রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন টিপু সুলতানের বংশধররা

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ইতিহাসে তিনি শের-ই-মহীশূর নামে পরিচিত। ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামী বলা হয় যাকে। নাম তার টিপু সুলতান।

টিপুর বাঘ (শের) হয়ে ওঠার পেছনে মূল কারণ ছিল তার অসাধারণ দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, ক্ষিপ্রতা ও কৌশলপূর্ণ রাজ্য পরিচালনা এবং সমর নৈপুণ্য।

Image result for টিপু সুলতানের ছবি

 শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতান

টিপু সুলতানের অমর সেই উক্তি -‘ভেড়া বা শিয়ালের মতো দু’শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু’দিন বেঁচে থাকাও ভালো’ এই কথা থেকেই তা অনুমান করা যায় তার সাহসী চরিত্র। বর্তমানে তারই প্রজন্ম কিনা রিকশাচালক!

আপনি হয়তো কলকাতার টালিগঞ্জে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে রিকশায় নিশ্চয় চড়েছেন। রিকশাচালক আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছেও দিয়েছে। কিন্তু কখনো কি জানতে চেয়েছেন তার বংশ পরিচয়? নিশ্চয় না! জানেন কি এক সময়কার পুরো দাক্ষিণাত্যের অধীশ্বর, যার ভয়ে কাঁপতো ব্রিটিশ সরকারও। তাকে এতোটাই সমীহ করা হতো যে, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সঙ্গে এক আসনে তাকে বসান ব্রিটিশ ইতিহাসবিদগণ। ভাবছেন কার কথা বলছি? তিনিই ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসক টিপু সুলতান। তার পিতা হায়দার আলী ছিলেন মহীশূর রাজ্যের সেনাপতি।

টিপু সুলতানের বর্তমান প্রজন্ম রিকশাচালক

তবে এক সময়কার সেই প্রতিপত্তির কোনো কিছুই তার বংশধরদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। তারা এখন কেউ রিকশা চালান। আবার কেউ অন্যের বাড়িতে কাজ করছেন জীবিকা নির্বাহের তাগিদে।

ধন ঐশ্বর্যের সুলতান এবং তার বংশধরদের ওপর সম্প্রতি করা হয়েছিল একটি তথ্যচিত্র। আধঘণ্টার সেই তথ্যচিত্রের নাম ছিল ‘টিপু সুলতান দ্য মিস্ট্রি অব হিস্ট্রি।’  সেখানে টিপু সুলতানের পরবর্তী সপ্তম উত্তসূরী আনোয়ার আলী শাহকে দেখানো হয়েছে, যিনি সংসার পরিচালনা করছেন রিকশা চালিয়ে। ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে যে রাস্তায় তিনি রিকশার প্যাডেল ঘুরান সেই রাস্তাও তার প্রোপিতামহ প্রিন্স গোলাম মোহাম্মদের নামে।

আনোয়ার আলীর বাকি ভাইয়েরাও তার মতো কেউ রিকশা চালান আবার কেউ সেলাইয়ের কাজ করেন। তারা থাকেন বস্তির খুবই নোংরা পরিবেশে। তাদের স্বপ্ন একদিন মহীশূরে যাবেন। যেখানে সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠত টিপু সুলতানের খোলা তরবারি। অথচ কলকাতাতেই ছিল টিপু সুলতানের বিশাল সম্পদ। তা দিয়ে রাজার হালেই থাকার কথা তার বংশধরদের।

Image result for টিপু সুলতানের ছবিরয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব

বর্তমানে রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব, টালিগঞ্জের ক্লাব এ সবই টিপু সুলতানের জায়গায়। যার মালিকানা এখন প্রিন্স গোলাম মোহাম্মদ ট্রাস্টের।

নামমাত্র টাকায় লিজ দেয়া আছে এসব জমি। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, টিপু সুলতানের বংশধররা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের প্রাপ্য থেকে। আবার ট্রাস্টের দাবি টাকা দিলে নয়ছয় করেন টিপু সুলতানের বংশধররা। তাছাড়া ট্রাস্টের দায়িত্ব টিপু সুলতানের সম্পদের রক্ষনাবেক্ষন করা। এছাড়াও পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গী, থিয়েটার রোড, দক্ষিণ কলকাতার বিস্তর জায়গার মালিক টিপু সুলতান। কিন্তু এসব কিছুর ভোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে তার বংশধরদের।

Image result for টিপু সুলতানের ছবিতার বংশধরদের অনেকেই মধ্যবিত্ত অবস্থায়ও দিনাতিপাত করছেন। তবে রয়্যাল শব্দটি তাদের মধ্যে আর নেই। অথচ এখনো ভারতে অনেক রাজবংশের মানুষ রাজার হালেই বসবাস করছেন। আসল কথা হলো, যারা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন তারা টিকে আছেন এখনো কোনো না কোনো ভাবে। আর যারা আপোসে যাননি তাদের গরিমাই আজ ধূলোয় মিশে গেছে।

