দেনমোহর: প্রচলিত ভুল ধারণা এবং মুসলিম আইন

মুসলিম আইনের পরিভাষায় দেনমোহর হচ্ছে বিবাহবন্ধন উপলক্ষে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নগদ অর্থ, সোনা-রুপা বা স্থাবর সম্পত্তি প্রদান করা। এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর করুণা নয়, স্ত্রীর অধিকার। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ এবং অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। বিয়ের সময় যদি দেনমোহর নির্ধারণ করা না হয় এমনকি স্ত্রী পরবর্তী সময়ে কোন দেনমোহর দাবি করবে না এ শর্তেও যদি বিয়ে হয় তাহলেও স্ত্রীকে উপযুক্ত দেনমোহর দিতে স্বামী আইনত বাধ্য।

দেনমোহর নির্ধারণ: সাধারণত দেনমোহর নির্ধারণে কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। যেমন- পাত্রীর সামাজিক অবস্থা, বংশমর্যাদা, আর্থিক অবস্থান, ব্যক্তিগত যোগ্যতা ইত্যাদি। পাত্রীর পরিবারের অন্য মহিলাদের (যেমন: ফুফু, বোন) দেনমোহরের পরিমাণের ভিত্তিতেও দেনমোহর নির্ধারিত হয়। এছাড়া পাত্রের আর্থিক সঙ্গতি, সামাজিক এবং পারিবারিক অবস্থানও দেনমোহর নির্ধারণে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। নির্ধারিত দেনমোহরের দুটি অংশ থাকে। একটি অংশ হলো তাৎক্ষণিক দেনমোহর- মোহরে মু’আজ্জাল বা নগদে প্রদেয় এবং আরেকটি অংশ হলো বিলম্বিত দেনমোহর- মোহরে মু’য়াজ্জাল বা বাকিতে প্রদেয়। আমাদের দেশে মোহরানা বাকি রেখে বিয়ে করার প্রথা বহুল প্রচলিত। দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না। তবে স্বামী নিজ উদ্যোগে তা বাড়াতে পারে। যদি কেউ আদালতে দেনমোহর দাবি করেন (বিয়ের সময় দেনমোহর নির্ধারিত না থাকলে) তবে আদালত স্ত্রীর মর্যাদা এবং স্ত্রীর পিতৃকুলের অন্যান্য মহিলার দেনমোহরের পরিপ্রেক্ষিতে দেনমোহর নির্ধারণ করতে পারেন।

স্ত্রীর মোহরানা তলব করার অধিকার: স্ত্রী দাম্পত্য জীবনের যে কোন সময় অনাদায়ী তাৎক্ষণিক দেনমোহরের দাবি জানাতে পারেন। বিলম্বিত দেনমোহরের প্রশ্ন আসে স্বামীর মৃত্যুর পর বা বিয়ে বিচ্ছেদের পর। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী দেনমোহরের টাকা পরিশোধের জন্য কোন সম্পত্তির দখল বজায় রাখতে পারেন এবং এই দখল চালিয়ে যেতে পারেন ততদিন পর্যন্ত যতদিন পর্যন্ত দেনমোহরের টাকা পরিশোধ না হয়। একজন বিধবার দখল বজায় রাখা সম্পত্তিতে তাঁর অধিকার দুই ধরণের। একটি হচ্ছে সম্পত্তি থেকে সে তাঁর  প্রাপ্য বিলম্বিত দেনমোহর আদায় করবে, অন্যটি হচ্ছে একজন উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রাপ্য হিস্যা পাবে। যদি কোনো স্ত্রী স্বামীর কাছে তাৎক্ষণিক দেনমোহর চেয়ে না পান, সেই স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে বসবাস এবং দাম্পত্য মিলনে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। এমনকি পৃথক বসবাস দাবি করতে পারেন এবং এ সময় স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন। স্বামী দেনমোহর দিতে অস্বীকার করার তিন বছরের মধ্যে স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতে দেনমোহর চেয়ে মামলা করতে হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর অপরিশোধিত অন্যান্য ঋণের মতোই দেনমোহরের ঋণ শোধ করতে হয়। দাফন-কাফনের খরচ করার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে দেনমোহরের ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

দেনমোহর নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা: দেনমোহর পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশে অনেক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। এখানে অধিকাংশ মানুষ দেনমোহর সন্তুষ্টচিত্তে পরিশোধ করতে চান না বরং এ বিষয়ে টালবাহানার আশ্রয় নেয়া হয়। অনেকে বাসর রাতেই ভালোবাসার অভিনয়ে স্ত্রীকে বিভ্রান্ত করে তাঁর কাছ থেকে দেনমোহরের দাবি মাফ করিয়ে নিতে আগ্রহী হন; সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আবেগের বশে এবং লজ্জাবশত মাফ করে দেন। অনেক স্বামী তার স্ত্রীর দেনমোহর আদায় না করা অবস্থায় মারা গেলে আত্মীয়-পড়শীরা এসে স্বামীর মৃতদেহ খাটিয়ায় উঠানোর আগে স্ত্রীর কাছে মোহরানার দাবি মাফ চাওয়ায়। মুসলিম আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, এভাবে মোহরানার দাবি স্ত্রী মাফ করে দিলেও আসলে তা মাফ হবে না। কেননা, এটা স্ত্রীর উপরে এক প্রকার বলপ্রয়োগ।

সর্বোচ্চ দেনমোহরের কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। কিন্তু দেনমোহরের পরিমাণ এত বেশি রাখা উচিত নয় যা স্বামীর পক্ষে দেয়া অসম্ভব। দেনমোহর যেহেতু স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়, সেহেতু এর পরিমাণ এত কম রাখাও উচিত নয় যা স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে বিন্দুমাত্র সহায়ক হবে না। আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করে দেনমোহর ধার্য করলে স্বামী সহজেই পরিশোধ করতে পারবেন এবং প্রাপ্য দেনমোহরের অধিকার থেকে নারীরা বঞ্চিত হবে না। অনেক স্বামী মনে করেন, স্ত্রীর ভরণ-পোষণসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করলে আর দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না। কিন্তু দেনমোহর ও ভরণপোষণ দুটি পৃথক অধিকার। বিবাহিতা নারী বিবাহকালীন এবং বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ইদ্দতকালীন সময়ে স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার  অধিকারী। অনেক স্বামী স্ত্রীকে দামী কিছু উপহার দিলে মনে করেন যে, দেনমোহর পরিশোধ হয়ে গেছে। এটিও ভ্রান্ত ধারণা। স্বামী যদি দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে কোন কিছু হস্তান্তর করে তবেই সেটি দেনমোহর হিসেবে বিবেচিত হবে। জমি হস্তান্তরের দলিলে ‘দেনমোহর বাবদ’ কথাটি লেখা না থাকলে এরূপ জমি উপহার দেয়া দেনমোহর পরিশোধ হিসেবে গণ্য হবে না; উপহার হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া মুসলিম আইনের ভাষ্য হচ্ছে- দেনমোহর এমনভাবে প্রদান করতে হবে যাতে সেটির উপর স্ত্রীর নিঃশর্ত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্ত্রী নিজ ইচ্ছামতো বিনা বাধায় তা ব্যবহার, খরচ, দান, ভোগ বা ঋণ দিতে পারে।

সমাজে প্রচলিত সবচেয়ে গুরুতর ভুল ধারণা হলো- স্ত্রী যদি নিজে তালাক নেয় (তালাক-ই-তাফইজ) তাহলে স্বামীকে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না। কিন্তু দেনমোহর সর্বাবস্থায় স্বামীর ঋণ। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদ আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, অত্র আইনে সন্নিবেশিত কোনো কিছুই কোনো বিবাহিত মহিলার বিবাহ-বিচ্ছেদের ফলে মুসলিম আইন অনুযায়ী তাঁর প্রাপ্য দেনমোহর অথবা তাঁর কোনো অংশের ওপর তাঁর অধিকারকে ক্ষুণ্ন করবে না। ওই ধারা অনুসারে প্রমাণিত হয়, যে কোনো মুসলিম নারী আদালতের মাধ্যমে তালাক নিলেও ওই নারীর দেনমোহরের অধিকার লোপ পায় না।

বিয়ে শুধুই দুটি দেহের যৌন চাহিদা পূরণের একটি দেওয়ানি চুক্তি নয়, দুটি হৃদয়েরও মিলন ঘটে এর মাধ্যমে। তাই সাধ্যের অতিরিক্ত দেনমোহর ধার্য করে হয়তো আভিজাত্য জাহির করা যেতে পারে বা স্বামীর অক্ষমতাকে পুঁজি করে বিয়ে বিচ্ছেদকে হয়তো কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু মেলবন্ধনহীন সেই দাম্পত্য সম্পর্কে হৃদয়ের উষ্ণতা কতটুকু থাকবে তাও ভাবার বিষয়- বিয়ে যেন কারো ঘাড়ে বিরাট বোঝা হয়ে না যায়!

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর