হাওরে বন্যা, অন্ধকারে পাউবো

হাওরের অকাল বন্যা নিয়ে অন্ধকারে পানি উন্নয়ন বোর্ড। হাওর জেলা সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানের হাওরের ফসল গিলে খেয়েছে পানি। তারপরও পানি উন্নয়ন বোর্ড সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দিচ্ছে ভুল রিপোর্ট। তাদের কথা, ৮ দশমিক ২৫ মিটার উচ্চতা নদীর পানি প্রবাহিত হলে সেটিকে বন্যা বলা যাবে। কিন্তু হাওরে এখন ৬ দশমিক ৫ মিটার উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তাই এটিকে বন্যা বলা যাবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড যে বিপদসীমা ধরে বন্যার রিপোর্ট দিচ্ছে সেটা মৌসুমী বন্যার জন্য। মৌসুমী বন্যায় হাওর অঞ্চলে মানুষের বাড়িতে পানি উঠে যায়। তখন সব হাওর তলিয়ে থাকে। এই বন্যার খবরও কোনো কৃষক রাখে না। কিন্তু এখন যে বন্যা চলছে এটাকে প্রি-মৌসুমী বন্যা। এই বন্যায় কারো বাড়িঘর না তলালেও হাওরের সব ফসল তলিয়ে যায়। বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, সাধারণত ৬ দশমিক ৫ মিটার উচ্চতায় নদীর পানি প্রবাহিত হলে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের সব হাওরেই পানি ঢুকে পড়ে। এতে সব ফসল তলিয়ে যায়। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড যে রিপোর্ট দিচ্ছে তাতে তারা বিপদসীমা ধরছে ৮ দশমিক ২৫ মিটার। এতে কাগজে কলমে বন্যা না থাকলেও সব হাওর তলিয়ে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মৌসুমী বন্যা ও প্রি-মৌসুমী বন্যার বিপদসীমার বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, যারা বন্যার পূর্বাভাস দেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভালো বলতে পারবেন।  এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভুল রিপোর্ট তো আমরা বলতে পারি না। এটা হাই লেবেলের ব্যাপার।
বন্যা পূর্বাভাস বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার রায়হান বলেন, এখন কোনো বিপদসীমা নেই। সবগুলো নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি যতোটুকু উঠেছিল তা এখন কমা শুরু করেছে। আগামী আরো কয়েকদিন পানি কমবে। এখন পানির লেবেল অনেক নিচে নেমে গেছে। কোথাও কোনো বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, একেক এলাকার বিপদসীমা একেকটা হয়। মঙ্গলবার কানাইঘাট, সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায় পানির লেবেল রয়েছে ১১ দশমিক ৬ মিটারে। এই এলাকার বিপদসীমা হলো ১৩ দশমিক ২০ মিটার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রি-মৌসুম ও মৌসুমী বন্যার জন্য একটা ধরেই রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে। এখনো প্রি-মৌসুমী বন্যার জন্য আলাদা করে বিপদসীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে এ বিষয়ে কাজ চলছে। এখনো বিপদসীমার লেবেল একটা ধরেই আমরা রিপোর্ট করছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, একেক জায়গায় একেক রকম বিপদসীমা হয়। আমরা এখনো মৌসুমী ও প্রি-মৌসুমী বন্যার বিপদসীমা একটা ধরেই রিপোর্ট করছি। তবে শুধু প্রি-মৌসুমী বন্যার জন্য আলাদা একটা বিপদসীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। কারণ হাওর অঞ্চলের মানুষ মৌসুমী বন্যার খবরও রাখে না। এখন যে বন্যা চলছে এতে তাদের ফসল তলিয়ে যায় বলে হাওর অঞ্চলের মানুষের কাছে এই বন্যাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটা বিবেচনায় প্রি-মৌসুমী বন্যার জন্য আলাদা একটা লেবেল নির্ধারণ করতে স্ট্যাডি করছি। কারণ দেখা যায় যে, বিপদসীমায় আমরা বন্যা পূর্বাভাস দেই তার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও অনেক হাওরে পানি প্রবেশ করে ফসল তলিয়ে যায়। এতে কৃষকের বা এলাকাবাসীর কোনো উপকার হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক দিন ধরেই আমরা স্ট্যাডি করছি। একটা ভালো জিনিস না দিলে তো মানুষের উপকারে নাও আসতে পারে। এছাড়া, অফিসে স্ট্যাডিটা পাস হওয়ার একটা বিষয় রয়েছে। এমন বেশকিছু কারণে প্রি-মৌসুমী বন্যার জন্য আলাদা বিপদসীমা নির্ধারণে একটু সময় লেগে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুধু কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকাতেই এ বছরের বন্যায় তলিয়ে গেছে ২৩ হাজার ২৭০ হেক্টর জমির ফসল। ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন এই তিন উপজেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ১৭৭ হেক্টর। এর মধ্যে অষ্টগ্রাম উপজেলায় সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৯৬৫ হেক্টর, ইটনায় ৫ হাজার ৮০ হেক্টর ও মিঠামইনে ৪ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমি তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকরা বলছেন বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি। এসব উপজেলায় প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ফসলহানি হয়েছে। এসব জমিতে উৎপাদিত হতো অন্তত ৮০ লাখ মণ ধান। যার প্রাথমিক মূল্য পাঁচশ’ কোটি টাকারও বেশি। সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে দিন দিন বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। জেলায় এ বছর দুই লাখ ২৩ হাজার ৮৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৬৩৪  কোটি টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওরের এই ফসল রক্ষায় ৫৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করছে।
এছাড়া, সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলার প্রায় সবক’টি বড় হাওরের ফসল পানিতে ডুবেছে। এসব জমিতে উৎপাদিত ধানের বাজারমূল্য হতো প্রায় ৯০ কোটি টাকা।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর