Demonstrators attend a protest against attacks on the students of New Delhi's Jawaharlal Nehru University (JNU), outside the Gateway of India monument in Mumbai, India, January 6, 2020. REUTERS/Francis Mascarenhas

নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ মুখোশধারীদের হামলায় দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হওয়ার পর ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। হামলার পরই রোববার মধ্যরাতে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজারও শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসেন।

বিক্ষোভ হয়েছে কলকাতা, পুনেসহ বিভিন্ন শহরেও। বিক্ষোভকারীদের দাবি ভিন্নমত দমন করতে এ হামলা চালিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) সমর্থিত অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের কর্মীরা।

বিবিসি জানিয়েছে, জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রোববার সন্ধ্যার দিকে লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে ৫০ জনেরও বেশি মুখোশধারী দুষ্কৃতি। এ সময় তারা ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষের মাথা ফাটিয়ে দেয়। হামলায় আহত হন আরও অন্তত ২০ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। তাদের গুরুতর আহত অবস্থায় অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স বা এইমস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এরইমধ্যে ঐশী ঘোষের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যাতে তাকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘দেখুন আমার ওপরে কীভাবে হামলা হয়েছে। ওদের সবার মুখ ঢাকা ছিল। দেখুন কত রক্ত পড়েছে। সাংঘাতিকভাবে মেরেছে আমাকে।’

ছাত্রছাত্রীরা বেশ কয়েক মাস ধরে হোস্টেল ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছেন। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন বয়কট করেছেন। অন্যদিকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ বা এবিভিপি সমর্থক কিছু ছাত্র বলছেন তাদের ক্লাস করতে বা পরীক্ষা বয়কট করতে আন্দোলনকারীরা কেন বাধ্য করছে?

হামলাকারীরা সবাই এ এবিভিপির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে হামলাকারীদের আনা হয়েছে বলে অভিযোগ ছাত্র ইউনিয়নের। শুধু ছাত্রছাত্রীদের নয়, তাদের হামলায় শিক্ষকরাও আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ওদিকে এবিভিপির পাল্টা অভিযোগ, বামপন্থী শিক্ষার্থীরাই তাদের ওপরে প্রথমে হামলা চালায়। একটি সংবাদ বিবৃতিতে তারা বলেছে, এসএফআই (সিপিআইএম দলের ছাত্র সংগঠন), এইএসএ (নকশালপন্থী সিপিআইএমএল লিবারেশনের ছাত্র সংগঠন) এ হামলার জন্য দায়ী।

সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মুখোশ পরা বেশ কিছু নারী-পুরুষ লাঠি হাতে এগিয়ে আসছেন। এক ছাত্রী চিৎকার করে তাদের প্রশ্ন করছেন, ‘এটা কী হচ্ছে! তোমরা কারা? মেয়েদের হোস্টেলে কেন ঢুকছ! আমাদের ভয় দেখাতে এসেছ?’ ওই ভিডিওতেই শোনা যাচ্ছে কিছু ছাত্রী স্লোগান দিচ্ছেন, ‘এবিভিপি গো ব্যাক।’ এ ভিডিওটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে মুখোশধারী হামলাকারীদের গালাগাল করতে শোনা যায়।

একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মুখোমুখি দুই পক্ষ, অন্যদিকে ছাত্ররা দিল্লি পুলিশের হেডকোয়ার্টারের সামনেও জড়ো হয় বড় সংখ্যায়। দুটি জমায়েতেই ব্যাপক সংখ্যায় অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জড়ো হন।

ছাত্রছাত্রীরা এ প্রশ্নও তুলছেন, যখন মুখোশধারী হামলাকারীরা ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন পুলিশ সেখানে হাজির ছিল। কিন্তু তারা নীরব দর্শক হয়েছিল বলেও অভিযোগ। দিল্লি পুলিশের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হামলার পরে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এসবের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের। তিনি টুইট করেছেন, ‘জেএনইউর ঘটনার ছবি দেখছি। স্পষ্ট ভাষায় এ হিংসার নিন্দা করছি। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।’ জয়শঙ্কর এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে øাতকোত্তর আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন।

রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ‘শাসনক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিবাদীরা ছাত্রদের সাহস দেখে ঘাবড়ে গেছে। আজকের হামলা তারাই প্রতিফলন।’ সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, যিনি নিজেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন একসময়, তিনি বর্তমান ছাত্র ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষের মাথা থেকে রক্ত ঝরার ভিডিওটি রি-টুইট করে লিখেছেন, ‘এ ভিডিও দেখেই বোঝা যাচ্ছে আরএসএস, বিজেপি দেশের কী অবস্থা করতে চাইছে।

কিন্তু আমরা ওদের এটা করতে দেব না।’ ছাত্রদের ওপরে হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম।

ছাত্রদের ওপরে হামলার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে ছত্তিসগড়ের রাজধানী রায়পুরে। ওই ঘটনার পরই আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মোমবাতি মিছিল বের করে নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানান। পুনের ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউট এবং কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছেন।

নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার নিন্দা জানিয়েছে জামিয়া টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনও (জেটিএ)। তাদের অভিযোগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় মুখোশধারীদের সহায়তা দিয়েছে প্রশাসন।

‘হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব’ : আনন্দবাজার জানায়, সোমবার এইমস থেকে থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সেই পরিস্থিতি বর্ণনা করেন জেএনইউর ছাত্র সংসদ সভানেত্রী ঐশী ঘোষ। একই সঙ্গে তার দাবি, হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চলবে।

ঐশী জানান, ক্যাম্পাসে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের ভিড় দেখে তারা পুলিশকে আগাম জানিয়েছিলেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। জেএনইউর ভিসি জগদেশ কুমারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছেন ঐশী। তিনি বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। ওরা বলেছিলেন, সব ঠিক আছে। আমরা ওদের সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তারপরেই এ ঘটনা ঘটে।’

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর পাল্টা কী পদক্ষেপ নেবে ছাত্র সংসদ? এ প্রশ্নের উত্তরে এসএফআই নেত্রী বলেন, ‘পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছি।’

ভারতে শিক্ষার্থীদের চেয়ে গরুর নিরাপত্তা বেশি : দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখোশধারী হামলার ঘটনায় সমালোচনার ঝড়ে ফুঁসছে গোটা ভারত। এবার এ বিষয়ে সরব হয়েছেন দেশটির রূপালী পর্দার বাসিন্দারাও।

সোমবার টুইট করে ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন বলিউড অভিনেত্রী টুইঙ্কেল খান্না। তিনি বলেন, ‘এ দেশে যেখানে মনে হয় শিক্ষার্থীদের চেয়ে গরুকে বেশি নিরাপত্তা দেয়া হয়, সেই দেশ এবার মাথানত করতে নারাজ।

হিংসা দিয়ে মানুষের কণ্ঠ রোধ আর করা যাবে না। এর জেরে দেশে আরও প্রতিবাদ, ধর্মঘট বাড়বে। মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাবে।’ শুধু টুইঙ্কেলই নন নিন্দায় সরব হয়েছেন অন্য সেলিব্রেটিরাও।

এর আগেও একাধিকবার সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে সরব হয়েছেন টুইঙ্কেল খান্না। অক্ষয় কুমারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন, ‘আমি আপনার ও আপনার স্ত্রী টুইঙ্কেলের টুইটার দেখি। মাঝে মাঝে মনে হয় আপনার পারিবারিক জীবন নিশ্চয় বেশ শান্তিপূর্ণ কারণ উনি সব রাগ আমার ওপর টুইটারে প্রকাশ করেন। ফলে এভাবে আমি আপনার কাজে আসি।’

বলিউডের খ্যাতনামা পরিচালক মহেশ ভাট বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তার নামে ভারতে নয়া ফ্যাসিবাদ এসেছে। নীরবতা ভেঙে সবার এক সুরে প্রতিবাদ করার সময় এসেছে।’ পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের ক্ষোভ, ‘ভারতের আসল ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ হল বিজেপি ও এবিভিপি। আর এই ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’র নেতা হলেন অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি। এটা পাথরে খোদাই করা হোক। এরাই দেশে বিভাজন তৈরি করছেন।’

টালিউড অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের টুইট, ‘হীরক রাজার সেনারা একের পর এক পাঠশালা আক্রমণ করে যাবে, মগজধোলাই মেশিন চলছে, চলবে… উদয়ন মাস্টার, কোথায় আপনি? আর লুকিয়ে থাকবেন না! আপনাকে, গুপি, আর বাঘাকে খুব দরকার!’

রোববার গার্লস হোস্টেলে ঢুকে তাণ্ডব চালায় মুখ ঢাকা দুষ্কৃতিরা। এতে মাথা ফেটে রক্তাক্ত হন ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ। আক্রান্ত হন এক অধ্যাপকও। হামলার অভিযোগ এবিভিপির বিরুদ্ধে, যা তারা মানতে নারাজ। তাদের পাল্টা অভিযোগ বাম ছাত্র সংগঠনের দিকে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর