বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও স্বাধীনতাবিরোধী মুক্ত সমৃদ্ধ-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সোমবার বিজয়ের ৪৮ বর্ষপূর্তি ও ৪৯তম বিজয় দিবস উদযাপিত হয়েছে।
দেশের মানুষের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরাও এদিন বিজয় দিবসের আনন্দে মেতে ওঠে। একই সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা অকুতোভয় বীর সন্তানদের গভীর বেদনা ও পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। দেশের বাইরে বিভিন্ন দূতাবাসেও উদযাপিত হয়েছে বিজয় দিবস।
এবারের বিজয় দিবস এসেছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। আগামী ২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং এর পরের বছর ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ। আগের দিন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ‘রাজাকারের তালিকা’ প্রকাশ করায় এবারের বিজয় দিবসে বাঙালি জাতির মনে ভিন্নমাত্রার উৎসবের হাওয়া লেগেছে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালির চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভু¨দয় ঘটে।
৪৯তম বিজয় দিবস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। এ উপলক্ষে লাখো মানুষের ঢল নামে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। হাতে হাতে তাদের লাল-সবুজের পতাকা আর মুখে ছিল রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সেস্নাগান।
সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। এ সময় তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল সামরিক কায়দায় সালাম জানায়। শহীদদের স্মরণে বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে জাতির বীর সন্তানদের স্মরণ করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
এরপর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে আবারও স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শেখ হাসিনা। এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল মতিন খসরু, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান; সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও বিএম মোজাম্মেল হক; দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আফজাল হোসেন, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপদপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান, কূটনীতিকরা শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এরপর সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করার পর সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় মূল ফটক। পরে লাল-সবুজের পতাকা আর ফুল হাতে জনতার ঢল নামে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে। ফুলে ফুলে ভরে উঠতে থাকে শহীদ বেদি।
স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কারণে স্বাধীনতাকে এখনো সুসংহত করা যায়নি। রাজাকারদের উত্তরসূরিদের সঙ্গেও কোনো আপস নেই।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বলেন, আমাদের প্রত্যাশা দেশ শান্তির দিকে এগিয়ে যাবে।
সকাল ১০টায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. মঈন খান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনসহ দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। পরে মির্জা ফখরুল বলেন, যে চেতনার ভিত্তিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, যে চেতনায় দেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেই চেতনার ভিত্তিতে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রকে মুক্ত করব ইনশাল্লাহ।
শ্রদ্ধা জানানো শেষে গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, একাত্তরের অসম্ভবকে আমরা সম্ভব করেছিলাম। এখন দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পূর্বশর্ত হলো ঐক্য, জনগণের ঐক্য।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধীরা দেশটাকে দখল করে নিয়েছিল। এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।
স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতার ৪৮ বছরে আমাদের অনেক প্রাপ্তি এবং অর্জন রয়েছে। তারপরও আমাদের গণতন্ত্রকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
একে একে পর্যায়ক্রমে শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে কেন্দ্রীয় ১৪ দল, শহীদ পরিবারের সন্তান, যুক্তফ্রন্ট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, সরকারি কর্ম কমিশন, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দল, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা জেলা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেডিসি), বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, সোনালী ব্যাংক, সচেতন নাগরিক কমিটি, বিআইডবিস্নউটিসি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ঢাকা জেলা কমিটি, বাংলাদেশ পশু সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিএলআরআই), বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা চিকিৎসক পরিষদ, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, শেখ হাসিনা জাতীয় যুব কেন্দ্র, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), কর্মজীবী নারী, বাংলাদেশ তৃণমূল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব), বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), ঢাবি কর্মচারী সমিতি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনিক্যাল এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, বিমান শ্রমিক লীগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন, বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক, বঙ্গবন্ধু ফিশারিজ পরিষদ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জাতীয় বিদ্যুৎ শ্রমিক লীগ, হিউম্যান রাইটস মনিটরিং অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ ওলামা মাশায়েখ ঐক্যজোট, সাভার প্রেস ক্লাব, আশুলিয়া প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।
দিবসটি উপলক্ষে সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রং-বেরঙের পতাকায় সাজানো হয়।
শহীদদের আত্মার শান্তি, জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোয় উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়।