বাঙালি কণ্ঠ ডেস্ক ঃ
দুইদিন আগে বিশাল এক ব্যাপার আবিষ্কার করেছি। শব্দটি যখন ‘আবিষ্কার’, তার মানে কারো সাহায্য ছাড়াই কাজটি আমি করে ফেলেছি। ব্যাপারটি আবিষ্কার করার পর থেকে আমি আর আমার মধ্যে নেই, একেবারে কিশোরী আনন্দে লাফাচ্ছি।
খুলেই বলি, আমার মেয়ে মিশার কাছে প্রথম শুনেছি ফেসবুকের কথা। আজ থেকে আরও চার বছর আগে। মিশা তখন কলেজে পড়ে। ছুটিতে বাড়ী আসে, ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে থাকে। ল্যাপটপে কি? ফেসবুক। ফেসবুক মানে কি? ফেসবুক মানে বন্ধু। ঘরে বসে থেকে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে থাকা স্বজন-বন্ধুর সাথে আড্ডা, গল্প, ছবি শেয়ার করা।
পড়ালেখার ক্ষতি করে এইসব? পড়ালেখার ক্ষতি করে কিছুই করে না সে, এমনই বলেছে আমাকে। আমি হলাম ট্র্যাডিশনাল বাঙ্গালী মা, মেয়ের স্তোকবাক্যে সহজে ভুলবার পাত্রী নই। নাছোড়বান্দা মা’কে আশ্বস্ত করার জন্যই মিশা তার ফেসবুকে আমাকে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। নিজেকে মায়ের কাছে স্বচ্ছ প্রমান করার জন্য নিজের পাসওয়ার্ডও দিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ওর অ্যাকাউন্টে ঢুকে আমি আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের ছবি দেখতে পারি। অস্ট্রেলিয়াতে আমাদের অনেক বন্ধু আছে, তাদের ছেলেমেয়েরা আমার মেয়েদের মতই বড় হয়ে গেছে, তারা দেখতে কেমন হয়েছে, তা দেখার জন্যই মিশার অ্যাকাউন্টে ঢুকতাম।
মিশার অ্যাকাউন্টে ঢুকে আমি ছবিগুলোই শুধু দেখতাম, ওয়ালের সবকিছু আমার কাছে জটিল মনে হতো। নোটিফিকেশানে দেখতাম নাম্বার দেখায়, একটা খামের মত আইকনে দেখতাম নাম্বার দেখায়, তার পাশেই মানুষের অবয়বেও দেখি নাম্বার দেখায়। সবকিছু খুব জটিল মনে হতো, তবে ছবিগুলো দেখেই আমি উইন্ডো ক্লোজ করে দিতাম। লাল বক্সে দেখানো নাম্বারে কখনও ক্লিক করতাম না। মা আর মেয়ে সম্পর্ক হলেও পারস্পরিক বিশ্বাস বড় কথা। আমি কখনও মেয়েদের উপর স্পায়িং করিনি, মেয়েরা নিজে থেকেই আমাদের সাথে সব কথা খোলাখুলি বলে।
তা মিশা একদিন বলল, ” মা, আমার বন্ধুরা যখন শোনে, তুমি আমার অ্যাকাউন্টে যাও, ওরা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়! আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। শোন, তোমাকে বরং একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেই, তোমার পুরানো বন্ধুদের পাবে, নিজের ছবি পোস্ট করতে পারবে, অন্যের ছবি দেখতে পারবে।
আমি ভয় পাই, ” আরে না! এগুলো অনেক কঠিন কাজ, আমি কিছুই বুঝি না। তাছাড়া আমার বন্ধুদের কেউ ফেসবুকে নেই, ফেসবুক খুলে ফাঁকা ওয়াল নিয়ে বসে থাকবো, কেমন লজ্জার ব্যাপার।” মেয়ে তার মা’কে আশ্বস্ত করে, ” ফাঁকা থাকবে না, পুরানো বন্ধুদের না পেলে নতুন বন্ধু তৈরী হবে। ভালো না লাগলে বন্ধ করে দিও। কিনতু মেয়ের অ্যাকাউন্টে ঢুকা ঠিক না। আমরা বন্ধুরা সবাই কত আলতু ফালতু কথা লিখি ফেসবুকে, তুমি পড়ে ফেললে খবর আছে”।
আমার সম্মতি নিয়েই আড়াই বছর আগে মিশা আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। নিজের পরিচিত বন্ধুদের কাছে আমার জন্য রিকোয়েস্ট পাঠায়, দুই দিনের মধ্যে বন্ধু সংখ্যা ৩৬ এ দাঁড়ায়। আমি খুশী, কয়েকদিন খুশী থেকে ‘মহাখুশী’ হতে চেয়েছি। নিজে নিজে ওয়ালের ডানে -বামে তাকিয়ে দুই একটা ‘অ্যাড ফ্রেন্ড’ দেখে ক্লিক করে দিয়েছি। প্রতিদিন মিশার ওয়ালে যাই, দেখি ওর ফ্রেন্ড সংখ্যা পাঁচশ’র উপরে। ছিছি! মেয়ের ফ্রেন্ড সংখ্যা পাঁচশ, আর মায়ের ফ্রেন্ড মাত্র চল্লিশ! লজ্জার কথা! বুঝিও না, কীভাবে মেসেজ পাঠাতে হয়, কীভাবে ছবি পোস্ট করতে হয়। মিশাকে ফোন করি, ” মিশা, আগেই ভালো ছিল, তোর অ্যাকাউন্টে গিয়ে সবার ছবি দেখতাম। এখনতো তোর পাসওয়ার্ড বদলায় ফেলছস, আর ঢুকতে পারি না, ছবিও দেখতে পারি না”।
” মা, তোমাকে তো নিজের অ্যাকাউন্ট খুলে দিলাম, এখন আর আমার অ্যাকাউন্টে যাওয়ার দরকার কি? তোমার ওয়ালে থেকেও ছবি দেখতে পারবে। বন্ধুদের সাথে চ্যাট করতে পারবে।”
” কিন্তু, আমি তো ফেসবুকের কিছুই বুঝি না। চ্যাট কিভাবে করে? তাছাড়া আমার ফ্রেন্ড লিস্টে বন্ধু অনেক কম। এত কম বন্ধু নিয়ে আমি ফেসবুক করবো না। তোরা সবাই কত সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করস, আর আমার অ্যাকাউন্টে কোন ছবিও নাই”।
” হায়রে! ঠিক আছে, নেক্সট টাইম বাসায় এসে তোমাকে সব শিখিয়ে দিয়ে যাব। তার আগে তুমি নিজেও একটু একটু করে চেষ্টা করো”।
শুরু হলো আমার চেষ্টা। দুই চারজনকে আন্দাজেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি, তারা রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করতেই আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছি। বন্ধু আবিষ্কারের আনন্দ। এরপর মিশা বাড়ী এসেছে, কাকুতি-মিনতি করে ওকে দিয়ে কিছু ছবি পোস্ট করিয়েছি। আমি জানিও না, আমার ইন্টারেস্ট, আমার হোম টাউন থেকে শুরু করে সব কিছু মিশা লিখে দিয়েছে। আমি তো ওগুলো পড়েও দেখিনি। এভাবেই কেটে গেছে এক বছর। এক বছরে আমার বন্ধু সংখ্যা হয়েছে একশ’এর কিছু বেশী।
এর মধ্যেই শিখে ফেলেছি কি করে চ্যাট করতে হয়, কী করে মেসেজ পাঠাতে হয়। কিন্তু কাহাতক আর ভালো লাগে! একঘেয়ে লাগে সব কিছু। শুধু মিশা যখন বাড়ী আসে, ওকে দিয়ে ছবি আপলোড করাই। এই একটা ব্যাপারে আমাদের মা-মেয়ের খুব মিল আছে। দুজনেই ছবি তোলাতে ভালোবাসি, মিশা অবশ্য ছবি তুলতেও ভালোবাসে। আমি ক্যামেরা হাতে নেই না, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাই। ফলে ছবিতে ‘লাইক’ পড়ে, কমেন্ট পড়ে, আমি খুশী হই।
মিশার কাছ থেকে স্ট্যাটাস লিখার কায়দা শিখি। বাংলিশে স্ট্যাটাস লিখি, কী সব মাথামুন্ডু লিখি, তাও বুঝি না। মাঝে মাঝে অন্যের ওয়ালে বাংলায় লেখা দেখি, একদিন খুব আফসোস করছিলাম, আমি যদি আমাদের কম্পিউটারে বাংলায় লিখতে পারতাম, কত ভালো হতো! আফসোসটুকু বেশ উচ্চঃস্বরেই করেছিলাম। পাশের রুম থেকে আমার ছোট্ট মেয়ে মিথীলা শুনে ফেলেছিল। ও চট করে আমাকে বলল, ” মা, আমাদের কম্পিউটারে তো বাংলা ফন্ট আছে। দাঁড়াও, আমি বের করে দেই”। মিথীলা আগে থেকে ইন্সটল করা ‘অভ্র’ বের করে দিল। আমি জানিনা কী করে ইংলিশ কী-বোর্ডে বাংলা টাইপ করতে হয়। মিথীলার তো জানার প্রশ্নই আসে না। আন্দাজের উপর ভর করে টাইপ করি, শুদ্ধ হয়, ভুলও হয়। হঠাৎ একবার খুব ভয়ে ভয়ে উপরের টুলবারে ‘বাংলা’ শব্দের পাশের ‘অ্যা্রো’ তে ক্লিক করেছি, দেখি বেশ কিছু অপশন দেখাচ্ছে। তার মধ্যে বাংলা ‘কীবোর্ড লে আউট’ ছিল। ওটাতে ক্লিক করতেই আমার চোখের সামনে খুলে গেলো ধন-ভান্ডারে ভরা জগতের বিশাল দরজা। বেশ কিছুক্ষণ আমি থম ধরে বসে ছিলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমি নিজে নিজে এতবড় এক দুনিয়া আবিষ্কার করে ফেলেছি! মাত্র এক ঘন্টায় পুরো লে আউট আমি মুখস্থ করে ফেলেছি। আনন্দের আতিশয্যে তখনই বাংলায় লিখে স্ট্যাটাস দিলাম, ” মিথীলা আমাকে বাংলা ফন্ট অভ্রের সন্ধান দিয়েছে”।
আরও কিছুদিন বাদে আমার ফেসবুক বোন ‘সালমা রেখা’ ক্রমাগত আমার ওয়ালে নানা কবিতা ট্যাগ করা শুরু করে। কবিতা আমি বুঝিও কম, সেজন্য উৎসাহও পেতাম না। তারপরেও কেউ একজন আমাকে সৃষ্টিশীল সাহিত্য পাঠের অংশীদার করতে চেয়েছে, ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছি। রেখা আমাকে বলেছে, আমিও যেনো কবিতা লিখে পোস্ট করি। কবিতা লেখার প্রশ্নই উঠেনা, পারলে তো লিখবো!
একদিন খুব ভয়ে ভয়ে ‘আলো’ ব্লগে ঢুকেছি। দেখি লেখা আছে ‘ Write here’। কিছুই না বুঝে ওখানেই ছোট একটু প্যারা বাংলায় লিখে নীচে ‘পোস্ট’ কথাটি দেখে পোস্ট করেছি। আবার ফিরে এসেছি নিজের ওয়ালে। মিনিট পাঁচেকের ভেতর নোটিফিকেশান পেতে শুরু করেছি। আমি তো আঁতকে উঠেছি, আরে! আমাকে আবার কে এতো নোটিফিকেশান পাঠাচ্ছে! ক্লিক করে দেখি সুনামগঞ্জের সৌরভ ভুষন, আর শৈলেন্দ্র আমার লেখার উপর কমেন্ট দিয়েছে। তাদের দু’জনেই আমার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। এই প্রথম আমার লেখার শুরু এবং এই প্রথম আমার লেখা পড়ে কেউ আমার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে।
নিজের লেখার প্রতিভা আবিষ্কারের আনন্দে নিজেই আত্মহারা। তখনও শিখিনি কিভাবে ‘কপি এন্ড পেস্ট’ করতে হয়। জানিনা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে কি করে লেখা সেভ করে রাখতে হয়। প্রতিদিন ‘আলো’তে যাই, ওখানেই লিখি, ওখানেই পোস্ট করি। আমার তো ধারণাতে ছিল না, ‘আলো’তে প্রতি মুহূর্তে সদস্যরা লিখা পোস্ট করে চলেছে। ফলে এক ঘন্টা পরেই নিজের লেখা আর খুঁজে পেতাম না। স্ক্রল ডাউন করতাম, অনেকদূর যাওয়ার পর নিজের লেখা পেতাম। ‘আলো’ থেকে লেখাটি কপি এন্ড পেস্ট করে ফেসবুক ওয়ালে দেয়ার কথাও জানতাম না।
আজ থেকে ঠিক দেড় বছর আগে, ২০১১ এর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি আবিষ্কার করলাম আমার লেখক জীবনের ‘কান্ডারী’ অথবা ‘পথপ্রদর্শক’ আমারই প্রিয় কলামিস্ট ‘পীর হাবীবুর রহমান’ কে। উনাকে আবিষ্কার করেছিলাম আমার ফেসবুক ওয়ালের ডানপাশে ভেসে উঠা ছবি থেকে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি, উনি অ্যাকসেপ্ট করেছেন। উনার আগে আরও বড় বড় বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই একজন আমার রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে আমাকে কৃতার্থ করেছিলেন! আমার সাথে কথা বলেন নি। পীর হাবীব ভাই ব্যতিক্রম। উনি নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলেছেন, কথা বলে উনার মনে হয়েছে, আমি বোধ হয় লেখালেখি করি। আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন, কোথাও লেখালেখি করি কিনা। সবিনয়ে নিজের অক্ষমতার কথা স্বীকার করে, কিছুটা লাজুকভাবেই বলেছিলাম, ‘ আলো’ তে দুই চারটি ফীচার লিখেছি। পড়ে দেখতে পারেন। আমার কাছ থেকে ‘আলো’ ওয়েবসাইটের ঠিকানা নিয়ে উনি আমার লেখা দুই একটা অংশ পড়ে আমাকে ফিরতি জানালেন, আমার ইচ্ছেমত কিছু লিখে উনার কাছে পাঠিয়ে দিতে।
মহা ফাঁপরে পরে গেছি। এত বড় একজন কলামিস্ট আমাকে বলেছে, স্বাধীনভাবে কিছু লিখতে। আমি কী মনে করে যেনো কিশোরীবেলায় বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্মৃতি নিয়ে নাতিদীর্ঘ একখানি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলাম। দুই দিন পর ১৮ই আগস্ট, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়ে গেলো আমার লেখা। পড়ে দেখি, লেখাটি হুবহু ঠিক রেখে হাবীব ভাই নিজ থেকে আরও অনেক তথ্য যোগ করে দারুণ সুন্দর করে ছাপিয়েছেন। নিজেকে লেখক হিসেবে আবিষ্কার করলাম।
এরপর থেকে নিয়মিত বাংলাদেশ প্রতিদিন এ দুটো একটি করে লেখা ছাপা হতে লাগলো। কী বিশ্রী, কী ভীষন কাঁচা লেখা, তারপরেও আমার প্রিয় কলামিস্ট লেখাগুলোকে পরম যত্নে উনার পত্রিকায় ছাপিয়েছেন, আর আমার ভেতর আত্মবিশ্বাসের ভিত রচনা করে গেছেন। এর মধ্যেই একদিন আমি আমার কাজিন অভিজিতের ওয়ালে গেছি, দেখি ওর ওয়ালে জাকারিয়া স্বপনের লেখা একটি লিঙ্ক শেয়ার করা আছে। খুব সম্ভব বাংলাদেশের যানবাহনের উপর ছিল লেখাটি। জাকারিয়া স্বপনের নাম আমি আগেই শুনেছি, পত্র পত্রিকায় উনার লেখা পড়েছি। চুপ করে আমার ওয়ালে এসে সার্চ বারে উনার নাম টাইপ করে উনার প্রোফাইলে গিয়ে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। মনে নেই, কি লিখেছিলাম। হয়ত ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম।
এই যে সার্চ বারে গিয়ে উনার নাম টাইপ করেছি, ওটাও ছিল আমার নিজের আবিষ্কার। কেউ শিখিয়ে দেয়নি। যাই হোক, আমার ভাগ্য ভালো, জাকারিয়া স্বপন অনলাইনেই ছিলেন, রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলেন, মেসেজের উত্তর দিলেন। তখন আমি বললাম, আমি প্রিয় ব্লগে লিখতে চাই, কী করে নাম রেজিস্ট্রেশান করবো, জানিনা। স্বপন ভাই খুব যত্নের সাথে, ধৈর্য্যের সাথে আমাকে ব্লগে নাম রেজিস্ট্রেশান করায় সর্বাংশে সাহায্য করেছিলেন। এমন কি, বলেছিলেন, যা মন চায় লিখে পোস্ট করে দেখতে, পোস্ট হয় কিনা। ৩রা সেপ্টেম্বার, ২০১১ তে আমি লিখেছিলাম ” অর্থহীন রাজনীতি” নামে দুই প্যারাগ্রাফের একটি লেখা। স্বপন ভাইয়ের সাথে কথা হওয়ার আগমুহূর্তে ‘অনিরুদ্ধ অঞ্জন’ নামের এক বন্ধুর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল, রাজনীতি নিয়ে। ব্যস, লিখে ফেললাম ‘অর্থহীন রাজনীতি’। পোস্টও হয়ে গেলো। এই প্রথম সত্যিকারের ব্লগে লেখা শুরু। চোখের সামনে খুলে গেলো ব্লগ দুনিয়া।
ধীরে ধীরে বন্ধু সংখ্যা বাড়ছিল, প্রিয় ব্লগে লিখতে গিয়েই নানারকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফেললাম। আমার লেখাগুলো ছিল আবেগ নির্ভর, সততা নিয়ে লিখতাম, তাই যা মনে আসতো তাই লিখতাম। তখন রাজনীতি বিষয়ক লেখাই বেশী লিখতাম। প্রিয় ব্লগে কিছু গোঁয়ার -গোবিন্দ টাইপ লেখক আছেন, কিছু নোংরা মন্তব্যকারী পাঠকও ছিলেন। তাঁদের মতের সাথে মিল না হলেই তাঁরা যাচ্ছে তাই ভাষায় লেখককে গালিগালাজ করতেন। আমি নারী বলেই যে আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হতো, ভাবা ভুল। কেউ কেউ আমাকে ‘তসলিমা নাসরীনের’ পরিনতির কথা স্মরণ করিয়ে হুমকী দিতো। আরও খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আবার এখানেই পেয়েছি ‘সঞ্চয় রহমান’ নামের অত্যন্ত গুণী, রুচীবান, অতি বিনয়ী ও ভদ্র তরুণকে, যিনি নিজে থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, মন খারাপ করতে না করেছিলেন, সকল নোংরামীকে উপেক্ষা করতে বলেছিলেন।
খারাপের পাশাপাশি আবিষ্কার করলাম দারুণ ভালো কিছু। সঞ্চয়ের কথা আমার হৃদয়ে সঞ্চিত আছে। ওতো শুধুই আমার ছোট ভাইই নয়, আমার স্বজনও সে। মানুষের খারাপ -ভালো প্রসঙ্গটি এনেছি আবিষ্কারের কথা বলতে গিয়ে। প্রিয় ব্লগে লিখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার মধ্যে ধৈর্য্য, মানসিক ও মানবিক সৌনদর্য্য, সহনশীলতা, অপরের মতকে সম্মান করার গুণাবলী আছে, এবং তা খুব বেশী পরিমানেই আছে। আমি টিকে গেলাম ব্লগ রাজ্যে। প্রবেশ করলাম বিডিনিউজ২৪ ব্লগে। এবার নিজে নিজে সব করলাম। শুরু করলাম দ্বিতীয় ব্লগে লেখালেখি। ততদিনে আমার লেখার মান কিছুটা উন্নত হয়েছে।
ব্লগে লেখালেখির সূত্র ধরে আমার অনেক বন্ধু তৈরী হয়েছে। ততদিনে আমার মেয়ে মিশা তার ছোটবোনকে ট্রেনিং দিয়েছে, কী করে মায়ের ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট করে দিতে হবে। মিশা জানতো না, ওর মা এর আগেই অনেক কারিগরী শিখে ফেলেছে। আগে দেখতাম, মিশা, ওর বন্ধুরা প্রায়ই বিভিন্ন সাইন ব্যবহার করে। মিশাকে জিজ্ঞেস করি, ও হাসে। ভাবে হয়তো, কী বিপদে পড়া গেলো, মা এখন তারুণ্যের দিকে হাত বাড়াচ্ছে! এমনিতেই দুই বছরে আমার বন্ধু সংখ্যা চারশ ছাড়িয়ে যেতে দেখে ও কিছুটা ভিরমী খেয়ে গেছে। তার উপর যদি এইসব সাইন শিখে ফেলে, তাহলে তো চিন্তার বিষয়!