১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরঙ্গপত্তনম নামের যুদ্ধে পরাজিত হন মহীশূরের শাসনকর্তা টিপু সুলতান। এরপর ব্রিটিশরা তাকে হত্যা করে। মৃত্যুকালে টিপু সুলতানের চার জন স্ত্রী, ১৫ জন পুত্র এবং কমপক্ষে আট জন কন্যা সন্তান ছিল।

টিপুর এক সেনাপতি মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান। পরে তার পরিবারের লোকজনকে ভেলোরের দুর্গে বন্দী করে রাখে ব্রিটিশ শাসকরা। এরপর তারা টিপু সুলতানের আরো তিনশ আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের কলকাতায় নির্বাসনে পাঠানো হয়।

Image result for টিপু সুলতানের ছবিটিপু সুলতানের জন্ম ২০ নভেম্বর ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেন। তিনি তার শৌর্যবীর্যের কারণে শের-ই-মহীশূর (মহীশূরের বাঘ) নামে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভারতের বীরপুত্র বলা হয় তাকে। তিনি বিশ্বের প্রথম রকেট আর্টিলারি এবং বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করেছিলেন। এ উক্তিটি লিখেছেন মুজাহিদীন।

টিপু সুলতানকে ডাকা হতো শের-ই-মহীশূর; উপাধিটা ইংরেজদেরই দেয়া। তার এই বাঘ (শের) হয়ে ওঠার পেছনে অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কিত ছিল। বাবার সুযোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন টিপু  সুলতান। বাবা হায়দার আলী, ১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে টিপু নামে এক ফকিরের দোয়ায় এক পুত্রসন্তান লাভ করেন এবং আনন্দচিত্তে ওই ফকিরের নামেই ছেলের নাম রাখেন টিপু। মহীশূরের স্থানীয় কানাড়ি ভাষায় ‘টিপু’ শব্দের অর্থ হলো বাঘ। হয়তো তাকে ‘শের-ই-মহীশূর’ ডাকার পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল।

ছোটবেলা থেকেই টিপু, বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। বাবা হায়দার আলীই তাকে বাঘের গল্প শোনাতেন। এরপর কিশোর বয়সে টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। বাঘ নিয়ে তার ব্যঘ্রতার শেষ ছিল না। হায়দার আলীর মৃত্যুর পর তিনি  সিংহাসনে আরোহণ করলেন। বাবার পুরনো সিংহাসনটি তার ঠিক পছন্দ হলো না। তাই তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের ফ্রেমের ওপর সোনার পাত বসিয়ে তার ওপর মণিমুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন। যাকে ‘ব্যাঘ্রাসন’ই বলা যায়।

Image result for টিপু সুলতানের ছবিকারণ আট কোণা ওই আসনটির ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বাঘের মূর্তি। আট ফুট চওড়া আসনটির রেলিংয়ের মাথায় বসানো ছিল সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরি দশটি বাঘের মাথা। আর উপরে উঠার জন্য ছিল দুইধারে রূপার তৈরি সিঁড়ি। এমনকি পুরো ব্যাঘ্রাসনটাই ছিল বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা।

টিপু সুলাতের সমস্ত পরিধেয় পোষাক ছিল হলুদ-কালো রঙে ছাপানো আর বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিল ডোরা দাগ এবং হাতলে ছিল খোদাই করা বাঘের মূর্তি। সুলতানের ব্যবহৃত রুমালও ছিল বাঘের মতো ডোরাকাটা। এমনকি রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোষাকে থাকতো বাঘের ছবি।
সৈন্যদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারেও আঁকা থাকতো বিভিন্ন আকারের বাঘের প্রতিরূপ কিংবা মূর্তি। এমনকি তিনি তার রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে, বাড়ির মালিকদেরকে বাড়ির দেয়ালে বাঘের ছবি আঁকার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তখনো তার বাঘ পোষার বাতিক যায়নি এবং রাজবাড়িতে বেশ কয়েকটি পোষা বাঘ ছিল। তার কয়েকটি আবার তার ঘরের দরজার সামনে বাঁধা থাকতো।Image result for টিপু সুলতানের ছবি

১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তার বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে টিপু ও তার বাবা মারাত্মক নাজেহাল হন এবং টিপুর রাজ্যে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় অনেক সৈন্য। এমনিতেই তিনি প্রচণ্ড ইংরেজ বিরোধী ছিলেন, তদুপরি এই পরাজয়ে তিনি আরো বেশি তেজদীপ্ত হয়ে ওঠেন।

ঘটনাক্রমে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হেক্টর মুনরোর একমাত্র পুত্র সুন্দরবনের সাগর দ্বীপে বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘ আক্রমণে নিহত হয়। এরপর ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশদের কাছে তার নিজের মানুষদের বিশ্বাস ঘাতকতায় পরাজিত এবং নিহত হন।

ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামী, শের-ই-মহীশূর- টিপু সুলতানের বীরত্বগাথা জীবনের চমকপ্রদ আরো ঘটনা জানতে চোখ রাখুন ডেইলি বাংলাদেশের পাতায়।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর