ঢাকা , সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওর পাড়ের বিপন্ন জীবন ও আফালের গল্প

হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল, বিস্তীর্ণ জলরাশির এক সীমাহীন প্রান্তরের ছবি। বরষায় সেই জলরাশির বিচিত্র রূপ। কখনো নিপাট নীরব, নৈঃশব্দে ভরা সূর্যাস্তের সোনালী আভার রঙে ঢেউ খেলে যাওয়া, কখনো রুদ্র-রোষে জেগে উঠা আফালের(ঢেউয়ের) শুধু বিরামহীন হুঙ্কার। বর্ষার নতুন জলে হাওরে ভেসে আসা কচুরিপানার বিশাল মিছিল, বড় বড় মহাজনি নাও, ছোট ছোট নাইরি নৌকা, শম্বুক গতিতে স্রোতের টানে চলা বাঁশের চাইল, দূরন্ত কিশোরের কলাগাছের ভেলা, হাওরের আকাশে সাদা মেঘের উড়াউড়ি, জলের উপরে ভেসে থাকা বুনো ফুল, পানিফল, রঙিন শাপলা, বরষা শেষে ফসল বোনার পর মাইলের পর মাইল দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ, সোনালি ফসলের হাতছানি – সে এক ঐশ্বরিক নান্দনিক নৈসর্গিক দৃশ্য – শৈশব কৈশোরের হাওরের এসব সোনালি স্মৃতি নাগরিক জীবনের কোনো এক ক্লান্ত দুপুরে আজো প্রবলভাবে উদ্বেলিত করে। হাওর অধুষ্যিত এক জেলায় জন্মেছিলাম। তাই হাওরের সাথে জন্মাবধি পরিচয় ও সুনিবিড় সখ্য । বিস্তৃত জলরাশির বুক চিরে নিয়ত ধাবমান কোন জলযান আমাকে কবে কোন দ্বি-প্রহরে সভ্যতার অনুঘটক মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিল সে স্মৃতি আজ বিস্মৃতপ্রায়।

তবে হাওর পাড়ে প্রোথিত নিজের শিকড়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির মহাকাব্য মনের গহীনে আজো খুব যতনে লালন করে চলি । তাই হাওর নিয়ে কাটখোট্টা নৈব্যক্তিক লেখা অসম্ভবপ্রায়। হাওরের জল-জোছনা, মানুষ, পরিবেশ, প্রতিবেশের প্রতি নিরঙ্কুশ পক্ষপাত দুষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আজ বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরেশোরে উচ্চারিত ঠিক সে মুহুর্তে বাংলাদেশের উত্তর-পুর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও অগণিত সমস্যার আবর্তে নিপতিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাওর নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা খুবই সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক।

হাওর নিয়ে তথ্য উপাত্ত ও গবেষণা খুবই অপ্রতুল, নেই বললেই চলে। এ যাবত সর্বজন স্বীকৃত হাওরের কোনো সংজ্ঞাও নেই। উইকিপিডিয়ায় বলা আছে- হাওর বা হাওড় হল সাগরসদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর। হাওরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতি বছরই মৌসুমী বর্ষায় বা স্বাভাবিক বন্যায় হাওর প্লাবিত হয়। বছরের কয়েক মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং বর্ষা শেষে হাওরের গভীরে পানিতে নিমজ্জিত বিল জেগে উঠে। হাওর অনেকটা গামলা আকারের জলাভূমি। বছরের সাত মাস হাওরগুলো পানির নিচে অবস্থান করে এবং শুস্ক মৌসুমে হাওরের পুরো প্রান্তর জুড়ে ঘাস গজায় এবং গবাদি পশুর বিচরণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। বর্ষাকালে সাগরসদৃশ হাওরগুলোর মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোকে দ্বীপ বলে প্রতীয়মান হয়।

এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক এক ব্রিটিশ কালেক্টরের স্মৃতি রোমন্থন করা যেতে পারে। রবার্ট লিন্ডসে ১৭৭৮ সালে সিলেটের কালেক্টর নিযুক্ত হন। লিন্ডসে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, “ঢাকা থেকে নৌকায় যাত্রা করে প্রথমে কুঁড়ি মাইল দূরে ফিরিঙ্গি বাজারে পৌঁছি। এখান থেকে মেঘনা নদী উজিয়ে সিলেটের দিকে যাই। পথে অযত্মবর্ধিত সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে আমাদের নৌকা অগ্রসর হয়। ধানগুলি নুয়ে নুয়ে নৌকার পথ করে দিচ্ছিল; নৌকা এগিয়ে গেলে তারা পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এ দৃশ্য বড়ই মনোহর। এর পরেই আমরা প্রায় একশো মাইল জলাভূমিতে পড়ি। আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে, এই হাওরের দিক নির্ণয়ের জন্য আমাদের সামুদ্রিক কম্পাস ব্যবহার করতে হয়েছিল। ঢাকা থেকে ক্রমাগত সাতদিন চলার পর সিলেট থেকে ত্রিশ মাইল দূরে ছাতকে আমলারা সুসজ্জিত তরীসহ অভ্যর্থনা জানায়।”

‘হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিন্ডসের স্মৃতিচারণে যে সাগরসদৃশ্য হাওরের বর্ণনা দিয়েছেন তার অবস্থান কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জে।
IUCN-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ হাওর রয়েছে। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বা এলাকার বৈশিষ্ট্যভেদে হাওরকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়-
১. পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত হাওর।
২. প্লাবিত এলাকায় হাওর।
৩. গভীর পানি এলাকায় হাওর।

বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলেরর ময়মনসিংহের গারো-খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সুনামগঞ্জ অর্থাৎ কুশিয়ারা-সুরমা অববাহিকার যে বিশাল নিম্নভূমি সেটাই হাওর অঞ্চল।

বৃহত্তর সিলেট বিভাগের প্রধান হাওরগুলোর অবস্থান সুনামগঞ্জ জেলায়। সুনামগঞ্জকে তাই হাওরের রাজধানী বলা হয়। তারপরেই মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার একাংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর খ্যাত হাকালুকি হাওর। এছাড়া হবিগঞ্জেও অসংখ্য হাওর ও জলাশয় রয়েছে । হাওর নিয়ে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য জানা যেতে পারে নিচের কয়েকটি হাওর নিয়ে আলোচনা থেকে ।

হাওর রাজ্য সুনামগঞ্জ

বলা হয়ে থাকে-‘মৎস্য-পাথর-ধান, সুনামগঞ্জের প্রাণ।’ বাংলাদেশের সপ্তম বৃহত্তম জেলা সুমানগঞ্জ দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের কোলঘেষে অবস্থিত। হাওর বিধৌত ৩,৬৭০বর্গ কি.মি. আয়তনের এ জেলায় ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে মোট ৩৭টি হাওর আছে। তার মধ্যে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত ১০৩১এম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিডেজ’ ‘টাঙ্গুয়ার হাওর’ এর অবস্থানও এখানে।

টাঙ্গুয়ার হাওর
তাহিরপুর, ধর্শপাশা উপজেলার উত্তর পশ্চিম সীমান্তে বিস্তৃত ৫১টি বিলের সমন্বয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। বৈচিত্রময় জলজ উদ্ভিদ, প্রকৃতি, ধান, মাছ ও অতিথি পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে বিখ্যাত এ হাওর। সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত এ হাওরের দৃশ্য সত্যিই নৈসর্গিক।

টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন হেমন্তকালে ৬,৯১২ একর। তবে নলখাগড়া, হিজল, করচ-বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাড়ায় প্রায় ২০,০০০ একরের মতো। হাওরটি দৈর্ঘ্যে ১১ এবং প্রস্থে ৭ কি.মি. বিস্তৃত। এই হাওরের ৫১টি ছোট বড় বিলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিল হচ্ছে, রূপবাই, শ্যামসাগর, আলংজোয়ার, এরাইল্লকোণা, গজারিয়া, রৌয়া, আইন্না, হাতিয়াগাতি প্রভৃতি। টাঙ্গুয়ার প্রাণ প্রাবহ হিসেবে খ্যাত নদীগুলো হলো-সুরমা, সুমেশ্বরী, পাটলাই, রক্তি, কংশ এবং ধন।

টাঙ্গুয়ার জীব বৈচিত্র
হাওরের অবারিত জলে ভেসে থাকা হিজল করবের দৃষ্টি নন্দন সারি এবং বিপুল পরিমাণে অতিথি পাখির মুখরিত সমাগম ও হাওরের সৌন্দর্যকে করেছে মোহনীয়। নল খাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, শোলা, হেলেঞ্চা, শতমূলি, শীতল পাঠি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদিসহ দুশো প্রজারিতও বেশি উদ্ভিদ ও গাঠ-গাছালী রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। এ হাওরে ১৪১ প্রজাতির মাছ এছাড়াও ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ রয়েছে।
২০৮ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে অনেক দুর্লভ উদ্ভিদও আছে। ২০০৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে ৩০ লক্ষ পাখির সমাগম হয়েছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওর পাড়ের বিপন্ন জীবন ও আফালের গল্প

আপডেট টাইম : ০৪:০১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মে ২০১৭

হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল, বিস্তীর্ণ জলরাশির এক সীমাহীন প্রান্তরের ছবি। বরষায় সেই জলরাশির বিচিত্র রূপ। কখনো নিপাট নীরব, নৈঃশব্দে ভরা সূর্যাস্তের সোনালী আভার রঙে ঢেউ খেলে যাওয়া, কখনো রুদ্র-রোষে জেগে উঠা আফালের(ঢেউয়ের) শুধু বিরামহীন হুঙ্কার। বর্ষার নতুন জলে হাওরে ভেসে আসা কচুরিপানার বিশাল মিছিল, বড় বড় মহাজনি নাও, ছোট ছোট নাইরি নৌকা, শম্বুক গতিতে স্রোতের টানে চলা বাঁশের চাইল, দূরন্ত কিশোরের কলাগাছের ভেলা, হাওরের আকাশে সাদা মেঘের উড়াউড়ি, জলের উপরে ভেসে থাকা বুনো ফুল, পানিফল, রঙিন শাপলা, বরষা শেষে ফসল বোনার পর মাইলের পর মাইল দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ, সোনালি ফসলের হাতছানি – সে এক ঐশ্বরিক নান্দনিক নৈসর্গিক দৃশ্য – শৈশব কৈশোরের হাওরের এসব সোনালি স্মৃতি নাগরিক জীবনের কোনো এক ক্লান্ত দুপুরে আজো প্রবলভাবে উদ্বেলিত করে। হাওর অধুষ্যিত এক জেলায় জন্মেছিলাম। তাই হাওরের সাথে জন্মাবধি পরিচয় ও সুনিবিড় সখ্য । বিস্তৃত জলরাশির বুক চিরে নিয়ত ধাবমান কোন জলযান আমাকে কবে কোন দ্বি-প্রহরে সভ্যতার অনুঘটক মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিল সে স্মৃতি আজ বিস্মৃতপ্রায়।

তবে হাওর পাড়ে প্রোথিত নিজের শিকড়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির মহাকাব্য মনের গহীনে আজো খুব যতনে লালন করে চলি । তাই হাওর নিয়ে কাটখোট্টা নৈব্যক্তিক লেখা অসম্ভবপ্রায়। হাওরের জল-জোছনা, মানুষ, পরিবেশ, প্রতিবেশের প্রতি নিরঙ্কুশ পক্ষপাত দুষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আজ বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরেশোরে উচ্চারিত ঠিক সে মুহুর্তে বাংলাদেশের উত্তর-পুর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও অগণিত সমস্যার আবর্তে নিপতিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাওর নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা খুবই সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক।

হাওর নিয়ে তথ্য উপাত্ত ও গবেষণা খুবই অপ্রতুল, নেই বললেই চলে। এ যাবত সর্বজন স্বীকৃত হাওরের কোনো সংজ্ঞাও নেই। উইকিপিডিয়ায় বলা আছে- হাওর বা হাওড় হল সাগরসদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর। হাওরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতি বছরই মৌসুমী বর্ষায় বা স্বাভাবিক বন্যায় হাওর প্লাবিত হয়। বছরের কয়েক মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং বর্ষা শেষে হাওরের গভীরে পানিতে নিমজ্জিত বিল জেগে উঠে। হাওর অনেকটা গামলা আকারের জলাভূমি। বছরের সাত মাস হাওরগুলো পানির নিচে অবস্থান করে এবং শুস্ক মৌসুমে হাওরের পুরো প্রান্তর জুড়ে ঘাস গজায় এবং গবাদি পশুর বিচরণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। বর্ষাকালে সাগরসদৃশ হাওরগুলোর মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোকে দ্বীপ বলে প্রতীয়মান হয়।

এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক এক ব্রিটিশ কালেক্টরের স্মৃতি রোমন্থন করা যেতে পারে। রবার্ট লিন্ডসে ১৭৭৮ সালে সিলেটের কালেক্টর নিযুক্ত হন। লিন্ডসে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, “ঢাকা থেকে নৌকায় যাত্রা করে প্রথমে কুঁড়ি মাইল দূরে ফিরিঙ্গি বাজারে পৌঁছি। এখান থেকে মেঘনা নদী উজিয়ে সিলেটের দিকে যাই। পথে অযত্মবর্ধিত সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে আমাদের নৌকা অগ্রসর হয়। ধানগুলি নুয়ে নুয়ে নৌকার পথ করে দিচ্ছিল; নৌকা এগিয়ে গেলে তারা পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এ দৃশ্য বড়ই মনোহর। এর পরেই আমরা প্রায় একশো মাইল জলাভূমিতে পড়ি। আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে, এই হাওরের দিক নির্ণয়ের জন্য আমাদের সামুদ্রিক কম্পাস ব্যবহার করতে হয়েছিল। ঢাকা থেকে ক্রমাগত সাতদিন চলার পর সিলেট থেকে ত্রিশ মাইল দূরে ছাতকে আমলারা সুসজ্জিত তরীসহ অভ্যর্থনা জানায়।”

‘হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিন্ডসের স্মৃতিচারণে যে সাগরসদৃশ্য হাওরের বর্ণনা দিয়েছেন তার অবস্থান কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জে।
IUCN-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ হাওর রয়েছে। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বা এলাকার বৈশিষ্ট্যভেদে হাওরকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়-
১. পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত হাওর।
২. প্লাবিত এলাকায় হাওর।
৩. গভীর পানি এলাকায় হাওর।

বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলেরর ময়মনসিংহের গারো-খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সুনামগঞ্জ অর্থাৎ কুশিয়ারা-সুরমা অববাহিকার যে বিশাল নিম্নভূমি সেটাই হাওর অঞ্চল।

বৃহত্তর সিলেট বিভাগের প্রধান হাওরগুলোর অবস্থান সুনামগঞ্জ জেলায়। সুনামগঞ্জকে তাই হাওরের রাজধানী বলা হয়। তারপরেই মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার একাংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর খ্যাত হাকালুকি হাওর। এছাড়া হবিগঞ্জেও অসংখ্য হাওর ও জলাশয় রয়েছে । হাওর নিয়ে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য জানা যেতে পারে নিচের কয়েকটি হাওর নিয়ে আলোচনা থেকে ।

হাওর রাজ্য সুনামগঞ্জ

বলা হয়ে থাকে-‘মৎস্য-পাথর-ধান, সুনামগঞ্জের প্রাণ।’ বাংলাদেশের সপ্তম বৃহত্তম জেলা সুমানগঞ্জ দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের কোলঘেষে অবস্থিত। হাওর বিধৌত ৩,৬৭০বর্গ কি.মি. আয়তনের এ জেলায় ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে মোট ৩৭টি হাওর আছে। তার মধ্যে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত ১০৩১এম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিডেজ’ ‘টাঙ্গুয়ার হাওর’ এর অবস্থানও এখানে।

টাঙ্গুয়ার হাওর
তাহিরপুর, ধর্শপাশা উপজেলার উত্তর পশ্চিম সীমান্তে বিস্তৃত ৫১টি বিলের সমন্বয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। বৈচিত্রময় জলজ উদ্ভিদ, প্রকৃতি, ধান, মাছ ও অতিথি পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে বিখ্যাত এ হাওর। সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত এ হাওরের দৃশ্য সত্যিই নৈসর্গিক।

টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন হেমন্তকালে ৬,৯১২ একর। তবে নলখাগড়া, হিজল, করচ-বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাড়ায় প্রায় ২০,০০০ একরের মতো। হাওরটি দৈর্ঘ্যে ১১ এবং প্রস্থে ৭ কি.মি. বিস্তৃত। এই হাওরের ৫১টি ছোট বড় বিলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিল হচ্ছে, রূপবাই, শ্যামসাগর, আলংজোয়ার, এরাইল্লকোণা, গজারিয়া, রৌয়া, আইন্না, হাতিয়াগাতি প্রভৃতি। টাঙ্গুয়ার প্রাণ প্রাবহ হিসেবে খ্যাত নদীগুলো হলো-সুরমা, সুমেশ্বরী, পাটলাই, রক্তি, কংশ এবং ধন।

টাঙ্গুয়ার জীব বৈচিত্র
হাওরের অবারিত জলে ভেসে থাকা হিজল করবের দৃষ্টি নন্দন সারি এবং বিপুল পরিমাণে অতিথি পাখির মুখরিত সমাগম ও হাওরের সৌন্দর্যকে করেছে মোহনীয়। নল খাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, শোলা, হেলেঞ্চা, শতমূলি, শীতল পাঠি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদিসহ দুশো প্রজারিতও বেশি উদ্ভিদ ও গাঠ-গাছালী রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। এ হাওরে ১৪১ প্রজাতির মাছ এছাড়াও ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ রয়েছে।
২০৮ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে অনেক দুর্লভ উদ্ভিদও আছে। ২০০৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে ৩০ লক্ষ পাখির সমাগম হয়েছে।