বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নাটোর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নে ৯৬৭ বিঘা জমিতে শত রকমের ভেষজ গাছ উৎপাদিত ১৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ঔষধি গ্রাম। ৮০০ পরিবারের হাজারও ভেষজচাষির উৎপাদিত ২০ থেকে ৩০ মে. টন ঔষধি গাছ প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় কেনাবেচা হয়।
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের হবিয়তপুর পয়েন্ট থেকে ভ্যানে টলটলিয়াপাড়ার উদ্দেশে ৪-৫ কিলোমিটার যেতেই চোখ আটকে যায় বিঘা বিঘা জমিতে ঔষধি গাছের চাষ দেখে। বাড়ির আঙিনা বা উঠান বলতে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই, যেদিকে চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। লতাপাতা বা কোনো আগাছা নয়, সবই ঔষধি গাছ।
ঔষধি গ্রামে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ঘৃতকুমারী / ঘৃতকাঞ্চন (অ্যালোভেরা), শিমুলের মূল, অশ্বগন্ধা, দাউদমূল, শতমূল, কালোমেঘ, পাথরকুচি এবং মিছরিদানা।
এছাড়াও রয়েছে- বাসক, তুলসী, হরীতকী, বহেরা, তেলাকুচ, কেশরাজ, ধুতরা, পুদিনা, যষ্টিমধু, নিম, অর্জুন, ওলটকম্বল, লজ্জাবতী, হস্তী পলাশ, নিশিন্দা, রাজকণ্ঠ, নীলকণ্ঠ, হিমসাগর, দুধরাজ, ঈশ্বর মূল, রাহু চান্দাল, রক্ত চান্দাল, ভাই চান্দাল, বোন চান্দাল, ভুঁইকুমড়া, আমরুল, কেয়ামূলসহ শত রকমের ঔষধি গাছ।
টলটলিয়াপাড়া যেতে আমিরগঞ্জ বাজারে দেখা হয় লক্ষ্মীপুর ভেষজ ঔষধ সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রশীদ শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, “ঔষধি গ্রামে সবচেয়ে বেশি চাষ এবং বিক্রি হয় ঘৃতকুমারী। আমিরগঞ্জ ও গাবতলী বাজারের আড়ত থেকে কার্টন, গাইটে (ঘৃতকুমারীর গুণাগুণ ঠিক রাখার জন্য বাঁশ, কলাগাছের ফালির মধ্যে ঘৃতকুমারীর পাতা সাজিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা এক ধরনের প্যাকেটকে স্থানীয় ভাষায় গাইট বলে) সাজানো ঘৃতকুমারী খুচরা এবং পাইকারি দামে বিক্রি হয়।
অনেক ব্যবসায়ী আবার ক্ষেত থেকেও কিনে থাকেন। এক গাইটের ৫০ কেজি অ্যালোভেরা আকার অনুযায়ী বিক্রি হয় ৫০০, ৭৫০ এবং ১ হাজার টাকায়। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২২০ গাইট সাজানো ২ থেকে ৩ গাড়ি অ্যালোভেরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।”
টলটলিয়াপাড়ায় ভেষজ মাটিতে অনেক ভেষজ শ্রমিককে অ্যালোভেরার পরিচর্যা করতে দেখা যায়। তারা দিনে একবেলা ৩০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন বলে জানান শ্রমিক সামসুল হক।
ভেষজ কৃষক আশরাফ আলী ১ বিঘা জমিতে ঘৃতকুমারীর চাষ করছেন। তিনি বলেন, “১৫-১৬ দিন পর পর ঘৃতকাঞ্চনের ৮ থেকে ৯ গাইট পাতা বিক্রি হয় ৭ থেকে ৯ হাজার টাকায় এবং বছরে বিক্রি আসে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা। অ্যালোভেরার চারা, সার, কীটনাশক এবং শ্রমিক বাবদ গড়ে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়।”
টলটলিয়াপাড়ার রাস্তা ধরে একটু এগোতেই ঘৃতকুমারীর পাতা তুলতে দেখা যায় এক জমিতে। নজরুল ইসলামের জমিতে পাতা কিনতে আসা ওই এলাকার ব্যবসায়ী খলিলুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ১০ বছর ধরে ঢাকা ও গাজীপুরে অ্যালোভেরা পাঠাই। এক গাড়ি ভালো পাতা পাঠালে খরচ বাদে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হয়।
শিকদার ভেষজ ও হাকিমি দাওয়াখানা, ভান্দারি ভেষজ ভাণ্ডার, বনলতা ভেষজ ভাণ্ডারসহ ঔষধি গ্রামের ৪০ থেকে ৫০ দোকান ব্যবসায়ী ঔষধি গাছ প্রক্রিয়াজাত, ঔষধি গাছ থেকে গুঁড়া তৈরি করে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কবিরাজ, হকার এবং বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ও ঔষধ কোম্পানির কাছে খুচরা এবং পাইকারি বিক্রি করেন।
আমিরগঞ্জ বাজারে চা স্টলে বসে কথা হয় ভেষজচাষি নজরুল ইসলাম, ছোলাইমান, মুতালিব, ওসমান গনি, দেওয়ান আলী, ইসমাইলসহ কয়েকজন স্থানীয়র সঙ্গে। অভিযোগের সুরে তারা জানান তাদের বাজারজাতকরণের সমস্যার কথা। তারা বলেন, “ঔষধি গাছের নির্দিষ্ট কোনো দাম নেই, সংরক্ষণের জন্য কোনো হিমাগার নাই, কৃষকদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নাই।”
কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে কথা হয় ঔষধি গ্রামের উন্নয়ন কাজে নিযুক্ত উত্তরা ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামস সোসাইটির বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার, কৃষিবিদ ফারুক আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমরা কৃষকদের নার্সারি উন্নয়ন, পণ্য বাজারজাতকরণের প্রশিক্ষণ দেব। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করে দেব, যেন মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা কথা বলতে পারেন এবং ন্যায্য দাম পান।”
খোলাবাড়িয়া, কাঁঠালবাড়িয়া, ইব্রাহিমপুর, লক্ষ্মীপুর, সুলতানপুর, চুবারিয়া, পিজ্জিপাড়া, দরারপুর, টলটলিয়াপাড়া, নতুনবাজার, হাজিগঞ্জ, আমিরগঞ্জসহ ১৫ গ্রাম নিয়ে অবস্থিত ঔষধি গ্রামের ১০০ থেকে ১২০ জন কবিরাজ, ৪০০ থেকে ৫০০ জন হকার, ১০০- ১৫০ জন সাধারণ ব্যবসায়ী এবং ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার কৃষকের জীবন ঔষধি গাছের সঙ্গে জড়িত।
গ্রামের এই ভেষজ বিপ্লবের নেপথ্য নায়ক একজন। কবিরাজ মো. আফাজ উদ্দিন পাগলা, যিনি ২০০৯ সালে কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘চ্যানেল আই কৃষি পদক’ পান।