক্রমে অরণ্য এসে এই নগরীকে গ্রাস করে। লিখিত ইতিহাসে এংকর ওয়াটের কথা আমরা জানতে পারি জনৈক চৈনিক পরিব্রাজক Daguan Jhou এর বর্ণনা থেকে। তিনি নান্দনিক স্থাপনাকে ঐশ্বরিক সৃষ্টি বলে বর্ণনা করেছেন। এরপর ১৮৬০ সালে ফরাসি গবেষক হেনরী মুয়ট এই অঞ্চলের ঘন অরণ্যের মাঝে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি খুঁজতে গিয়ে প্রবেশ করেন। এই সময়েই তিনি পুনরায় আবিষ্কার করেন হারিয়ে যাওয়া এই বিস্মৃত নগরী। এই আবিস্কারের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে তিনি লেখেন ‘Le Tour Du Monde’ নামক একটি ভ্রমণ ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণামূলক বই। এই বই সাড়া ফেলে পুরো ইউরোপে। তারপর থেকে এই নগরী ইউরোপীয় গবেষক ও পর্যটকদের উৎসাহের বস্তুতে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, এংকরভাট বর্তমান পৃথিবীতেও এক প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময়। এংকর ওয়াট মন্দিরের স্থাপত্য ও নির্মাণকৌশল খেমার জাতির ক্লাসিক স্থাপত্যেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কাল রঙের বেলে পাথর দিয়ে তারা এই বিশাল স্থাপত্য নির্মান করেছিল। জানা যায়, আনুমানিক ১২০০ শতাব্দীর পূর্বভাগেই খেমাররা বেলেপাথর বা বালুশিলার ব্যবহারে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করে।

এঙ্কর ওয়াট ছিল একটি কমপ্লেক্স মন্দির-পর্বত ও এককেন্দ্রিক গ্যালারীর সমাহার। চারপাশের জলাশয় সহ এই মন্দিরের মোট এলাকার মোট ক্ষেত্রফল ছিল ২ বর্গ কিলোমিটার। মন্দিরটি দৈর্ঘে ১.৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ১.৩ কিলোমিটার ছিল। প্রাচীন ভারতের হিন্দু দেবতাদের বাসস্থান মেরু পর্বতের প্রতীকী রূপ ছিল এটা। এই মন্দিরের পাঁচটা স্তম্ভ মেরু পর্বতের পাঁচটা শৃঙ্গকে উপস্থাপন করে থাকে। চারপাশের দেয়াল পর্বতমালা এবং দুর্গ পরিখাগুলো মহাসাগরকে বিম্বিত করে থাকে।

এংকর ওয়াটে আমার ভ্রমণের পর প্রায় তিন যুগ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় স্মৃতিগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসার কারণে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন বা ৩ ইস্ট বেঙ্গলের সদরদপ্তর সিয়াম রিয়েপ শহরের কোন স্থানে অবস্থিত ছিল তা আমার খেয়াল নেই। শুধু মনে আছে হেলিকপ্টার থেকে একটা বিমানবন্দরে নেমেছিলাম। স্থানটি ছিলো সিয়েম রিয়েপ বিমানবন্দর, যা বর্তমানে সিয়েম রিয়েপ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। নামার পর মাত্র শ’দুয়েক গজ হাঁটার পর আমি একটা অফিসে ঢুকেছিলাম। অফিসটি স্থাপন করা হয়েছিল বিমানবন্দরের বিশাল এক হ্যাঙ্গারের ভেতরে। হয়ত বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অথবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে এটা ব্যবহৃত হত। পার্টিশন দিয়ে হ্যাঙ্গারটিকে অনেকগুলো কক্ষে বিভক্ত করা ছিলো। এরই একটা বিশাল কক্ষ ব্যবহৃত ছিল কনিষ্ঠ অফিসারদের থাকার কক্ষ। এরা সবাই ক্যাপ্টেন এবং আমার পূর্ব-পরিচিত। কক্ষের ভেতরে অনেকগুলো ক্যাম্পকট (সামরিক অফিসারদের কর্তৃক যুদ্ধ বা মাঠে অবস্থানকালে ব্যবহৃত মোটা ক্যানভাস ও লোহালক্কড় দিয়ে তৈরী বিছানা) লাগানো। পাশাপাশি। কয়েকজন যুবক অফিসার পাশাপাশি চারটা ক্যাম্পকটের কোণায় বসে আনন্দিতভাবে তাস খেলছিল। এদের ভেতরে দুইজনের চেহারা আজও আমি স্পষ্ট মনে করতে সক্ষম। ক্যাপ্টেন হালিম (এএসসি) এবং ক্যাপ্টেন রেজা (ইএমই)। অপারেশন কক্ষে ছিল ক্যাপ্টেন মামুন ( ইস্টবেঙ্গল)। সম্ভবত সে ইউনিটের এডজুট্যান্ট ছিল। সাহেল ছাড়া আমার আর কোনো কোর্সমেট সেদিন সেখানে ছিল না। কোর্সমেটদের কথা সাহেলকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানিয়েছিলো যে, ওরা সিয়াম রিয়েপের বিভিন্ন স্থানে কোম্পানীগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

৩ ইস্ট বেঙ্গলে সাহেলের নিযুক্তি ছিল অপস অফিসার বা অপারেশন অফিসার হিসেবে। দায়িত্বের কারণে সে মহা ব্যস্ত। এক বিকেল ও এক সারাদিন সে আমার সাথে কোথাও বের হবার সময়ই বের করতে পারল না। পরের দিন ছুটির দিন। সুর্যোদয়ের অনেক পূর্বে সাহেল আর আমি বের হলাম এংকরভাট দর্শনের জন্যে। খুব দূরে নয়। জীপে করে যেতে লাগে মাত্র আধা ঘণ্টা বা তার চেয়েও কম। ঘন অরণ্যানী বেষ্টিত পাকা রাস্তা ধরে আমরা যখন এংকরভাটের পশ্চিম তোরণের কাছে পৌঁছলাম তখনো সূর্য উঠতে বেশ দেরী। সুবহে সাদেকের সময়। ঢাকায় অথবা বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে থাকলে এই সময়ে ফজর নামাজের আজানের শব্দে চারদিক মুখরিত হত। ঢাকা হল মসজিদের নগরী। পাখিরাও সেখানে আজানের শব্দে জাগে। অথচ এখানে, এই গহীন বনের ভেতরে নিশ্চুপ অবস্থা। পাখির শব্দও নেই। কোথায় যেন পড়েছি পাখিরাও যুদ্ধ পছন্দ করে না। তারা অন্যদেশে চলে যায়।

নিস্তব্ধতার ভেতরে তখনও রাতের অন্ধকারের সঙ্গে দিনের আলোর দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে আলো জিতলেই শুধুমাত্র দিন হবে। নতুবা অনন্ত অন্ধকার। হারিয়ে যেতে হবে বিস্মৃতির অন্ধকারে। গাড়ি থেকে নামতেই অন্ধকারের ভেতরেই দেখতে পেলাম সামনে বিশাল জলের সমারোহ। স্থির জল। যদিও অন্ধকারের ভেতরে প্রথম দৃষ্টিতে নদী বলে ভ্রম হয়। আমি সাহেলকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটাই কি সিয়েম রিয়েপ নদী?” সাহেল হেসে দিয়ে বললো, “না, এটা হলো এংকরভাট মন্দিরের চারদিকের জলাশয়। এই জলাশয়ের কারণেই হয়তোবা অরণ্য এসে এখনো মন্দিরকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি।“ বলেই সে ইতিহাস বলা শুরু করলো।

ইতিহাস বলায় সাহেল বরাবরই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আমার সতীর্থ হিসেবে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে এসএসসি ও এইচএসসি’তে বিজ্ঞানের ছাত্র থাকলেও বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ডিগ্রি পড়ার সময়ে সে হয়ে গিয়েছিল ব্যাচেলর অফ আর্টস এর ছাত্র। আর আমি বরাবরই ছিলাম বিজ্ঞানের ছাত্র। মিলিটারি একাডেমিতেও। আমরা যারা ফার্স্ট টার্মের ক্যাডেট, তাদেরকে দুইবার ছুটির দিনে হাইকিং ক্লাবের সদস্য হিসেবে একাডেমির পশ্চিমে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমি দিয়ে ফৌজদারহাট, পাহাড়তলী হয়ে আরো দক্ষিণে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পিকনিক ধরণের বিরাট একটা অগ্ন্যুত্সব (Bonfire) এর মধ্য দিয়ে এই ভ্রমণের সমাপ্তি হত। আমরা সবাই পরেছিলাম খাকি রঙের ডাংরি পোষাক (Dungri dress) এবং মাথায় ছিল খাকী রঙের ট্রাভেল ক্যাপ। ওয়েস্টার্ন মুভির ক্যাপগুলোর মতো। আমাদেরকে পরিচালনা করেছিলেন আমাদের টার্ম কমান্ডার মেজর ওয়াদুদ এবং প্লাটুন কমান্ডারগণ। মিলিটারি একাডেমির মত পরিবেশে এটা ছিলো বিশাল ধরণের স্বাধীনতা।

গরের বেলাভূমিতে ঘুরে বেড়ানো। এই সময়ে সাহেল আমাকে শুনিয়েছিলো শিল্পবিপ্লব পরবর্তী ইউরোপীয় সভ্যতার কথা। ১৭৮৯ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ইউরোপের ইতিহাস। শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়নের যুদ্ধ, ন্যাশনালিজম এর উন্মেষ, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, জার্মান ও অস্ট্রোহাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের উত্থান, ফ্র্যাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ, এবং পরিশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ – সবকিছুই সে অবলীলায় বলে যেতো। বিভিন্ন টাইমলাইন সহকারে। নেপোলিয়ন বোনাপার্টে, অটো ভন বিসমার্ক, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন কারো কথাই বাদ যেতো না। আমি অবাক বিস্ময়ে শুনতাম। একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে সে সন ও তারিখগুলো মনে রাখে। উত্তরে আমাকে সে বলেছিলো, “খুবই সহজ। ইতিহাসের ঘটনাগুলোর পূর্বাপর বুঝতে পারলেই সময়গুলো আপনা থেকেই মনে থাকে।“

বিশাল প্রশস্ত জলাশয়। প্রায় ৬০০ ফুট প্রশস্ত। পুরো দৈর্ঘ জুড়ে। জলাশয়ের দৈর্ঘ ৩ উত্তর-দক্ষিণ দুইদিকে প্রসারিত হয়ে পুনরায় পূবদিকে প্রবাহিত হয়েছে। উভয় দিক থেকেই। শেষে পুরো মন্দির এলাকাকে আবর্তন করেছে। অন্ধকারের ভেতরেও জল ঝিকমিক করছে। একটা পাথরের তৈরি একটা বিরাট সাঁকো দিয়ে আমরা জলাশয়টি অতিক্রম করলাম। সাঁকো পার হবার পরেই মন্দিরের পরিধি দেয়াল। চতুষ্কোণ। দুই মাইলেরও অধিক লম্বা। জলাশয় অতিক্রম করতেই একটা বিশাল প্রবেশদ্বার। মন্দিরের মতো দেখতে। এই প্রবেশদ্বার অতিক্রম করলেই বালিপাথরের বিশাল এক চত্ত্বর। একটা পাথরের প্রশস্ত রাস্তা (Causeway) চত্বরের ভেতর মন্দিরের কেন্দ্র পর্যন্ত চলে গেছে। রাস্তার দুই পাশ দিয়ে পাথরের তৈরী রেলিং। সাপের শরীরের আকৃতির। সাপের দেবী বাসুকির প্রতিমূর্তি। প্রায় ৬৫০ গজ লম্বা। এই বাসুকিকে দিয়েই সমুদ্র মন্থন করা হয়েছিলো। এই পথ ধরে সামনে এগোলেই আমরা মন্দিরের কেন্দ্রের কাছে পৌঁছাবো।

