বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল/প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে/পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে।’
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এভাবে চিত্রিত হয় সবুজ মাঠজুড়ে পাকা ধানের দৃশ্য। বর্তমানে গ্রামবাংলায় মাঠজুড়ে কৃষকের ফলানো সোনারঙ ধানের ছড়াছড়ি। আমন ধানের চনমনে গন্ধে মাতোয়ারা কৃষক। দিগন্তজোড়া মাঠ সেজেছে যেন হলুদ-সবুজ রঙে। ঘাম ঝরানো স্বপ্নের ফসল ঘরে তুলে আনতে কৃষক এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই ধান বিক্রির পর কৃষাণির গায়ে উঠবে নতুন শাড়ি, শিশুরা পাবে ভালোমন্দ খাবার, রঙিন জামা।
এবার বছরজুড়ে আবহাওয়া ছিল বৈরী। আগাম বন্যায় হাওরে ব্যাপক ফসলহানি হয়। পরে বন্যায় দেশের ৩২ জেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমন রোপণেও সমস্যা দেখা দেয়। সিপিডির গবেষণায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। দেশব্যাপী চাল সংকটের কথা বলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন। চালের দাম বাজারে এখনও চড়া। সরকারি ও .বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে চাল। তবুও চালের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। ঠিক সে সময়টায় সবাই চেয়ে আছেন আমন ধানের দিকে। ভালো ফলন হওয়ায় কৃষকের মনে অনেক আশা। সবাই প্রত্যাশা করছেন, আমন ধান উঠতে শুরু করলেই চালের ঊর্ধ্বমুখী দামের পারদ নিম্নমুখী হতে পারে।
আশা করা হচ্ছে, আর এক সপ্তাহ পর কৃষকের আঙিনা ভরে উঠবে আমন ধানে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও আশা করছে, চলতি বছর আমনের ফলন গত বছরকেও ছাড়িয়ে যাবে। বন্যায় আমন লাগাতে কিছুটা সমস্যা হলেও বন্যা-পরবর্তী পলি মাটির উর্বরতায় বাম্পার ফলন হয়েছে।
কার্তিকের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমন কাটা শুরু হয়। তবে এবার শেষ আশ্বিনেই দেশের কিছু কিছু এলাকায় আগাম আমন কাটা শুরু হয়েছে। নীলফামারী, রংপুর ও হাওরের কিছু এলাকায় বর্তমানে আমন কাটা হচ্ছে। নতুন ধান উঠতে শুরু করলে চালের দাম কমে যাবে, এমন প্রত্যাশা সবার।
কিন্তু অতি মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী সব সময় চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এখনও তারা তৎপর। আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে- এ খবর তারা এরই মধ্যে পেয়েছেন। ফলে তারা চাল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। চাল সংকট সমাধানে সরকার ২৮ শতাংশ থেকে আমদানি শুল্ক্ক কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ করে দেয়, যাতে বেসরকারি আমদানিকারকরা দ্রুত চাল আমদানি করে সংকট সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ওই আমদানিকারকরা বলছেন, এখন বেশি দামে চাল আমদানি করে ‘ধরা খাওয়ার’ আশঙ্কা আছে। কারণ আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সে কারণে তারা চাল আমদানিতে আর উৎসাহ বোধ করছেন না। যদিও সরকার আশা করছে, সারাদেশে চালের গুদাম বারো মাস ভরপুর থাকুক।
নীলফামারীতে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। দু’দফা বন্যা ও গত বোরো মৌসুমে ধানের ব্লাস্ট রোগ কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। আগাম আমন কাটা শুরু হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে কৃষকের মধ্যে। চড়া চালের বাজারে নতুন ধান পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা তারা। এ ছাড়া আগাম ধান ওঠায় এসব জমিতে আলু ও ভুট্টা আবাদের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন কৃষক।
আমাদের স্থানীয় সংবাদদাতারা জানান, আগাম জাতের আমন ধান কাটা চলছে রংপুরেও। মৌসুমের শুরুতে বৈরী আবহাওয়া থাকলেও সময়মতো আগাম আমন ধান কাটতে পেরে স্বস্তি ফিরেছে কৃষকের মনে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ সদরের ঝিলপাড়ে ঠাটা রোদ মাথায় নিয়ে ধান কাটছেন কৃষক। ক্ষেতের পাশের পাকা রাস্তায় ‘বম’ মেশিনে চলছে মাড়াই। কৃষাণিরা মনের আনন্দে মাড়াই করা ধান বাতাসে ওড়াচ্ছেন। বিকেলের শান্ত রোদে শুকনো ধান মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছেন অনেকে। এবারের বন্যায় শস্যভা ারখ্যাত রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলায় রোপা আমন ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার ভাদুয়া শ্রীপুর গ্রামের ধনাঢ্য কৃষক আবু সামা বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার আমন ধানের দাম আগেভাগে নির্ধারণ করে দিলে কৃষক ভালো দাম পাবেন। বন্যা ও হাওরে ধান নষ্ট হওয়ার কারণে এবার আমনের মণ ৭০০ টাকার ওপরে থাকবে বলেই ধারণা। গত কয় বছর তারা আমনের ন্যায্যমূল্য পাননি। আশা করছেন এবার লাভের মুখ দেখবেন।’
ময়মনসিংহের ফুলপুরের কৃষক লোকমান আলী জানান, এবার আমন মৌসুমের শুরুতে বন্যা হয়েছে। বন্যা নেমে যাওয়ার পর আমন রোপণ করা হয়। পলি পড়া জমিতে দ্রুত বেড়ে ওঠে ধান গাছ। এরপর পর্যাপ্ত বৃষ্টি আমনের বাম্পার ফলনে বড় ভূমিকা রেখেছে। এখন কার্তিকের শুরুতে ফসলের মাঠে যে কুয়াশা পড়বে তাতে ধান হূষ্টপুষ্ট হবে। আর এক সপ্তাহ পর এই এলাকায় ধান কাটা যাবে। কান্দা জমিতে যা রোপণ করা হয়েছে, সেগুলো কাটা শুরু হয়েছে। এবার ফলন খুবই ভালো হয়েছে। এখন ভালো দাম পেলেই খুশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গোলাম মারুফ বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, এবার আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৩ লাখ হেক্টর। কিন্তু হাওরে বোরো ধানের ক্ষতির কারণে কৃষক শেষ পর্যন্ত ৬০ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আমন আবাদ করেছেন। এ ছাড়া ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার এ বছর আমন উৎপাদনে বিশেষ নজর দিয়েছে। বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের ধানের চারা ও কৃষি উপকরণ দেওয়া হয়েছে। বন্যার পানিতেই ভাসমান ধাপে এবার বীজতলা তৈরি করে কৃষি মন্ত্রণালয়। নানা ধরনের প্রণোদনা পাওয়ায় এবার আমনে বিশেষ নজর দিয়েছেন কৃষকরাও। ফলে আমনে বাম্পার ফলন হয়েছে।