প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জঙ্গিবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। সবাই মিলে তা মোকাবেলা করতে হবে। এর পরিকল্পনাকারী, অর্থ ও অস্ত্রের জোগানদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। সামগ্রিকভাবে এবারের আসেম সম্মেলনে অংশগ্রহণ বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল, দৃশ্যমান ও সুসংহত করেছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আসেম সম্মেলন থেকে ফিরে রোববার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়ে গেছে। তবে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের যে সম্মানের জায়গা তৈরি হয়েছিল, তাতে গুলশান হামলা দেশের ভাবমূর্তির ওপর একটি কলঙ্কলেপন করেছে। দেশের মানুষকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতন ও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি এর বিরুদ্ধে প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে বলেন।
মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটরে ১১তম এশিয়া-ইউরোপ মিটিং (আসেম) সম্মেলনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে রোববার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তার সফরের ওপর একটি লিখিত বক্তব্যের পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন।
গুলশানে হামলার পর কিছু রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখনও ঐক্যের কি বাকি আছে? সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য তো ইতিমধ্যে হয়েই গেছে। গ্রামে গ্রামে কমিটি হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে। অবশ্য, যারা আগুন সন্ত্রাস করে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, যারা যুদ্ধাপরাধী এবং জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িত তাদের কথা আলাদা। তারা ‘সর্প হয়ে দংশন করে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে।’ সরকারপ্রধান বলেন, যাদের ঐক্য হলে সত্যিকারভাবে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দূর করা যাবে, তাদের ঐক্য ঠিকই গড়ে উঠেছে। এই ঐক্য টিকে থাকবে, এটাই বাস্তবতা। এ সংক্রান্ত আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওরা (বিএনপি-জামায়াত) যখন বলে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেই হামলা-গুপ্তহত্যা বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ আলোচনায় না বসলে যেন তারা এসব চালিয়েই যাবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সর্বস্তরের মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে। এখন ঈদের নামাজে সনাতন ধর্মের যুবকরা পাহারা দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অভূতপূর্ব অর্জন। এটাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ বিষয়ে সরকারের অবস্থানের কথাও আসেম সম্মেলনে তুলে ধরেছেন উল্লেখ করে বলেন, আসেমে অংশ নিয়ে আমি জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা বিশ্বনেতাদের জানিয়েছি। শুধু তাই নয়, বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে মদদদাতা, অর্থদাতা ও প্রশিক্ষণদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা, তাই সবাই মিলেই তা মোকাবেলা করতে হবে।
জঙ্গিবাদের অর্থদাতা ও পরামর্শদাতা কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। যারা জঙ্গি হামলা করছে, তারা কী স্বার্থে এ ধরনের হীন কর্মকাণ্ড করছে, সে প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ খুন করে বেহেশতে যাওয়া যায় না। আর উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। কেন এমন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফ্রান্সে মানুষের ওপর ট্রাক চালিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা এদেশেও ঘটেছে। জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর ট্রাক তুলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গুলশান হামলা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আতংক সৃষ্টি করাই সন্ত্রাসীদের মূল উদ্দেশ্য। কয়েকটি শপিংমলে আক্রমণ হবে- এমন খবর পেয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক হয়েছে, পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরাও জনগণকে সচেতন হতে বলেছি। সন্ত্রাস মোকাবেলায় যা যা করা দরকার আমরা তা করছি। তিনি বলেন, এটা চিন্তার বিষয় যে, উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেরাও জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। কারা এদের ব্যবহার করছে, কুপরামর্শ দিচ্ছে, উসকানি দিচ্ছে, তা খুঁজে বের করার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জনগণের সচেতনার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে, প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যে জনগণকে সচেনতার কাজ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি জানান, নেতাকর্মীদের এর বিরুদ্ধে সরব হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন শুরু হয়েছে, যা অব্যাহত থাকবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোনো ধরনের হামলার ঘটনায় বিশ্বনেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে বাংলাদেশের কোনো ঘটনা ঘটলে তা নেতিবাচকভাবে দেশের মিডিয়াই আগে তুলে ধরে। তারাই আগে সেই ঘটনার লাইভ দেখায়, কোথায় লাশ পড়ে আছে, কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, আইনশৃংখলা বাহিনী কী করছে, কী কী অস্ত্র আছে, কমান্ডোরা কী করছে। ফলে জঙ্গিরা আরও সতর্ক হয়। আর বিশ্ব মিডিয়াগুলো সেগুলো প্রকাশ করে। এতে দোষটা কার, সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তিনি এ সময় কয়েকটি গণমাধ্যমের গুলশানের ঘটনার সরাসরি সম্প্রচারের কারণে আইনশৃংখলা বাহিনীর কৌশল ফাঁস হয়ে যাওয়ার কথা পুনরাবৃত্তি করেন।
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা জানান, মঙ্গোলিয়ার উলানবাটরে অনুষ্ঠিত এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ে (আসেম) অংশ নিয়ে তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সব সময় অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, আমাদের আসেম সম্মেলন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে নিরীহ অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়। বিশ্ব সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাংলাদেশও এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এরপর সম্মেলন চলাকালে শুক্রবার রাতে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়। আমরা সেটারও নিন্দা জানাই। কারণ বাংলাদেশ সব সময়ই অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে। তুরস্কের মানুষ সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়ে প্রমাণ করেছেন জনগণই সব ক্ষমতার উৎস।
গুলশান ও শোলাকিয়া হামলা তদন্ত প্রসঙ্গে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার তদন্তে তাজ্জব হয়ে যাওয়ার মতো তথ্য আসছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা হচ্ছে না। যতটুকু বলা প্রয়োজন ততটুকুই বলা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলাও যাবে না। তদন্তের অনেক ধাপ রয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে এগোচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সব তথ্য দেয়া হলে তাজ্জব হয়ে যেতে হবে। তদন্ত শেষে সবাই সবকিছু বুঝতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে বেশি ‘খোঁচাখুঁচি’ না করারও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের কাজ করতে দিতে হবে।
বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী উলানবাটরে যান। তারপর দিন আসেমে অংশগ্রহণসহ রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেসহ অন্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। তিন দিনের সফর শেষে শেখ হাসিনা শনিবার সন্ধ্যায় দেশে ফেরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনাই আসেম সম্মেলনে আলোচনা হয়। তিনি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্ব নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে তার সব ব্যবস্থা বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে, সে কথা তিনি বিশ্বনেতাদের অবহিত করেন বলে জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গুলশান হামলার ঘটনায় জাইকার সহায়তা বা অন্য কোনো প্রকল্পে জাপানের অর্থ ছাড়ে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জানান, এবারের আসেম সম্মেলনে তিনটি দলিল গৃহীত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহারা খাতুন, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। মঞ্চের সামনে মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্য, সংসদ সদস্য এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায় ৫০ মিনিট ধরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।