ঢাকা , রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মহান শিক্ষা দিবস আজ। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলন হয়। শিক্ষার অধিকার আদায়ে ওই দিন ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেটে জীবন দিতে হয়েছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতাদের।

সামরিক শাসক আয়ুব খানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল।  শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় অপ্রসাঙ্গিক ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা সংকোচন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছরে বছরে পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধি প্রস্তাবনা অন্যতম। এগুলো বাতিলের দাবিতে ৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। সেই ধর্মঘট পালনকালেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। পরে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করে আয়ুব খান।

শিক্ষা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে পৃথিবীর দেশে দেশে গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা পত্রের ২৬ ধারায় নাগরিকের জন্য শিক্ষা লাভের অধিকার ঘোষণা করে।  অন্তত প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে সহজলভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সবার জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে। এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণের পর জাতিসংঘ সকল সদস্য রাষ্ট্রকে ঘোষণা পত্রের বিষয়বস্তু প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানায়।

সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সবারই দায়িত্ব বর্তায় এগুলোর বাস্তবায়ন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে সেটা কার্যকর হয়নি। বরং ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান প্রথমেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বাংলা ভাষা ধ্বংসের চক্রান্ত করে ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে উর্দুর কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের হামলায় সাতজন বামপন্থি রাজনীতিবিদ নিহত হন, আহত হন ৩২ জন।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে গুলি করে হত্যা করা হয় সালাম, বরকত, রফিক, সফিক ও জব্বারকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ৯২ এর ‘ক’ ধারা জারির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়।

স্বাধীন পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের আগ পর্যন্ত একটি সংবিধান পর্যন্ত প্রণয়ন সম্ভব হয়নি বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থবিরোধী নানা কালাকানুন জারি করতে থাকে পাকিস্তানের শাসকেরা। শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিকশিত মানবতার পরিবর্তে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এ সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন এবং রাজনৈতিক মহলে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত।

১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও পাকিস্তানে বৃটিশদের মতোই পুঁজিবাদী তথা ধনিক-বণিক নির্ভর লুটেরা অর্থনীতির পথ অনুসরণ করে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রগতিশীলতা অবরুদ্ধ হয়, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে ধ্বংসের চক্রান্ত হয়। সব মিলে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সামরিক শাসন বলবৎ থাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল মিটিং বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্র নেতাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

শিক্ষা কী, কেন ও কীভাবে এটা দেওয়া যায়, সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভোগবাদী সমাজে মুনাফাভিত্তিক ও পুঁজিবাদী সমাজে যেভাবে সব কিছুকে পণ্য ভাবা হচ্ছে এবং টাকা দিলে পণ্যের মতো সবই পাওয়া যায় এমন প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চললেও শিক্ষাকে এখনো অধিকাংশ দেশেই সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি আছে। সেই বিবেচনায় শিক্ষার দর্শন নির্ধারিত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার কথা নয়। এ জন্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের বিষয়েও ভাবনার উন্নতি হওয়া দরকার। ব্যক্তির দেহ ও মনের সকল ক্ষমতা বিকশিত, বিবর্তিত মার্জিত করে, তাকে বর্তমান ও ভবিষতের জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলার ব্যবস্থাদির নাম যদি শিক্ষা হয়, তাহলে মানবতাবাদী এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা এমন হবে, যেখানে সবার জন্য একই ধরনের অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা হওয়া দরকার।

পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি আর অর্থনীতিতে এগিয়েছে, তাদের শিক্ষার ইতিহাস এমনটাই। শিক্ষার দর্শন হিসেবে ভাববাদ, যুক্তি, দর্শন সর্বশেষে বিজ্ঞানই অন্যতম মাধ্যম। এই ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যুগের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে কি? ১৮৩৫ সালে বৃটিশ শাষিত ভারতবর্ষে লর্ড মেকলেকে দিয়ে সেই শিক্ষানীতি দেওয়া হয়েছিল, যা অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ও হিসাব নিকাশ করার মতো একটি জাতি সৃষ্টি ছাড়া সৃজনশীল ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী বা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো চেতনাবোধ ওই শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়নি। ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সংবিধান (১৯৫৯) গৃহীত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আলোকে এবং সংবিধানের ১৭ এর খ ধারার আলোকে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় বাজেটে জিডিপির প্রাথমিকভাবে ৫ শতাংশ এবং পর্যায়ক্রমে ইউনেস্কোকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু একবারে ৩৫ হাজার ১৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আবার সাম্প্রাদায়িক করা হয়েছিল, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে।

সংবিধানে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। শিক্ষায় অর্থায়ন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভূত বেসরকারি এমপিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি বাদে সবগুলোতে দলীয়করণের ভূত চেপে বসেছে। ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার লোক অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ফলে শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

সৃজনশীল আর এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এ প্লাস আর গোল্ডেনের সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে নূন্যতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারে না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মতো। যার টাকা আছে সেই সেটা কিনতে পারবে। এটি জীবন দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক, তবে এটাই এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে।

২০১০ সালে বর্তমান সরকার একটি শিক্ষানীতি দিয়েছিল, যেখানে শিক্ষার দর্শনে মুক্তিযদ্ধের চেতনা ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিধান যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, সেই সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রেই কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি বরং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির ক্ষমতাশীল আমলে শিক্ষা কারিকুলামে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়েছে। আগে-পিছের শিক্ষার একাডেমিক ও কারিকুলামগত স্বীকৃতি না থাকলেও কওমি মাদ্রাসার শেষ পর্যায়ের কোর্সকে শেষ পর্যায়ের শিক্ষাকে মাস্টাসের মর্যাদা শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে হ য ব র ল সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই শিক্ষাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। বিজ্ঞান যুক্তি আধুনিক সমাজে শিক্ষার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত মানবিকতা, সৃজনশীলতা, যৌক্তিকতা ও উৎপাদনশীল।

লেকক : অধ্যক্ষ, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা

আপডেট টাইম : ১০:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মহান শিক্ষা দিবস আজ। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলন হয়। শিক্ষার অধিকার আদায়ে ওই দিন ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেটে জীবন দিতে হয়েছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতাদের।

সামরিক শাসক আয়ুব খানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল।  শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় অপ্রসাঙ্গিক ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা সংকোচন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছরে বছরে পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধি প্রস্তাবনা অন্যতম। এগুলো বাতিলের দাবিতে ৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। সেই ধর্মঘট পালনকালেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। পরে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করে আয়ুব খান।

শিক্ষা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে পৃথিবীর দেশে দেশে গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা পত্রের ২৬ ধারায় নাগরিকের জন্য শিক্ষা লাভের অধিকার ঘোষণা করে।  অন্তত প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে সহজলভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সবার জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে। এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণের পর জাতিসংঘ সকল সদস্য রাষ্ট্রকে ঘোষণা পত্রের বিষয়বস্তু প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানায়।

সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সবারই দায়িত্ব বর্তায় এগুলোর বাস্তবায়ন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে সেটা কার্যকর হয়নি। বরং ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান প্রথমেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বাংলা ভাষা ধ্বংসের চক্রান্ত করে ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে উর্দুর কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের হামলায় সাতজন বামপন্থি রাজনীতিবিদ নিহত হন, আহত হন ৩২ জন।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে গুলি করে হত্যা করা হয় সালাম, বরকত, রফিক, সফিক ও জব্বারকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ৯২ এর ‘ক’ ধারা জারির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়।

স্বাধীন পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের আগ পর্যন্ত একটি সংবিধান পর্যন্ত প্রণয়ন সম্ভব হয়নি বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থবিরোধী নানা কালাকানুন জারি করতে থাকে পাকিস্তানের শাসকেরা। শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিকশিত মানবতার পরিবর্তে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এ সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন এবং রাজনৈতিক মহলে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত।

