ঢাকা , শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রতি বর্ষায় বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত সংখ্যক বৃক্ষ রোপিত

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সবুজ বনভূমি একটি দেশের আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখন বর্ষাকাল। বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময়। সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতি বছর লাগানো হয় অসংখ্য বৃক্ষ। তবে বৃক্ষরোপণ নিয়ে আমাদের জ্ঞানের অভাবের দরুন এর সুফল পাচ্ছি না। বৃক্ষরোপণের আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন দ্রাবিড় সৈকত পৃথিবী পুড়ে যাচ্ছে, তাপমাত্রা সব রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় স্থাপিত হচ্ছে। এবারের গরম হয়তো মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে তার চারপাশের প্রকৃতিকে নিয়ে। কিংবা হয়তো বরাবরের মতোই অন্তত আমাদের দেশের প্রবণতা অনুযায়ী সব দায়দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কিন্তু স্বস্তি কি আদৌ আসবে? প্রকৃতিকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে না দিলে প্রকৃতি তার যথাযথ শোধ নেবে, এর বাইরে যাওয়ার কোনো পথ মানুষের প্রজ্ঞা-প্রযুক্তি এখনও আবিস্কার করতে পারেনি। তাই নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে।

প্রতি বর্ষায় বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত সংখ্যক বৃক্ষ রোপিত হচ্ছে, তবু কেন আমরা এর বিশেষ কোনো সুফল পাচ্ছি না? আমাদের বৃক্ষরোপণ পদ্ধতিই কিংবা বৃক্ষ বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবই আমাদের সুফল থেকে বঞ্চিত করছে। আমরা জানি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রাথমিক একটি উদ্যোগ হলো বৃক্ষরোপণ। আসলে কি তাই? বৃক্ষরোপণ কি আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে? পরিসংখ্যানবিদরা হয়তো অনেক রকম পরিসংখ্যান দেবেন, যেমন একটি দেশের ভূমির অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। বাংলাদেশে এর এক-তৃতীয়াংশও নেই। এখন আমরা যদি সম্মিলিত উদ্যোগে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরে তৈরি করে ফেলতে পারি, তাহলে কি আমাদের পরিবেশ ভালো হয়ে যাবে?

আমাদের বৃক্ষরোপণ বিষয়ক ধারণায় কিছু মৌলিক গলদ আছে। তাই প্রথমত আমাদের পক্ষে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়, দ্বিতীয়ত, যদি আমরা ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল নির্মাণ করতেও পারি, সেই বনই আমাদের মানুষ থেকে পশু বানিয়ে ছাড়বে। সুফল অনেক দূরের ব্যাপার, বনবৃদ্ধির কুফলই আমরা সামলাতে পারব না। এর প্রধান কারণ আমরা সাদামাটাভাবে জেনেছি বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করা যায়। আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি স্লোগান হলো ‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’। পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা গাছ লাগিয়েই পরিবেশকে একেবারে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছি।

বলতে চাই, আপনারা দয়া করে গাছ লাগানো বন্ধ করুন; যদি দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা করেন, যদি আপনার পরিবেশ নিয়ে কিছুটা মায়া-মমতা থাকে তাহলে গাছ লাগানো বন্ধ করুন। কারণ আপনারা গত আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত গাছ লাগিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও মননশীলতার যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছেন তা স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে আরও অন্তত বিশ বছর লেগে যাবে। আর যদি ক্রমাগত গাছ লাগাতে থাকেন তাহলে এই দেশটার অন্তত প্রাকৃতিক কোনো ভবিষ্যৎ নেই- এ কথা নির্দি্বধায় বলে দেওয়া যায়।

আমরা গাছ লাগানোর নামে বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ-প্রতিবেশ, পুষ্টি, বৃক্ষ-অর্থনীতি, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, পাখি-পতঙ্গসহ জমির ফসল, পুকুরের মাছ, পশু খাদ্যের শৃঙ্খলা সবকিছুতেই একটি বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। কারণ আমরা ব্যাপক হারে লাগিয়েছি মেহগনি, ইউক্যালিপ্টাস, রেইনট্রি, একাশিয়া, শিশু ইত্যাদি আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর গাছ। দ্রুত বর্ধনশীল, লাভজনক, অল্প আয়াস ও অল্প জায়গায় বেশি রোপণযোগ্য ইত্যাদি বিবিধ বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং প্ররোচনায় আমরা এসব বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অতি উর্বর মাটিকে আমরা ইউক্যালিপ্টাসের মাধ্যমে মুড়িয়ে দিয়েছি।

ইউক্যালিপ্টাস গাছ অতিমাত্রায় পানি শোষণকারী একটি গাছ যেটি কোনো কোনো এলাকার মরুকরণের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এর পাতা, এর গঠন, পাখি-পতঙ্গ, মানুষ-প্রাণিকুল কারও জন্যই বিশেষ কিছু রাখে না আমাদের পরিবেশে। ফুল-ফল তো নেই-ই, আছে কাঠ তাও আবার নিম্নমানের। অথচ উত্তরাঞ্চল আমাদের আম জাম লিচুসহ সব ফলের প্রধান জোগানদাতা। উত্তরাঞ্চলের মাটিকে অনুর্বর করে দেওয়ায় যে ষড়যন্ত্র সেটি এখনও চলমান আছে। দেশের অধিকাংশ সরকারি নার্সারিতে ব্যাপকহারে উৎপাদিত হচ্ছে এসব ক্ষতিকর গাছের চারা, যা স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ অভিযানে পরিবেশ বাঁচানোর নামে! আমাদের পরিবেশবিদরা, পরিবেশ রক্ষাকারীরা মহাউৎসাহে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন।

উত্তরাঞ্চলকে ধ্বংস করা হচ্ছে ইউক্যালিপ্টাস রোপণের মাধ্যমে, আর মধ্যাঞ্চলে ব্যাপকভাবে রোপিত হচ্ছে রাক্ষুসে বৃক্ষ রেইনট্রি। রেইনট্রি অন্তত দশ থেকে পনেরটি দেশীয় প্রজাতির জায়গা দখল করে সগর্বে বিস্তার করে তার ডালপালা। নিম্নমানের কাঠসহ ক্ষতিকর পাতা ঝরানোর মাধ্যমে রেইনট্রি ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের ফসল ও মাছের উৎপাদন। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি না। কারণ আমরা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত সার-কীটনাশক প্রয়োগ করে উৎপাদন ঠিক রাখছি, পাশাপাশি মাছের জন্যও লাগছে অতিরিক্ত খাবার, পশুখাদ্য, মানুষের পুষ্টি চাহিদা আর পাখির খাবার বা বাসস্থানের বালাই নেই। সার, কীটনাশকে ফসল ও বিভিন্ন বর্জ্যে মাছ ও মুরগি পালনের মাধ্যমে নিজেদের জন্য তৈরি করছি বিষাক্ত খাবার। আমাদের দেশে ইতিমধ্যে ক্যান্সার প্রায় মহামারি আকার ধারণ করেছে এসব বিষাক্ত খাবারের প্রতিক্রিয়ায়। অথচ রেইনট্রির বদলে দেশীয় ফলের গাছ পুরো চিত্রটাই উল্টে দিতে পারে। কিন্তু উল্টাবে না কারণ আমরা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে মেহগনির। প্রায় প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি নার্সারিতে কোটি কোটি মেহগনির চারা রোপিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকে প্রতি বছর। যদিও এই গাছগুলো সারাদেশেই সহজলভ্য কিন্তু অঞ্চলভেদে কোনো কোনো প্রজাতির রাজত্ব লক্ষ্য করা যায়। মেহগনির বিষাক্ত ফল ও পাতা আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ব্যাপকভাবে ধ্বংসের পেছনে প্রধানত দায়ী। আমরা সরল মনে বৃক্ষরোপণের উৎসাহে পরিবেশের প্রতি ভালোবাসায় এই বৃক্ষগুলো রোপণ করলেও এসব প্রজাতির বৃক্ষরোপণের পরামর্শদাতারা আমাদের মতোই সরল মনে এদের এই উর্বর ভূমিতে পুনর্বাসিত করেনি। তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশই এসব প্রজাতির নির্বাচন। বাংলাদেশের বন বিভাগের নার্সারিগুলো সাধারণত ফলের চারা উৎপাদন করে না (স্বল্প পরিমাণে ব্যতিক্রম আছে), বন বিভাগের জনপ্রিয় ধারণাগুলোর একটি হলো সামাজিক বনায়ন।

সমাজকে বন বানিয়ে দয়া করে আমাদের পশু বানাবেন না। বন বনেই থাকুক, সমাজের বন হয়ে ওঠা আর সমাজের মানুষের পশু হয়ে ওঠার খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরা বৃক্ষকে যখন শুধুই টাকা উপার্জনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে শিখি তখন আমাদের মানুষ্যত্বকে ছাপিয়ে পশুত্বই জোরালো হয়ে ওঠে। বৃক্ষ কেবলি টাকার উৎস নয়, প্রকৃতি শুধুই আমাদের স্বার্থ পূরণের উপায় নয়! কিন্তু যখনই একান্ত ব্যক্তিগত বিবেচনায় একটি কাঠের গাছ লাগানো হয় মানুষ পশুত্বের দিকে একধাপ এগিয়ে যায়। কেননা সেখানে ওই ব্যক্তির স্বার্থের বাইরে সমাজে বসবাসকারী অন্য কারও জন্য আর কিছুই থাকে না। ফলের গাছে যেমন মানুষ পশুপাখি সবার জন্য অল্প পরিমাণে হলেও খাদ্য, আশ্রয়, বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকে; কাঠের গাছের চরিত্র এর বিপরীত। মানুষকে পশু বানানোর একটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে সামাজিক বনায়ন এবং সর্বত্র কাঠের গাছ রোপণের মাধ্যমে।

আমাদের অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনাহীন বৃক্ষপ্রেম পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত দায়ী। সরকারি মহল থেকে এর সরাসরি উৎসাহ জোগানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভালো বিবেচনায় এসব প্ররোচনায় এক প্রকার ফাঁদেই পা দিচ্ছে, বলা যায়। সরকারি সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোতে কথা বলে জেনেছি, এদেরও বিশেষ কোনো ভাবনা নেই এসব বিষয়ে। অনেকটাই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন। প্রতিটি বৃক্ষের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আছে। যার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট বাস্তুসংস্থানের সম্পর্ককে বিবেচনায় না নিলে উপকারের বদলে সেটি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে এর ভয়াবহ প্রভাব আমরা নানাভাবেই দেখতে পাই। প্রতি বছর ঝড়ের কবলে পড়ে হাজার হাজার পাখি মারা যাচ্ছে, কারণ এসব বৃক্ষ পাখির আশ্রয় হিসেবে উপযোগী নয়, আমাদের ৪৭ শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কারণ মূল খাবারের সঙ্গে দেশীয় ফলের জোগান পর্যাপ্ত নয়, দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি ফল আমদানির মাধ্যমে দেশের একটি বিরাট আকারের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত পশুখাদ্যের অভাবও পূরণ করতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। নিজেদের গাছের ফল আত্মীয়-প্রতিবেশীকে দেওয়ার মাধ্যমে যে হৃদয়তার সংস্কৃতি ছিল, তাও বিলুপ্তির পথে শুধু কাঠের গাছ রোপণের ব্যাপকতার মাধ্যমে। এভাবে মেহগনি-ইউক্যালিপ্টাস-রেইনট্রি-শিশু-একাশিয়া রোপণের মাধ্যমে শুধু পরিবেশ নয়, আমরা সারাদেশের বাস্তু-ভবিষ্যৎ, অর্থ-পুষ্টি, মনন-মায়া সব কিছু ধ্বংসের আয়োজনে অতি উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে চলেছি। তাই আবারও বলছি, আপনারা দয়া করে বৃক্ষরোপণ বন্ধ করুন। নিজ হাতে দেশের ক্ষতি করবেন না।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

প্রতি বর্ষায় বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত সংখ্যক বৃক্ষ রোপিত

আপডেট টাইম : ০৭:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ জুলাই ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সবুজ বনভূমি একটি দেশের আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখন বর্ষাকাল। বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময়। সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতি বছর লাগানো হয় অসংখ্য বৃক্ষ। তবে বৃক্ষরোপণ নিয়ে আমাদের জ্ঞানের অভাবের দরুন এর সুফল পাচ্ছি না। বৃক্ষরোপণের আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন দ্রাবিড় সৈকত পৃথিবী পুড়ে যাচ্ছে, তাপমাত্রা সব রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় স্থাপিত হচ্ছে। এবারের গরম হয়তো মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে তার চারপাশের প্রকৃতিকে নিয়ে। কিংবা হয়তো বরাবরের মতোই অন্তত আমাদের দেশের প্রবণতা অনুযায়ী সব দায়দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কিন্তু স্বস্তি কি আদৌ আসবে? প্রকৃতিকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে না দিলে প্রকৃতি তার যথাযথ শোধ নেবে, এর বাইরে যাওয়ার কোনো পথ মানুষের প্রজ্ঞা-প্রযুক্তি এখনও আবিস্কার করতে পারেনি। তাই নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে।

প্রতি বর্ষায় বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত সংখ্যক বৃক্ষ রোপিত হচ্ছে, তবু কেন আমরা এর বিশেষ কোনো সুফল পাচ্ছি না? আমাদের বৃক্ষরোপণ পদ্ধতিই কিংবা বৃক্ষ বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবই আমাদের সুফল থেকে বঞ্চিত করছে। আমরা জানি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রাথমিক একটি উদ্যোগ হলো বৃক্ষরোপণ। আসলে কি তাই? বৃক্ষরোপণ কি আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে? পরিসংখ্যানবিদরা হয়তো অনেক রকম পরিসংখ্যান দেবেন, যেমন একটি দেশের ভূমির অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। বাংলাদেশে এর এক-তৃতীয়াংশও নেই। এখন আমরা যদি সম্মিলিত উদ্যোগে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরে তৈরি করে ফেলতে পারি, তাহলে কি আমাদের পরিবেশ ভালো হয়ে যাবে?

আমাদের বৃক্ষরোপণ বিষয়ক ধারণায় কিছু মৌলিক গলদ আছে। তাই প্রথমত আমাদের পক্ষে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়, দ্বিতীয়ত, যদি আমরা ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল নির্মাণ করতেও পারি, সেই বনই আমাদের মানুষ থেকে পশু বানিয়ে ছাড়বে। সুফল অনেক দূরের ব্যাপার, বনবৃদ্ধির কুফলই আমরা সামলাতে পারব না। এর প্রধান কারণ আমরা সাদামাটাভাবে জেনেছি বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করা যায়। আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি স্লোগান হলো ‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’। পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা গাছ লাগিয়েই পরিবেশকে একেবারে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছি।

বলতে চাই, আপনারা দয়া করে গাছ লাগানো বন্ধ করুন; যদি দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা করেন, যদি আপনার পরিবেশ নিয়ে কিছুটা মায়া-মমতা থাকে তাহলে গাছ লাগানো বন্ধ করুন। কারণ আপনারা গত আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত গাছ লাগিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও মননশীলতার যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছেন তা স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে আরও অন্তত বিশ বছর লেগে যাবে। আর যদি ক্রমাগত গাছ লাগাতে থাকেন তাহলে এই দেশটার অন্তত প্রাকৃতিক কোনো ভবিষ্যৎ নেই- এ কথা নির্দি্বধায় বলে দেওয়া যায়।