সাহেল আমাকে বললো, “মন্দিরের কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছুতে বেশ কিছুক্ষণ লাগবে। এই ফাঁকে আমি তোকে এংকর নগরী ও এংকর ওয়াট মন্দিরের ইতিহাসটা বলি। যতটা জানতে পেরেছি এখানে এসে।“ ক্লাস সেভেন থেকেই সাহেল আমাকে তুই বলে সম্বোধন করে। আমি করি ‘তুমি’। কারণ জানা নেই। হয়তোবা ওর প্রতি আমার কোনো অন্তর্গত কোনো সমীহ থেকে।

অন্ধকার তখন কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। পেছন ও দুই পাশের জলরাশিকে অতিক্রম করে আমরা মন্দিরের কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সামনে একটু দূরে মন্দিরের কেন্দ্রে বিশাল একটা স্তুপ বা টাওয়ার। ২১৩ ফুট লম্বা। এর চারকোণে চারটা টাওয়ার। কেন্দ্রের টাওয়ারের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রাকৃতির। একটার উপরে অন্যটা স্থাপিত এরকম পর পর তিনটা চতুষ্কোণ গ্যালারীর সবচেয়ে উপরের গ্যালারীতে এই পাঁচটি টাওয়ার স্থাপিত হয়েছে।

মন্দিরের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি Causewayর দুইদিকে পুনরায় দুটো বিশাল জলাশয়। ভেতরে হাজার হাজার পদ্মফুল ফুটে আছে। দূর থেকে পাঁচটা স্তুপসহ মন্দিরের কেন্দ্রকে মনে হচ্ছে আরেকটা বড় পদ্মফুল। আমরা বামদিকের জলাশয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠছে। অদ্ভুত কমলা রঙের আলোতে পদ্মফুলের অবয়ব আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে। একটু পরেই উজ্জ্বল আলোতে উদ্ভাসিত হবে।
মাত্র প্রভাত হয়েছে অরণ্যবেষ্টিত সিয়াম রিয়েপ নগরীর বুকে। কিন্তু সূর্যের আলো এখনো ছড়িয়ে পড়েনি চতুর্দিকে। শুধু লেকের ভেতরের পদ্মফুলগুলো আকাশের নক্ষত্রের মতো ঝিকমিক করছে। দূরে বৃক্ষের ভেতরে, তালগাছের মাথায় এবং আমাদের দুজনের সামনের পদ্মফুলরুপী এংকর মন্দিরের স্থানে স্থানে অন্ধকার জমে আছে। দূর থেকে দেখতে ভূতুড়ে জায়গা বলে মনে হয়। মনে হয় এই জায়গা পৃথিবীর নয়। পৃথিবীর বাইরের কোনো জগতের।

অতীত এক অদ্ভুত সময়। বিস্মৃতির আড়ালে একবার চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। সময়ের বিবর্তনে প্রাচীন পৃথিবী ক্রমে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেলেও সূর্যের প্রথম আলোর ঝলকানি অথবা বিষন্ন কোনো গোধুলী আপনাকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে সহস্র বছর পূর্বের কোনো অলৌকিক সময়ের ল্যাবিরন্থের পাশে। যেখান থেকে আপনি স্পষ্ট শুনতে পাবেন গমগম করা কোনো বিস্মৃত নগরীর মানুষের পায়ের আওয়াজ, নুপুরের ছন্দ, অথবা হাহাকার। দেয়ালের অপর পাশে!

দূর থেকে এংকরভাট মন্দিরকে মনে হয় পিরামিডের মতো দেখতে বিশালাকার পাথরের স্তুপ। যা ভূমি থেকে আকাশের দিকে উঠে গেছে। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে অন্যরকম। একটার পর একটা পাথরের টাওয়ার, আচ্ছাদিত গ্যালারী, অনেকগুলো কক্ষ, দীর্ঘ বারান্দা, বিভিন্ন উচ্চতায় একটার উপরে অন্যটা স্থাপিত ক্রমশ ক্ষুদ্র হয়ে আসা তিনটে চতুষ্কোণ উঠোন এবং অদ্ভুত সব খাঁড়া সিঁড়িপথ। সবচেয়ে উপরের বা ভেতরের উঠোনের কেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছে সেন্ট্রাল টাওয়ার। উচ্চতা প্রায় ৭০০ ফুট। অবশিষ্ট ৪টি টাওয়ার স্থাপিত হয়েছে একই উঠোনের চারকোণে। পদ্মবিলের পাশের কজ-ওয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে এই স্থান থেকে এংকরভাটকে মনে হলো আকাশের মেঘের ভেতরে ভাসমান পাঁচটা অত্যশ্চর্য গম্বুজের সমাহার। সেই মুহুর্তেই আমার ভেতরের বাস্তব পৃথিবী আর স্বপ্নের ভেতরের পার্থক্য মিলেমিশে একাকার হয়ে হয়ে গেলো।
প্রথম ও দ্বিতীয় উঠোনের পরিধির দিকে স্থাপন করা হয়েছে লম্বা আচ্ছাদিত গ্যালারী ও অনেকগুলো পাথরের স্তম্ভ। গ্যালারী আর কক্ষগুলোর ছাঁদ বিশেষভাবে এঁকেবেঁকে ভূমির সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে। অদ্ভুত স্থাপত্যশৈলী। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেই প্রথম উঠোনের গ্যালারী। গ্যালারীর দেয়ালে খোঁদাই করা হাজারো মুর্তি। একটাতে হাতির পিঠে সমাসীন রাজা। সম্ভবত রাজা সুর্যবর্মনের নিজের প্রতিমূর্তি। মন্দিরের মাথায় স্থাপিত মূর্তিটাও দেখতে তারই মতো।

মন্দিরের প্রায় প্রতিটি দেয়ালে সংস্কৃত অথবা খেমার মূদ্রালিপি। একটা দেয়ালে হিন্দু ও বৌদ্ধ পুরাণ থেকে উঠে আসা স্বর্গীয় অপ্সরাদের প্রতিমূর্তি। এতোটাই নিখুঁত আর বাস্তব যে মনেই হয় না যে এদের বয়স নয় শত বছর!

উত্তর গ্যালারীতে প্রবেশ করতেই দেয়ালের গায়ে কৃষ্ণের কয়েকটা প্রতিচিত্র দেখা গেলো। খোঁদাই করা। রিলিফ ওয়ার্ক। একটা চিত্রে কৈলাশ পর্বতে শিবের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছেন। শিবের পাশে তার স্ত্রী পার্বতী এবং পুত্র গণেশ (হাতির মাথাওয়ালা)। অন্য একটা দৃশ্যে দেবতাদের সাথে দৈত্যদের যুদ্ধ চলছে। আরো অনেকগুলো দৃশ্যপট।

পশ্চিম গ্যালারীর দেয়ালে রামায়ন ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে অঙ্কন করা হয়েছে। প্রথম দৃশ্যে রাম বিজয়ী হিসেবে রথে করে অয্যোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করছেন। তার পরের দৃশ্যে রাম ও লক্ষণ বানর দ্বারা পরিবৃত হয়ে বসে আছেন। তৃতীয় দৃশ্যে সীতা হনুমানদের সাথে আলাপচারিতায় মগ্ন। চতুর্থ দৃশ্যে রাম ও রাবণের যুদ্ধকে প্রতিবিম্বিত করা হয়েছে। বিশাল এক লঙ্কাকাণ্ড। একই গ্যালারীর অন্যদিকের দেয়ালে অঙ্কন করা হয়েছে মহাভারতে বর্ণিত কুরক্ষেত্র যুদ্ধ। দুই বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসছে কৌরব আর পান্ডবদের সৈন্যদল। পদাতিক দলের সম্মুখযাত্রার সমান্তরালে বাদ্যকারগণ সুরের মূর্ছনা তুলে তাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে চলছে তুমুল দ্বন্দ্বযুদ্ধ। চারপাশে মৃতদেহের ছড়াছড়ি। পেছন থেকে যুদ্ধের সেনাপতিগণ রথ, হস্তী অথবা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করছেন। একপাশে কৌরব বংশের বীর ভীষ্ম তীরের আঘাতে কাৎরাতে কাৎরাতে মৃত্যুবরণ করছেন। অন্যদিকে অর্জুন রাহুর বর্ম পরিধান করে কৃষ্ণের দিকে তীর নিক্ষেপ করেছেন। মৃত্যুর পর কৃষ্ণ ক্রমে রুপান্তরিত হচ্ছেন অর্জুনের সারথীতে।

দক্ষিণ গ্যালারীতে বিষ্ণু অপ্সরা পরিবৃত হয়ে বসে আছেন। এই গ্যালারীর অন্য একটা চিত্রে রাম ধনুর্বিদ্যা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন। পূর্ব গ্যালারীতে বিষ্ণু ও কৃষ্ণের কয়েকটা চিত্র। রাম ও লক্ষণের চিত্র। আরো অনেকগুলো চিত্র। এতো বছর পর খেয়াল করতে পারলাম না। অন্তর্জালের সাহায্য নেয়ার পরেও।

পূর্ব গ্যালারীর দেয়ালে পৌরাণিক কাহিনীর সমুদ্র মন্থনের প্রতিরুপ অঙ্কন করা হয়েছে। অমৃত লাভের আশায় দেবরাজ ইন্দ্র এবং দানবরাজ বলির উভয় পক্ষের নেতৃত্বে ‘ক্ষিরোদ’ সাগরে ‘মন্দার’ পর্বত সৃষ্টি করা হয়েছে। পর্বতের নীচে বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার বিশালাকৃতির এক কচ্ছপ। সব কিছুর ব্যালেন্স ধরে রাখার জন্যে। মন্থন কার্য্যে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নাগরাজ বাসকিকে। মন্থনের সময় বাসকির মাথার দিকটা ধরে আছে অসুরেরা আর লেজের দিকটা দেবতারা। এই সমুদ্র মন্থনে একে একে উঠে আসে প্রচুর ধন দৌলত, দেবী লক্ষ্মী, কালকূট বিষ এবং অমৃত। পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী দেবতা ও দানবদের মধ্যে অমৃত ভাগ করে নেয়ার কথা থাকলেও দেবতাদের প্রতারণার কারণে দানবরা অমৃতের ভাগ পায় না এবং মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কী অসাধারণ দক্ষতায় দৃশ্যপটটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা ভাবলে আমি এখনো বিস্মিত হই।
রাতের অন্ধকার সরে যেয়ে উজ্জ্বল সুর্যালোকে চারপাশ আলোকিত। পাশের গাছপালার ভেতর থেকে কয়েকটা বানর এসে পাথরের বেদীর ওপরে খেলছে। আমাদের দুজনের কাছে মনে হচ্ছে আমরা বর্তমান পৃথিবী থেকে দূর অতীতের কোনো পৃথিবীতে এসে পড়েছি। একটা খাড়া সিঁড়ি বেয়ে আমরা মন্দিরের কেন্দ্রস্থলের স্তুপে উঠার চেষ্টা করি। যতদূর সম্ভব। এখানে সূর্য ভিন্ন ধরণের আলো দিচ্ছে। ওপর থেকে আমরা নীচের দিকে তাকাই। সামনের উঠোন, পদ্মবিল, চারপাশের পর্বতরূপী প্রাচীর, মন্দির এলাকাকে ঘিরে থাকা চতুর্ভুজ আকৃতির জলাশয়কে অতিক্রম করে আমাদের দৃষ্টি দূরের অস্পষ্ট ঘন বনের ভেতরে। দুজনেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। অদ্ভুত এক প্রাচীন জগতের ভেতরে নিজেদেরকে আবিষ্কার করে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর