রাজধানীর পূর্ব রামপুরার তিতাস রোডের মাথায় বনশ্রী আবাসিক এলাকার বি-ব্লক ৬-৭ নম্বর রোডে প্রায় একশ গজের মধ্যেই আছে তিনটি মাদ্রাসা। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩৩ গজের মধ্যে গড়ে উঠছে একটি মাদ্রাসা। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর কোনো কোনো মাদ্রাসা আবাসিক ভবনের এক-দুই কক্ষবিশিষ্ট, কোনোটি একটি ফ্লোরজুড়ে, কোনোটি আবার পুরো ভবন নিয়ে গড়ে উঠেছে। এমনকি কোনোটি গ্যারেজের জায়গায় টুল-টেবিল বসিয়ে পড়ানো হয় কোমলমতি শিশুদের। আবাসিক, অনাবাসিক, ডে-কেয়ার, ক্যাডেট, ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল, আরবি, বাংলা, ইংরেজি, নূরানি, হিফজ, ইত্যাদি নামে চলছে মাদ্রাসাগুলো। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশে গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠছে মাদ্রাসা। এভাবে মাদ্রাসা বাড়ার পাশাপাশি এর শিক্ষার্থীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে কমছে স্কুলের শিক্ষার্থী।
সম্প্রতি সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) এক তথ্যে জানা গেছে, দেশের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যার কমছে এবং মাদ্রাসায় বাড়ছে। তবে এই মাদ্রাসা বলতে সরকার নিবন্ধিত আলিয়া মাদ্রাসাকেই বোঝানো হচ্ছে, যত্রতত্র গড়ে ওঠা কওমি মাদ্রাসা নয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কওমি মাদ্রাসাকে ব্যানবেইসের জরিপের আওতায় আনলে প্রকৃত চিত্র আরও স্পষ্ট হতো। শিক্ষাবিদদের মতে, করোনা মহামারীকালে অনেক মানুষের আর্থিক অসঙ্গতি এবং পরবর্তীকালে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে শিক্ষাব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে কম ব্যয়ের মাদ্রাসার দিকে ঝুঁকছেন অনেক অভিভাবক। তাদের মতে, সাধারণ শিক্ষায় অতিরিক্ত ব্যয়, মাদ্রাসায় কম ব্যয়ে কিংবা বিনামূলে থাকা-খাওয়ার সুযোগ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবারগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি এবং করোনা মহামারীকালে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় স্থানান্তরের পর আর ফিরে না আসা- এই চার কারণে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ছে। তারা জানান, কওমি ও আলিয়া উভয় ধরনের মাদ্রাসাতেই শিক্ষাব্যয় কম। সরকারের এমপিওভুক্ত অনেক আলিয়া মাদ্রাসাতেই বেতন ও ফি নেওয়া হয় না।
দেশে সাধারণত আলিয়া ও কওমি- এ দুই ধারার মাদ্রাসা রয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসা হচ্ছে সরকারের মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর কওমি মাদ্রাসা হচ্ছে একাধিক কওমি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কওমি মাদ্রাসার রয়েছে বিভিন্ন ধরন; যেমন- নূরানি, হিফজ, ফোরকানিয়া ইত্যাদি। তবে কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় কোনো বোর্ডের অনুমোদন বা নিবন্ধন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে যে কেউ যে কোনো স্থানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এ অবস্থায় সারাদেশে একের পর এক কওমি ধারার মাদ্রাসা গড়ে উঠলেও মোট কত ধরনের এবং কতটি মাদ্রাসা আছে- এর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। মূলত বাসাবাড়িতে কওমি ধারার মাদ্রাসা গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে, যা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। আরেক দিকে, আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম তিনটি স্তর হচ্ছে এবতেদায়ি (প্রাথমিক), দাখিল (মাধ্যমিক) ও আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক)।
ব্যানবেইসের সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৩’ শীর্ষক এক খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার বছরের ব্যবধানে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে। এর বিপরীতে শিক্ষার্থী বেড়েছে মাদ্রাসা, কারিগরি ও ইংরেজি মাধ্যমে। এতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৯২ লাখ ৩ হাজার ৪২৭ জন। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৮ জন। এই চার বছরে আলিয়া ধারার দাখিল ও আলিম মাদ্রাসায় আড়াই লাখের বেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে। বর্তমানে আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থী ২৭ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি।
মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী কেন বেড়েছে- এর পেছনের কারণ হিসেবে আলোচনায় আসছে সাধারণ ধারার শিক্ষাব্যয় বেশি হওয়ার কারণটি। এর তুলনায় মাদ্রাসা শিক্ষা অনেকটাই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। ফলে আর্থিক কারণে অনেক অভিভাবক সন্তানদের মাদ্রাসায় দেন। এ ছাড়া আবার সমাজে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত এবং ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে আগের চেয়ে বেশি।
স্কুলে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, করোনার সময়ে আমরা প্রতিবেদনে চারটি শঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে, বাল্যবিবাহ বাড়বে, শিশুশ্রম ও অপুষ্টি বাড়বে। এই চারটি আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো অধিকাংশই লিল্লাহ বোডিং। শিক্ষার্থীরা প্রায় বিনামূল্যে পড়তে পাচ্ছে। যার কারণে অভিভাবকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। যেখানে সাধারণ শিক্ষায় ৭১ শতাংশ ব্যয় অভিভাবকদের বহন করতে হয়। এ কারণে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে, সেই সঙ্গে স্কুল-কলেজ থেকে ঝরে পড়ছে।
গত ৩ মার্চ ঢাকায় ডিসি সম্মেলনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় কার্য অধিবেশনে ‘অনিবন্ধিত মাদ্রাসার বিষয়টি উঠে এসেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো যত্রতত্রভাবে হওয়ার কারণে সরকারের যে প্রাথমিক শিক্ষা, সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও উপস্থিতির কমতি দেখা যাচ্ছে।’
ডিসিদের সঙ্গে আলোচনার পর সাংবাদিকদের শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানিয়েছেন, ‘অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার বাড়বে, সরকারের শিক্ষাক্রম অনুসারে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমবে সেটি কখনো কাক্সিক্ষত নয়। এ বিষয়ে আমরা মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করব। বেফাক (কওমি বোর্ড) কীভাবে তাদের ছয়টি বোর্ডের মাধ্যমে নিবন্ধন দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে।’
করোনা সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে দীর্ঘ ১৮ মাস পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। এ কারণে সাধারণ শিক্ষায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো প্রতিবেদনটি না দেখে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। তবে মোটা দাগে বলা যায়, করোনার কারণে অনেক পরিবারে আর্থিক দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এটাও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া সামাজিক নানা প্রেক্ষাপট তো রয়েছেই।
সামাজিক পরিবর্তনের কারণে অনেক পরিবারে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ বাড়ায় তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করাচ্ছেন বলে জানান যাত্রাবাড়ী মুহামিন হাফিজিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মতিউর রহমান। তিনি বলেন, সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া আমাদের সবার কর্তব্য। নৈতিক শিক্ষার অভাব সর্বত্র। মাদ্রাসার চাহিদা থাকায় নতুন নতুন মাদ্রাসা হচ্ছে। তিনি বলেন, মাদ্রাসা বাড়ছে- এটা সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে কতটা মানসম্মত শিক্ষা দিচ্ছে? ক্যাডেট, ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল, আরবি, বাংলা, ইংরেজি এগুলোয় কী শেখাচ্ছে- এগুলো সরকারকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাহমিনা আক্তার বলেন, মূলত দুটি কারণে অভিভাবক তার সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়াতে আগ্রহী হন। একটি ধর্মীয় চিন্তা, অন্যটি আর্থিক অসঙ্গতি। করোনার ফলে অনেক অভিভাবকের আর্থিক টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এটাও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার অন্যতম কারণ। সারাদেশে পাড়া-মহল্লায় যতযত্র গড়ে উঠছে মাদ্রাসা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে- এগুলোর দেখভাল করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে দক্ষ তৈরি করা।