আমরা গাছ লাগানোর নামে বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ-প্রতিবেশ, পুষ্টি, বৃক্ষ-অর্থনীতি, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, পাখি-পতঙ্গসহ জমির ফসল, পুকুরের মাছ, পশু খাদ্যের শৃঙ্খলা সবকিছুতেই একটি বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। কারণ আমরা ব্যাপক হারে লাগিয়েছি মেহগনি, ইউক্যালিপ্টাস, রেইনট্রি, একাশিয়া, শিশু ইত্যাদি আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর গাছ। দ্রুত বর্ধনশীল, লাভজনক, অল্প আয়াস ও অল্প জায়গায় বেশি রোপণযোগ্য ইত্যাদি বিবিধ বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং প্ররোচনায় আমরা এসব বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অতি উর্বর মাটিকে আমরা ইউক্যালিপ্টাসের মাধ্যমে মুড়িয়ে দিয়েছি।

ইউক্যালিপ্টাস গাছ অতিমাত্রায় পানি শোষণকারী একটি গাছ যেটি কোনো কোনো এলাকার মরুকরণের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এর পাতা, এর গঠন, পাখি-পতঙ্গ, মানুষ-প্রাণিকুল কারও জন্যই বিশেষ কিছু রাখে না আমাদের পরিবেশে। ফুল-ফল তো নেই-ই, আছে কাঠ তাও আবার নিম্নমানের। অথচ উত্তরাঞ্চল আমাদের আম জাম লিচুসহ সব ফলের প্রধান জোগানদাতা। উত্তরাঞ্চলের মাটিকে অনুর্বর করে দেওয়ায় যে ষড়যন্ত্র সেটি এখনও চলমান আছে। দেশের অধিকাংশ সরকারি নার্সারিতে ব্যাপকহারে উৎপাদিত হচ্ছে এসব ক্ষতিকর গাছের চারা, যা স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ অভিযানে পরিবেশ বাঁচানোর নামে! আমাদের পরিবেশবিদরা, পরিবেশ রক্ষাকারীরা মহাউৎসাহে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন।

উত্তরাঞ্চলকে ধ্বংস করা হচ্ছে ইউক্যালিপ্টাস রোপণের মাধ্যমে, আর মধ্যাঞ্চলে ব্যাপকভাবে রোপিত হচ্ছে রাক্ষুসে বৃক্ষ রেইনট্রি। রেইনট্রি অন্তত দশ থেকে পনেরটি দেশীয় প্রজাতির জায়গা দখল করে সগর্বে বিস্তার করে তার ডালপালা। নিম্নমানের কাঠসহ ক্ষতিকর পাতা ঝরানোর মাধ্যমে রেইনট্রি ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের ফসল ও মাছের উৎপাদন। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি না। কারণ আমরা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত সার-কীটনাশক প্রয়োগ করে উৎপাদন ঠিক রাখছি, পাশাপাশি মাছের জন্যও লাগছে অতিরিক্ত খাবার, পশুখাদ্য, মানুষের পুষ্টি চাহিদা আর পাখির খাবার বা বাসস্থানের বালাই নেই। সার, কীটনাশকে ফসল ও বিভিন্ন বর্জ্যে মাছ ও মুরগি পালনের মাধ্যমে নিজেদের জন্য তৈরি করছি বিষাক্ত খাবার। আমাদের দেশে ইতিমধ্যে ক্যান্সার প্রায় মহামারি আকার ধারণ করেছে এসব বিষাক্ত খাবারের প্রতিক্রিয়ায়। অথচ রেইনট্রির বদলে দেশীয় ফলের গাছ পুরো চিত্রটাই উল্টে দিতে পারে। কিন্তু উল্টাবে না কারণ আমরা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে মেহগনির। প্রায় প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি নার্সারিতে কোটি কোটি মেহগনির চারা রোপিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকে প্রতি বছর। যদিও এই গাছগুলো সারাদেশেই সহজলভ্য কিন্তু অঞ্চলভেদে কোনো কোনো প্রজাতির রাজত্ব লক্ষ্য করা যায়। মেহগনির বিষাক্ত ফল ও পাতা আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ব্যাপকভাবে ধ্বংসের পেছনে প্রধানত দায়ী। আমরা সরল মনে বৃক্ষরোপণের উৎসাহে পরিবেশের প্রতি ভালোবাসায় এই বৃক্ষগুলো রোপণ করলেও এসব প্রজাতির বৃক্ষরোপণের পরামর্শদাতারা আমাদের মতোই সরল মনে এদের এই উর্বর ভূমিতে পুনর্বাসিত করেনি। তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশই এসব প্রজাতির নির্বাচন। বাংলাদেশের বন বিভাগের নার্সারিগুলো সাধারণত ফলের চারা উৎপাদন করে না (স্বল্প পরিমাণে ব্যতিক্রম আছে), বন বিভাগের জনপ্রিয় ধারণাগুলোর একটি হলো সামাজিক বনায়ন।

সমাজকে বন বানিয়ে দয়া করে আমাদের পশু বানাবেন না। বন বনেই থাকুক, সমাজের বন হয়ে ওঠা আর সমাজের মানুষের পশু হয়ে ওঠার খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরা বৃক্ষকে যখন শুধুই টাকা উপার্জনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে শিখি তখন আমাদের মানুষ্যত্বকে ছাপিয়ে পশুত্বই জোরালো হয়ে ওঠে। বৃক্ষ কেবলি টাকার উৎস নয়, প্রকৃতি শুধুই আমাদের স্বার্থ পূরণের উপায় নয়! কিন্তু যখনই একান্ত ব্যক্তিগত বিবেচনায় একটি কাঠের গাছ লাগানো হয় মানুষ পশুত্বের দিকে একধাপ এগিয়ে যায়। কেননা সেখানে ওই ব্যক্তির স্বার্থের বাইরে সমাজে বসবাসকারী অন্য কারও জন্য আর কিছুই থাকে না। ফলের গাছে যেমন মানুষ পশুপাখি সবার জন্য অল্প পরিমাণে হলেও খাদ্য, আশ্রয়, বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকে; কাঠের গাছের চরিত্র এর বিপরীত। মানুষকে পশু বানানোর একটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে সামাজিক বনায়ন এবং সর্বত্র কাঠের গাছ রোপণের মাধ্যমে।

আমাদের অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনাহীন বৃক্ষপ্রেম পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত দায়ী। সরকারি মহল থেকে এর সরাসরি উৎসাহ জোগানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভালো বিবেচনায় এসব প্ররোচনায় এক প্রকার ফাঁদেই পা দিচ্ছে, বলা যায়। সরকারি সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোতে কথা বলে জেনেছি, এদেরও বিশেষ কোনো ভাবনা নেই এসব বিষয়ে। অনেকটাই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন। প্রতিটি বৃক্ষের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আছে। যার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট বাস্তুসংস্থানের সম্পর্ককে বিবেচনায় না নিলে উপকারের বদলে সেটি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে এর ভয়াবহ প্রভাব আমরা নানাভাবেই দেখতে পাই। প্রতি বছর ঝড়ের কবলে পড়ে হাজার হাজার পাখি মারা যাচ্ছে, কারণ এসব বৃক্ষ পাখির আশ্রয় হিসেবে উপযোগী নয়, আমাদের ৪৭ শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কারণ মূল খাবারের সঙ্গে দেশীয় ফলের জোগান পর্যাপ্ত নয়, দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশি ফল আমদানির মাধ্যমে দেশের একটি বিরাট আকারের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত পশুখাদ্যের অভাবও পূরণ করতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। নিজেদের গাছের ফল আত্মীয়-প্রতিবেশীকে দেওয়ার মাধ্যমে যে হৃদয়তার সংস্কৃতি ছিল, তাও বিলুপ্তির পথে শুধু কাঠের গাছ রোপণের ব্যাপকতার মাধ্যমে। এভাবে মেহগনি-ইউক্যালিপ্টাস-রেইনট্রি-শিশু-একাশিয়া রোপণের মাধ্যমে শুধু পরিবেশ নয়, আমরা সারাদেশের বাস্তু-ভবিষ্যৎ, অর্থ-পুষ্টি, মনন-মায়া সব কিছু ধ্বংসের আয়োজনে অতি উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে চলেছি। তাই আবারও বলছি, আপনারা দয়া করে বৃক্ষরোপণ বন্ধ করুন। নিজ হাতে দেশের ক্ষতি করবেন না।