চুক্তির শর্ত ভেঙে ওরিয়ন গ্রুপকে পুনঃতফশিল সুবিধা দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। ইউপাস এলসির বিপরীতে সৃষ্ট ফোর্স লোনে শতভাগ জামানত না থাকার পরও ঋণটি পুনঃতফশিল করা হয়। অর্থাৎ ৫৪৭ কোটি টাকার জামানত ঘাটতি থাকার পরও ওরিয়নের ঋণ পুনঃতফশিল করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। তবে এ ঋণ পুনঃতফশিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সদ্য পদত্যাগী ডেপুটি গভর্নর সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওরিয়ন ফার্মার ইউপাস এলসিসহ যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য অনুমোদিত ঋণের অঙ্ক ছিল ৯৬৩ কোটি টাকা। যার ব্যাংক গ্যারান্টি ও সুদসহ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দায় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) শর্ত অনুযায়ী এসব ঋণে পুনঃতফশিল করতে হলে ঋণের বিপরীতে শতভাগ জামানত থাকতে হবে।
কিন্তু জামানত ৫৪৭ কোটি টাকা কম থাকলেও ঋণটি পুনঃতফশিলের অনুমতি চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর খুরশীদ আলমের হস্তক্ষেপে ওই ঋণ ৬ বছর মেয়াদের পুনঃতফশিল করা হয়।
জানা যায়, ইউপাস এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়। এসব কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে একজন আমদানিকারক পণ্যের আমদানি ব্যয় তুলে নেন। এসব কাজে কমপক্ষে ১৮০ দিন সময় লাগে। এরপর একজন আমদানিকারক সরবরাহকারীর পাওনা পরিশোধে ব্যাংক পেমেন্ট নিশ্চিত করেন। ওরিয়নের ক্ষেত্রে এই এলসির দায় পরিশোধে ১ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ৬ বছর সময় পাওয়ার কথা। কিন্তু দেশের ঋণমান দ্রুতগতিতে কমে যাওয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আবুধাবি ইসলামি ব্যাংক এক বছর পর আর ঋণ নবায়ন করেনি। আর এই এক বছরে ওরিয়নের পক্ষ থেকে কোনো দায়ও পরিশোধ করা হয়নি। এতে বাধ্য হয়েই অগ্রণী ব্যাংক ফোর্স লোন সৃষ্টি করে ব্যাংকটির দায় পরিশোধ করেছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ওরিয়ন ফার্মার ইউপাস এলসির আওতায় ঋণপত্রগুলোর বিপরীতে আবুধাবি ইসলামি ব্যাংকের অর্থায়নকৃত আমদানি বিল পরিশোধে ফোর্স লোন সৃষ্টি করা হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের অনুমোদিত ঋণের ৯৬৩ কোটি টাকার মধ্যে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা ইউপাস এলসি সীমা ছিল ৩০১ কোটি টাকা।
এই ঋণপত্রগুলোর বিপরীতে আবুধাবি ইসলামি ব্যাংকের অর্থায়নকৃত আমদানি বিল পরিশোধের জন্য ফোর্স লোন সৃষ্টি করা হয়। ওই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে অগ্রণী ব্যাংকের ৯৩৩তম পর্ষদ সভায় প্রথমবার পুনঃতফশিলের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এক্ষেত্রে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটেছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনাপত্তির জন্য বিবেচ্য পত্রের মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হয়। এ পুনঃতফশিলের ক্ষেত্রে গ্রাহককে ঋণের বিপরীতে অবশ্যই শতভাগ জামানত রাখার বিধান রয়েছে।
ঋণটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। ব্যাংক গ্যারান্টি ইউপাস এলসিসহ অন্যান্য শর্ত অনুযায়ী, ঋণটিতে কমপক্ষে জামানত থাকার কথা ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু এ ঋণে জামানত রয়েছে মাত্র ৮১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণটিতে জামানতের ঘাটতি ৫৪৭ কোটি টাকা।
শুধু তাই নয়, ওরিয়ন ফার্মার অনুকূলে ১৩২ কোটি টাকা ডিমান্ড (ফোর্সড) লোন অনুমোদনের ফলে একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে। পরে ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য আবেদন করে অগ্রণী ব্যাংক। এরপর এক বছরের মধ্যে এ ঋণ একক গ্রাহক ঋণসীমার নিচে নামিয়ে আনার শর্তে অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ৫ মাস সময় অতিবাহিত হলেও গ্রাহকের ঋণের অঙ্ক নির্দেশনা অনুযায়ী কমেনি বরং আরও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সমঝোতা স্মারকের কোনো শর্ত কোনো সুনির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য নির্ধারণ বা আরোপ করা হয় না বিধায় ওরিয়নের এমওইউ-এর শর্ত থেকে অব্যাহতি যুক্তিসংগত নয় বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এ ধরনের নির্দেশনা দেওয়ার পর গ্রাহক ও ব্যাংক তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর খুরশীদ আলমের দ্বারস্থ হন। পরে তিনি নিজ উদ্যোগে তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে কথা বলে এই গ্রাহককে এমওইউ-এর শর্ত থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওরিয়ন ফার্মা একটি ওষুধ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় তাদের অব্যাহতি প্রদানের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জামানত ঘাটতির পরিমাণ বেশি হওয়ায় তা পূরণের লক্ষ্যে দুটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।
শর্ত দুটি হচ্ছে-২০২৫ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে পর্যায়ক্রমে জামানত ঘাটতি পূরণ করতে হবে এবং প্রতি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ওই জামানত সংগ্রহের হালনাগাদ অগ্রগতি এ বিভাগকে অবহিত করতে হবে।
সার্বিক বিষয় জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুর্শেদুল কবীর যুগান্তরকে বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মুডিস রেটিং কমে যাওয়ায় আবুধাবি ইসলামি ব্যাংক গ্রাহকের এলসি দায় পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। হঠাৎ দায় পরিশোধের চাপ তৈরি হওয়ায় ফোর্স লোন সৃষ্টি করতে হয়েছে। প্রকল্প চালু হলে ব্যাংকের দায় পরিশোধের প্রতিশ্রুত দিয়েছে গ্রাহক। আর প্রকল্প চালু হলে জামানতও পূরণ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণে নেওয়া ঋণের বকেয়া ১০৬ কোটি টাকা বিশেষ বিবেচনায় এতদিন খেলাপিমুক্ত রাখলেও এবার আর সে সুযোগ নেই। ঋণটি ২২ আগস্টের মধ্যে খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংককে এ নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।