আমাকে তো মিশা চিনে না, আমি আমার কাজিন শমিতকে জিজ্ঞেস করেছি, আরেক বন্ধু অঞ্জন খান’কে জিজ্ঞেস করেছি, সাইনগুলো কী করে দিতে হয়! ওরা দুজনই আমাকে চ্যাট বক্সে লিখে পাঠিয়েছে। ওরা সাইন লিখে পাঠায়, আমি নকল করে লিখি, ওরা খুশী হয়, বাহবা দেয়। ভালো স্টুডেন্ট পেয়ে বেশ সন্তুষ্ট হয়।
শমিত আমার বড় মেয়ের চেয়ে দেড় বছরের ছোট। কিন্তু আমার সাথে খুব বন্ধুত্ব। ওকে আমি ‘সত্যজিত রায়’ ডাকি। ও খুব ভালো শর্টফিল্ম বানায়। একদিন আবিষ্কার করলাম, শমিত খুবই সংস্কৃতিমনা এক তরুণ। আমাদের বংশে এই একটি মাত্র ছেলেকে দেখলাম, যে ফিল্ম বানানোর দিকে ঝুঁকেছে, এবং আরও আবিষ্কার করলাম, আমাদের বংশে আমিই একমাত্র মেয়ে যে লেখালেখির দিকে ঝুঁকেছি। এই আবিষ্কারের কারণেই শমিতের সাথে আমার খাতির আরও বেড়ে যায়। ও আমাকে মাঝে মাঝেই পরীক্ষা নেয়, সাইনগুলো মনে আছে কিনা। আমার কমন সাইনগুলো মনে থাকে, কিন্তু বাঘ, হ্যাট, ব্যাং, কান্না এগুলো ভুলে যাই। নিজেকে বোকার বেহদ্য ভাবি। শমিতের মত ছোট একটা ছেলে পর্যন্ত কম্পিউটারের এত কিছু বুঝে, আর আমি বুঝি না। আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
গত পরশুদিন, কোন এক বন্ধুর সাথে চ্যাট করে লাইন অফ করে দিয়েছি। মাউসটা খুব বেগড়বাই করছে। আমি ব্লগ থেকে একটা লেখা কপি করে আমার ওয়ালে পোস্ট করতে চাইছিলাম, মাউস ডান দিকে ক্লিক হচ্ছিলনা, কারসার খুব নড়ছিল। যে বন্ধুর সাথে চ্যাট করেছিলাম, সেই স্ক্রীণটা তখনও খোলা ছিল। কারসারটা নড়াচড়া করতে করতে চ্যাট উইন্ডোর একেবারে নীচের দিকে ‘সাইন এন্ড সিমবল’ এর হালকা ছবির মধ্যে টাচ করতেই সব রকম সিম্বলসহ ‘ সাইন’ বক্স ওপেন হয়ে গেলো! আবিষ্কার করে ফেলেছি! ইয়াহু!!!!!!!! পেয়ে গেছি!!!
এখন বুঝতে পেরেছি, সোনার চাঁদেরা কোথা থেকে আমাকে এত টেকনিক শেখাতো! আমি তো কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ করতাম, আর অঞ্জন, শমিত দুজনেই চুপ করে আমার দেয়া ধন্যবাদগুলো নিয়ে নিত। আমি ভাবতাম, এই রে! দুনিয়া কতদূর এগিয়ে গেছে, ওরা কী সুন্দর নিজে নিজে সিম্বল বানায়, আর আমি কিছুই পারি না! বুঝলাম, লেগে থাকলে কী না হয়! আমিও পারি!
লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেওয়া।