ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তুরাগ একটি নদের নাম

 

 

কোথাও কেমিক্যাল মেশানো দুর্গন্ধময় বিষাক্ত কালো পানির স্রোত, কোথাও ময়লা-আবর্জনা, পশুর মৃতদেহ, কচুরিপানার জটলা, আবার কোথাও দুই ধারে বড় বড় দালান আর মিল-কারখানা, কালো ধোঁয়া ওড়ানো ইটভাটার চিমনি। এ এক অদ্ভুত জলাশয়! এসব দেখে এটিকে একটি ভাগাড় কিংবা বিষের নহর বলেই মনে হয়। বলছি তুরাগ নদের কথা। যদিও দেখে বড়জোর একটি খাল বলেই মনে হয়। অন্তত নতুন প্রজন্ম সেভাবেই ভাবে। নতুন প্রজন্মকে কোনোভাবেই বোঝানোর উপায় নেই যে একসময়ের কহর দরিয়া খ্যাত নদটিই এখনকার তুরাগ। কেউ জানুক না জানুক, নতুন প্রজন্মের কেউ মানুক না মানুক, শুধু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তুরাগ একটি নদের নাম।

জনশ্রুতি আছে, মোগল আমলে ঢাকার শাহ বন্দর ছিল তুরাগ নদের তীরে। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদদের মতবিরোধ থাকলেও তুরাগের ইতিহাস নিয়ে মতবিরোধের কোনো সুযোগ নেই। ১৯১২ সালে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইয়ে তুরাগ সম্পর্কে লেখা রয়েছে, ‘নদীটি ময়মনসিংহ জেলা হইতে আসিয়া দরিয়াপুরের নিকটে ঢাকা জেলায় প্রবেশ লাভ করিয়াছে। তথা হইতে পূর্বাভিমুখে কিয়দ্দুর আসিয়া রাজাবাড়ি, বোয়ালিয়া প্রভৃতি স্থানের পার্শ্বদেশ ভেদ করিয়া পূর্ববাহিনী হইয়াছে। শেনাতুল্লার সন্নিকটে মোড় ঘুরিয়া প্রায় সরলভাবে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হইয়াছে এবং মির্জাপুর, কাশিমপুর, ধীতপুর, বিরলিয়া, উয়ালিয়া, বনগাঁও প্রভৃতি স্থান তীরে রাখিয়া মীরপুরের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার সহিত মিলিত হইয়াছে। ’ বর্তমানে তুরাগ নামের নদটি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বংশী নদী থেকে উত্পন্ন হয়ে ঢাকার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নে এসে দুটি ধারায় ভাগ হয়েছে। এর মূল শাখাটি আমিনবাজার হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ছে। অন্যদিকে তুরাগের আরেকটি শাখা বিরুলিয়া থেকে আশুলিয়া-টঙ্গী হয়ে বালু নদে গিয়ে মিশেছে। স্থানীয়ভাবে এই শাখাকেও তুরাগ নদ বলা হয়; যদিও তুরাগ নদের এই অংশের আদি নাম কহর দরিয়া।

২০০৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ থেকে জানা যায়, তুরাগের প্রবাহিত গতিপথের দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার। এই ৭১ কিলোমিটারের পুরোটাই ধারাবাহিক দখল ও দূষণে মরণাপন্ন। এসব এলাকায় তুরাগের বুকে পানির দেখা মিললেও বেশির ভাগ অংশে বালু জমে নদীর পিঠ বেরিয়ে এসেছে। দখল, ভরাট আর দূষণে ‘নিখোঁজ’ হতে চলেছে তুরাগ নামের এই নদটি। দখল আর দূষণের স্পষ্ট চিত্র চোখে পড়ে টঙ্গী ব্রিজ এলাকায়। বাজারের বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য ও কারখানা বর্জ্যে বিপন্নপ্রায় এ নদটি। স্বাধীনতাপূর্ব সময়েও এখানে নদী ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ এখন এ এলাকায় দখলের চিত্র ভয়াবহ। বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি সরকারি স্থাপনাও তুরাগের বুকে পাথরের মতো চেপে বসছে। টঙ্গী ব্রিজের গোড়া থেকে টঙ্গী নদীবন্দর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার এলাকায় নদীর দুই পারেই ওয়াকওয়ে স্থাপন করা হয়েছে একেবারে নদীর ওপরেই; যদিও আইন অনুযায়ী নদীপাড়ের ১৫০ ফুটের ভেতরে যেকোনো স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা বেআইনি। এই ওয়াকওয়ে নামক পাথরটি শুধু টঙ্গী এলাকায় নয়, আমিনবাজার থেকে গাবতলী হয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায়ও রয়েছে, যার পুরোটাই একেবারে নদীর ওপরেই নির্মাণ করা হয়েছে।

শুধু ওয়াকওয়ে নয়, তুরাগের সীমানা নির্ধারণী পিলার নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র। কালিয়াকৈর থেকে বসিলা পর্যন্ত কোথাও সীমানা পিলার সঠিক মাপ অনুযায়ী বসানো হয়নি। দখলদাররা কোথাও কোথাও নদীর সীমানা পিলার উপড়ে ফেলেছে। আবার কিছু স্থানে সীমানা পিলার ছাড়িয়ে নদীর ভেতরে অবাধে দখল করা হয়েছে নদীর জায়গা। তুরাগে ১৫২টি সীমানা পিলারের মধ্যে বেশির ভাগই অবৈধ দখলের কারণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। টঙ্গী ব্রিজ থেকে আশুলিয়া ব্রিজ অংশে তুরাগের দুই ধারে প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখল। ছোট ছোট দালান, মার্কেট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, এমনকি বহুতল পাবলিক টয়লেট। আশুলিয়া থেকে শুরু করে মিরপুর বেড়িবাঁধের এলাকা পর্যন্ত তুরাগের পারে কয়েক শ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দিয়াবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তুরাগের পাড়ঘেঁষে থরে থরে রাখা আছে বালুরাশি। নদীতে ভেড়ানো কার্গো থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বালু পারে ফেলা হচ্ছে। সেই বালু এক্সকাভেটর দিয়ে কেটে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। এভাবে বালু ব্যবসার কারণেও নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বালু ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ নদীর জমি দখল করে অবাধে ভরাট করছে। ম্যাপ অনুযায়ী যেসব স্থানে বালু ফেলা হচ্ছে সেগুলো ছিল নিচু জলাশয়। আর কিছু স্থানের জমি নদীর।

বেড়িবাঁধের চটবাড়ী এলাকায় নদীর পারে বেশ বড় একটি এলাকা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে; ভেতরে লাগানো হয়েছে গাছপালা। অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। গড়ে উঠেছে নেবারল্যান্ড নামের একটি পার্ক। যেখানে পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে তা ছিল জলাশয়। গত কয়েক বছরের মধ্যে বালু ফেলে ভরাট করে পার্কটি করা হয়েছে। পার্কের ভেতরে নদীর জায়গাও পড়েছে। এমনকি নদীর সীমানা পিলারও পড়েছে ওই পার্কের ভেতরেই। এরই পাশ দিয়ে কোনো রকমে বয়ে যাচ্ছে মৃতপ্রায় তুরাগ। অন্যদিকে ঢাকা শহরের পাশের জেলা গাজীপুরের কড্ডা ব্রিজ এলাকার কাসিমপুর হয়ে তুরাগের যে মূলধারাটি বিরুলিয়া এলাকায় মিশেছে তার অবস্থাও খুবই খারাপ। এসব স্থানে নদীর শরীর কিছুটা চওড়া হলেও পর্যাপ্ত পানি নেই। যেটুকু তরলের দেখা মেলে তাকে পানি না বলে তরল বিষ বলা যেতে পারে। কালো দুর্গন্ধময় কেমিক্যালমিশ্রিত যে পানিটুকু এখানে দেখা যায় তা সবই বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্য। এ এলাকায় রয়েছে অসংখ্য বড় কল-কারখানা। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি—কী নেই এসব এলাকায়! ডিবিএল গ্রুপ, ইসলাম গ্রুপ, কেয়া কসমেটিকস, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ, মণ্ডল গ্রুপের মতো বৃহৎ আকৃতির সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। নদীর পার ঘেঁষে গড়ে ওঠা এসব কল-কারখানা থেকে হাজার হাজার ঘনফুট কেমিক্যাল বর্জ্য প্রতিনিয়ত মিশে যাচ্ছে এ এলাকার তুরাগের পানিতে। এসব জায়গায় পানি এতটাই কালো আর দুর্গন্ধময় যে সাধারণ মানুষের যেকোনো প্রয়োজনে এই পানি ব্যবহারের অযোগ্য।

শুধু নদী দখল-দূষণ নয়, তুরাগতীরের অন্তত চারটি জায়গায় রয়েছে ইটভাটার দৌরাত্ম্য। এসব ইটভাটা কোথাও দখল করেছে নদীর জমি, আবার কোথাও কেটে নিচ্ছে নদীপারের মাটি। কয়লা, পোড়া মাটি আর কালো ধোঁয়া মিশে এসব এলাকার পরিবেশ এককথায় বিভীষিকাময়। কেমিক্যালমিশ্রিত পানির দুর্গন্ধ আর কালো ধোঁয়ামিশ্রিত ভারী বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াটাই অসাধ্য কাজ। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেভাবে ঢাকার নদীগুলো দূষিত হচ্ছে তার মধ্যে তুরাগের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। পানি আর বায়ুদূষণের কারণে নদীতীরবর্তী ৮০ শতাংশ মানুষই রয়েছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি আর পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে।

তুরাগ নদে একসময় প্রচুর মাছ ছিল। অথচ এখন শুধু মাছ নয়, কোনো জলজ প্রাণীই টিকে থাকতে পারে না। এতে শুধু পরিবেশ নয়, নদকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করত যেসব মানুষ তারাও চরম হুমকির মুখে। এখনো তুরাগের তীরে কিছু কিছু জায়গায় বেদে সম্প্রদায়ের নৌকা দেখা যায়। আর যারা মত্স্যজীবী হিসেবে পরিচিত ছিল তারাও এখন অন্য উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব মানুষের চোখে-মুখে এখন শুধুই হতাশা, ক্ষোভ আর অভিযোগ। প্রকৃতপক্ষে তুরাগের বর্তমান যে জীর্ণদশা, তাতে এই নদকে কোনোভাবেই নতুন জীবন দেওয়া সম্ভব নয়। নদী গবেষকদের ভাষ্য, নতুন জীবন নয়, বরং যেটুকু এখনো বেঁচে আছে সেটুকু কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। শুধু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ আর উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর ভর করে তুরাগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তুরাগ রক্ষার একমাত্র উপায় হতে পারে জনসচেতনতা আর দখল-দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্যকর ভূমিকা। এই মুহূর্ত থেকে তুরাগ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা না নিলে শুধু মানুষের মুখে আর ইতিহাসের পাতায় শোভা পাবে তুরাগ। সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের মানুষ হয়তো ভুলেই যাবে তুরাগ একটি নদের নাম।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

তুরাগ একটি নদের নাম

আপডেট টাইম : ০৬:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মে ২০১৭

 

 

কোথাও কেমিক্যাল মেশানো দুর্গন্ধময় বিষাক্ত কালো পানির স্রোত, কোথাও ময়লা-আবর্জনা, পশুর মৃতদেহ, কচুরিপানার জটলা, আবার কোথাও দুই ধারে বড় বড় দালান আর মিল-কারখানা, কালো ধোঁয়া ওড়ানো ইটভাটার চিমনি। এ এক অদ্ভুত জলাশয়! এসব দেখে এটিকে একটি ভাগাড় কিংবা বিষের নহর বলেই মনে হয়। বলছি তুরাগ নদের কথা। যদিও দেখে বড়জোর একটি খাল বলেই মনে হয়। অন্তত নতুন প্রজন্ম সেভাবেই ভাবে। নতুন প্রজন্মকে কোনোভাবেই বোঝানোর উপায় নেই যে একসময়ের কহর দরিয়া খ্যাত নদটিই এখনকার তুরাগ। কেউ জানুক না জানুক, নতুন প্রজন্মের কেউ মানুক না মানুক, শুধু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তুরাগ একটি নদের নাম।

জনশ্রুতি আছে, মোগল আমলে ঢাকার শাহ বন্দর ছিল তুরাগ নদের তীরে। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদদের মতবিরোধ থাকলেও তুরাগের ইতিহাস নিয়ে মতবিরোধের কোনো সুযোগ নেই। ১৯১২ সালে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইয়ে তুরাগ সম্পর্কে লেখা রয়েছে, ‘নদীটি ময়মনসিংহ জেলা হইতে আসিয়া দরিয়াপুরের নিকটে ঢাকা জেলায় প্রবেশ লাভ করিয়াছে। তথা হইতে পূর্বাভিমুখে কিয়দ্দুর আসিয়া রাজাবাড়ি, বোয়ালিয়া প্রভৃতি স্থানের পার্শ্বদেশ ভেদ করিয়া পূর্ববাহিনী হইয়াছে। শেনাতুল্লার সন্নিকটে মোড় ঘুরিয়া প্রায় সরলভাবে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হইয়াছে এবং মির্জাপুর, কাশিমপুর, ধীতপুর, বিরলিয়া, উয়ালিয়া, বনগাঁও প্রভৃতি স্থান তীরে রাখিয়া মীরপুরের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার সহিত মিলিত হইয়াছে। ’ বর্তমানে তুরাগ নামের নদটি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বংশী নদী থেকে উত্পন্ন হয়ে ঢাকার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নে এসে দুটি ধারায় ভাগ হয়েছে। এর মূল শাখাটি আমিনবাজার হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ছে। অন্যদিকে তুরাগের আরেকটি শাখা বিরুলিয়া থেকে আশুলিয়া-টঙ্গী হয়ে বালু নদে গিয়ে মিশেছে। স্থানীয়ভাবে এই শাখাকেও তুরাগ নদ বলা হয়; যদিও তুরাগ নদের এই অংশের আদি নাম কহর দরিয়া।

২০০৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ থেকে জানা যায়, তুরাগের প্রবাহিত গতিপথের দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার। এই ৭১ কিলোমিটারের পুরোটাই ধারাবাহিক দখল ও দূষণে মরণাপন্ন। এসব এলাকায় তুরাগের বুকে পানির দেখা মিললেও বেশির ভাগ অংশে বালু জমে নদীর পিঠ বেরিয়ে এসেছে। দখল, ভরাট আর দূষণে ‘নিখোঁজ’ হতে চলেছে তুরাগ নামের এই নদটি। দখল আর দূষণের স্পষ্ট চিত্র চোখে পড়ে টঙ্গী ব্রিজ এলাকায়। বাজারের বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য ও কারখানা বর্জ্যে বিপন্নপ্রায় এ নদটি। স্বাধীনতাপূর্ব সময়েও এখানে নদী ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ এখন এ এলাকায় দখলের চিত্র ভয়াবহ। বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি সরকারি স্থাপনাও তুরাগের বুকে পাথরের মতো চেপে বসছে। টঙ্গী ব্রিজের গোড়া থেকে টঙ্গী নদীবন্দর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার এলাকায় নদীর দুই পারেই ওয়াকওয়ে স্থাপন করা হয়েছে একেবারে নদীর ওপরেই; যদিও আইন অনুযায়ী নদীপাড়ের ১৫০ ফুটের ভেতরে যেকোনো স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা বেআইনি। এই ওয়াকওয়ে নামক পাথরটি শুধু টঙ্গী এলাকায় নয়, আমিনবাজার থেকে গাবতলী হয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায়ও রয়েছে, যার পুরোটাই একেবারে নদীর ওপরেই নির্মাণ করা হয়েছে।

শুধু ওয়াকওয়ে নয়, তুরাগের সীমানা নির্ধারণী পিলার নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র। কালিয়াকৈর থেকে বসিলা পর্যন্ত কোথাও সীমানা পিলার সঠিক মাপ অনুযায়ী বসানো হয়নি। দখলদাররা কোথাও কোথাও নদীর সীমানা পিলার উপড়ে ফেলেছে। আবার কিছু স্থানে সীমানা পিলার ছাড়িয়ে নদীর ভেতরে অবাধে দখল করা হয়েছে নদীর জায়গা। তুরাগে ১৫২টি সীমানা পিলারের মধ্যে বেশির ভাগই অবৈধ দখলের কারণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। টঙ্গী ব্রিজ থেকে আশুলিয়া ব্রিজ অংশে তুরাগের দুই ধারে প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখল। ছোট ছোট দালান, মার্কেট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, এমনকি বহুতল পাবলিক টয়লেট। আশুলিয়া থেকে শুরু করে মিরপুর বেড়িবাঁধের এলাকা পর্যন্ত তুরাগের পারে কয়েক শ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দিয়াবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তুরাগের পাড়ঘেঁষে থরে থরে রাখা আছে বালুরাশি। নদীতে ভেড়ানো কার্গো থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বালু পারে ফেলা হচ্ছে। সেই বালু এক্সকাভেটর দিয়ে কেটে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। এভাবে বালু ব্যবসার কারণেও নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বালু ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ নদীর জমি দখল করে অবাধে ভরাট করছে। ম্যাপ অনুযায়ী যেসব স্থানে বালু ফেলা হচ্ছে সেগুলো ছিল নিচু জলাশয়। আর কিছু স্থানের জমি নদীর।

বেড়িবাঁধের চটবাড়ী এলাকায় নদীর পারে বেশ বড় একটি এলাকা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে; ভেতরে লাগানো হয়েছে গাছপালা। অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। গড়ে উঠেছে নেবারল্যান্ড নামের একটি পার্ক। যেখানে পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে তা ছিল জলাশয়। গত কয়েক বছরের মধ্যে বালু ফেলে ভরাট করে পার্কটি করা হয়েছে। পার্কের ভেতরে নদীর জায়গাও পড়েছে। এমনকি নদীর সীমানা পিলারও পড়েছে ওই পার্কের ভেতরেই। এরই পাশ দিয়ে কোনো রকমে বয়ে যাচ্ছে মৃতপ্রায় তুরাগ। অন্যদিকে ঢাকা শহরের পাশের জেলা গাজীপুরের কড্ডা ব্রিজ এলাকার কাসিমপুর হয়ে তুরাগের যে মূলধারাটি বিরুলিয়া এলাকায় মিশেছে তার অবস্থাও খুবই খারাপ। এসব স্থানে নদীর শরীর কিছুটা চওড়া হলেও পর্যাপ্ত পানি নেই। যেটুকু তরলের দেখা মেলে তাকে পানি না বলে তরল বিষ বলা যেতে পারে। কালো দুর্গন্ধময় কেমিক্যালমিশ্রিত যে পানিটুকু এখানে দেখা যায় তা সবই বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্য। এ এলাকায় রয়েছে অসংখ্য বড় কল-কারখানা। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি—কী নেই এসব এলাকায়! ডিবিএল গ্রুপ, ইসলাম গ্রুপ, কেয়া কসমেটিকস, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ, মণ্ডল গ্রুপের মতো বৃহৎ আকৃতির সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। নদীর পার ঘেঁষে গড়ে ওঠা এসব কল-কারখানা থেকে হাজার হাজার ঘনফুট কেমিক্যাল বর্জ্য প্রতিনিয়ত মিশে যাচ্ছে এ এলাকার তুরাগের পানিতে। এসব জায়গায় পানি এতটাই কালো আর দুর্গন্ধময় যে সাধারণ মানুষের যেকোনো প্রয়োজনে এই পানি ব্যবহারের অযোগ্য।

শুধু নদী দখল-দূষণ নয়, তুরাগতীরের অন্তত চারটি জায়গায় রয়েছে ইটভাটার দৌরাত্ম্য। এসব ইটভাটা কোথাও দখল করেছে নদীর জমি, আবার কোথাও কেটে নিচ্ছে নদীপারের মাটি। কয়লা, পোড়া মাটি আর কালো ধোঁয়া মিশে এসব এলাকার পরিবেশ এককথায় বিভীষিকাময়। কেমিক্যালমিশ্রিত পানির দুর্গন্ধ আর কালো ধোঁয়ামিশ্রিত ভারী বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াটাই অসাধ্য কাজ। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেভাবে ঢাকার নদীগুলো দূষিত হচ্ছে তার মধ্যে তুরাগের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। পানি আর বায়ুদূষণের কারণে নদীতীরবর্তী ৮০ শতাংশ মানুষই রয়েছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি আর পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে।

তুরাগ নদে একসময় প্রচুর মাছ ছিল। অথচ এখন শুধু মাছ নয়, কোনো জলজ প্রাণীই টিকে থাকতে পারে না। এতে শুধু পরিবেশ নয়, নদকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করত যেসব মানুষ তারাও চরম হুমকির মুখে। এখনো তুরাগের তীরে কিছু কিছু জায়গায় বেদে সম্প্রদায়ের নৌকা দেখা যায়। আর যারা মত্স্যজীবী হিসেবে পরিচিত ছিল তারাও এখন অন্য উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব মানুষের চোখে-মুখে এখন শুধুই হতাশা, ক্ষোভ আর অভিযোগ। প্রকৃতপক্ষে তুরাগের বর্তমান যে জীর্ণদশা, তাতে এই নদকে কোনোভাবেই নতুন জীবন দেওয়া সম্ভব নয়। নদী গবেষকদের ভাষ্য, নতুন জীবন নয়, বরং যেটুকু এখনো বেঁচে আছে সেটুকু কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। শুধু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ আর উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর ভর করে তুরাগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তুরাগ রক্ষার একমাত্র উপায় হতে পারে জনসচেতনতা আর দখল-দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্যকর ভূমিকা। এই মুহূর্ত থেকে তুরাগ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা না নিলে শুধু মানুষের মুখে আর ইতিহাসের পাতায় শোভা পাবে তুরাগ। সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের মানুষ হয়তো ভুলেই যাবে তুরাগ একটি নদের নাম।