১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও পাকিস্তানে বৃটিশদের মতোই পুঁজিবাদী তথা ধনিক-বণিক নির্ভর লুটেরা অর্থনীতির পথ অনুসরণ করে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রগতিশীলতা অবরুদ্ধ হয়, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে ধ্বংসের চক্রান্ত হয়। সব মিলে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সামরিক শাসন বলবৎ থাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল মিটিং বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্র নেতাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

শিক্ষা কী, কেন ও কীভাবে এটা দেওয়া যায়, সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভোগবাদী সমাজে মুনাফাভিত্তিক ও পুঁজিবাদী সমাজে যেভাবে সব কিছুকে পণ্য ভাবা হচ্ছে এবং টাকা দিলে পণ্যের মতো সবই পাওয়া যায় এমন প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চললেও শিক্ষাকে এখনো অধিকাংশ দেশেই সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি আছে। সেই বিবেচনায় শিক্ষার দর্শন নির্ধারিত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার কথা নয়। এ জন্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের বিষয়েও ভাবনার উন্নতি হওয়া দরকার। ব্যক্তির দেহ ও মনের সকল ক্ষমতা বিকশিত, বিবর্তিত মার্জিত করে, তাকে বর্তমান ও ভবিষতের জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলার ব্যবস্থাদির নাম যদি শিক্ষা হয়, তাহলে মানবতাবাদী এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা এমন হবে, যেখানে সবার জন্য একই ধরনের অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা হওয়া দরকার।

পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি আর অর্থনীতিতে এগিয়েছে, তাদের শিক্ষার ইতিহাস এমনটাই। শিক্ষার দর্শন হিসেবে ভাববাদ, যুক্তি, দর্শন সর্বশেষে বিজ্ঞানই অন্যতম মাধ্যম। এই ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যুগের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে কি? ১৮৩৫ সালে বৃটিশ শাষিত ভারতবর্ষে লর্ড মেকলেকে দিয়ে সেই শিক্ষানীতি দেওয়া হয়েছিল, যা অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ও হিসাব নিকাশ করার মতো একটি জাতি সৃষ্টি ছাড়া সৃজনশীল ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী বা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো চেতনাবোধ ওই শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়নি। ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সংবিধান (১৯৫৯) গৃহীত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আলোকে এবং সংবিধানের ১৭ এর খ ধারার আলোকে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় বাজেটে জিডিপির প্রাথমিকভাবে ৫ শতাংশ এবং পর্যায়ক্রমে ইউনেস্কোকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু একবারে ৩৫ হাজার ১৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আবার সাম্প্রাদায়িক করা হয়েছিল, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে।

সংবিধানে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। শিক্ষায় অর্থায়ন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভূত বেসরকারি এমপিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি বাদে সবগুলোতে দলীয়করণের ভূত চেপে বসেছে। ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার লোক অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ফলে শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

সৃজনশীল আর এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এ প্লাস আর গোল্ডেনের সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে নূন্যতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারে না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মতো। যার টাকা আছে সেই সেটা কিনতে পারবে। এটি জীবন দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক, তবে এটাই এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে।

২০১০ সালে বর্তমান সরকার একটি শিক্ষানীতি দিয়েছিল, যেখানে শিক্ষার দর্শনে মুক্তিযদ্ধের চেতনা ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিধান যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, সেই সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রেই কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি বরং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির ক্ষমতাশীল আমলে শিক্ষা কারিকুলামে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়েছে। আগে-পিছের শিক্ষার একাডেমিক ও কারিকুলামগত স্বীকৃতি না থাকলেও কওমি মাদ্রাসার শেষ পর্যায়ের কোর্সকে শেষ পর্যায়ের শিক্ষাকে মাস্টাসের মর্যাদা শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে হ য ব র ল সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই শিক্ষাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। বিজ্ঞান যুক্তি আধুনিক সমাজে শিক্ষার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত মানবিকতা, সৃজনশীলতা, যৌক্তিকতা ও উৎপাদনশীল।

লেকক : অধ্যক্ষ, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি