ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রিকশাচালক বাবার অন্যরকম ডাক্তার মেয়ে

‘আমি ও আমার স্ত্রী সবসময় একটি মেয়ে সন্তান চাইতাম। আমাদের ঘরে তিন ছেলে সন্তান রয়েছে। কিন্তু আমি মনে করতাম আমাদের একটি মেয়ে সন্তান না থাকায় আমাদের অপূর্ণতা রয়েছে।’ কথাগুলো বলছিলেন ৫৫ বছর বয়সী বাবলু শেখ। পেশায় তিনি একজন রিকশাচালক। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি রিকশা চালান।

তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি রিকশাচালক বিধায় আমার যাত্রীদের অনেকেই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন’।

‘একদিনের ঘটনা। প্রতিদিনকার মতো আমি সেদিন রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। এক বাবা তার কলেজপড়ুয়া মেয়েকে কলেজ পৌঁছে দিতে আমাকে ডাকেন। সেই বাবা আমাকে সাবধানে যেতে বললেন। তিনি তার মেয়েকে রিকশা ভালোভাবে ধরে রাখতে বললেন। আর ওই বাবা আমাকে বার বার সাবধানে যেতে বলছিলেন।’ বলেন তিনি।

বাবলু শেখ কিছুটা থেমে আবার বলতে শুরু করেন, ‘আমি আমার রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করি। কিছুদূর যাওয়ার পর আমি শুনতে পাই মেয়েটি কাঁদছে। আমি পেছনে তাকানোর চেষ্টা করতেই মেয়েটি আমাকে সতর্ক করল পেছনে না তাকাতে। আমি চলতে থাকি, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম মেয়েটি কোনো


ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়েটির কথা থেকেই বুঝতে পারলাম, সে ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। এমন সময় মেয়েটি রিকশা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নামল এবং রিকশার সিটের ওপর টাকা ফেলে দৌড়ে রেললাইনের দিকে যেতে থাকল।’

‘আমি রিকশা নিয়ে থেমে গেলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এ সময় ওই মেয়েটির বাবার কথা আমার কানে বাজতে লাগল। মেয়েটির বাবা বলেছিল, মেয়েটিকে যেন আমি সতর্কতার সঙ্গে নিয়ে যাই। আমি রিকশাটি থামিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাই। আমি তাকে বাসায় ফিরে যেতে বলি। সে আমাকে তাচ্ছিল্য করল এবং অপমান করল। আমি মেয়েটিকে একা নির্জন রাস্তায় রেখে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। সে কাঁদল। আমি তাকে থামালাম না। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে সে কাঁদল,’ বলেন বাবলু।

তিনি যোগ করেন, ‘এমন সময় বৃষ্টি শুরু হলো। সে আবার রিকশায় উঠল। আমি তাকে তার বাসার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসলাম। নামার সময় সে আমাকে বলল, চাচা আপনি আর এই জায়গায় আসবেন না। আর কাউকে বলবেন না যে আপনি আমাকে চেনেন।’

‘ওইদিন আমি বাসায় ফিরে আসি। আমি সেদিন কারও সঙ্গে কথা বলিনি। এমন কী কিছু খাইওনি। আমি তখন মনে মনে বলছিলাম, আমার মেয়ে নেই এতেই আমি অনেক খুশি।’

কিছুটা উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, ‘ওই ঘটনার প্রায় আট বছর পর আমি একটি দুর্ঘটনার শিকার হই। আমি জ্ঞান হারাই। স্থানীয় মানুষজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি যখন জ্ঞান ফিরে পাই তখন দেখি আমার পাশে একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করল, কেন আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই নাই। আমি তার কথা বুঝতে পারছিলাম না।’

‘মেয়েটি ছিল সাদা অ্যাপ্রন পরা। আমার চিকিৎসা চলছিল। আমাকে বড় একটি চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলো। আমি শুনতে পেলাম মেয়েটি কাউকে বলছে, স্যার ওই লোকটি আমার বাবা। এরপর চিকিৎসক ইংরেজিতে কিছু বললেন। মেয়েটি আমার ভাঙা হাতটি ধরে উত্তর দিলো, যদি আমার এই বাবা আমাকে আগে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমি চিকিৎসক হতে পারতাম না,’ কথাগুলো বলার সময় চোখ দুটো তার টলোমলো করছিল।

বাবলু শেখ কিছুটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, ‘আমি আপনাকে বুঝাতে পারব না সেই সময়কার অনুভূতির কথাটি। একজন রিকশাচালকের মেয়ে আছে এবং সে একজন চিকিৎসক।’

 

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

রিকশাচালক বাবার অন্যরকম ডাক্তার মেয়ে

আপডেট টাইম : ০৫:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ মে ২০১৭

‘আমি ও আমার স্ত্রী সবসময় একটি মেয়ে সন্তান চাইতাম। আমাদের ঘরে তিন ছেলে সন্তান রয়েছে। কিন্তু আমি মনে করতাম আমাদের একটি মেয়ে সন্তান না থাকায় আমাদের অপূর্ণতা রয়েছে।’ কথাগুলো বলছিলেন ৫৫ বছর বয়সী বাবলু শেখ। পেশায় তিনি একজন রিকশাচালক। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি রিকশা চালান।

তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি রিকশাচালক বিধায় আমার যাত্রীদের অনেকেই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন’।

‘একদিনের ঘটনা। প্রতিদিনকার মতো আমি সেদিন রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। এক বাবা তার কলেজপড়ুয়া মেয়েকে কলেজ পৌঁছে দিতে আমাকে ডাকেন। সেই বাবা আমাকে সাবধানে যেতে বললেন। তিনি তার মেয়েকে রিকশা ভালোভাবে ধরে রাখতে বললেন। আর ওই বাবা আমাকে বার বার সাবধানে যেতে বলছিলেন।’ বলেন তিনি।

বাবলু শেখ কিছুটা থেমে আবার বলতে শুরু করেন, ‘আমি আমার রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করি। কিছুদূর যাওয়ার পর আমি শুনতে পাই মেয়েটি কাঁদছে। আমি পেছনে তাকানোর চেষ্টা করতেই মেয়েটি আমাকে সতর্ক করল পেছনে না তাকাতে। আমি চলতে থাকি, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম মেয়েটি কোনো


ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়েটির কথা থেকেই বুঝতে পারলাম, সে ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। এমন সময় মেয়েটি রিকশা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নামল এবং রিকশার সিটের ওপর টাকা ফেলে দৌড়ে রেললাইনের দিকে যেতে থাকল।’

‘আমি রিকশা নিয়ে থেমে গেলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এ সময় ওই মেয়েটির বাবার কথা আমার কানে বাজতে লাগল। মেয়েটির বাবা বলেছিল, মেয়েটিকে যেন আমি সতর্কতার সঙ্গে নিয়ে যাই। আমি রিকশাটি থামিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাই। আমি তাকে বাসায় ফিরে যেতে বলি। সে আমাকে তাচ্ছিল্য করল এবং অপমান করল। আমি মেয়েটিকে একা নির্জন রাস্তায় রেখে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। সে কাঁদল। আমি তাকে থামালাম না। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে সে কাঁদল,’ বলেন বাবলু।

তিনি যোগ করেন, ‘এমন সময় বৃষ্টি শুরু হলো। সে আবার রিকশায় উঠল। আমি তাকে তার বাসার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসলাম। নামার সময় সে আমাকে বলল, চাচা আপনি আর এই জায়গায় আসবেন না। আর কাউকে বলবেন না যে আপনি আমাকে চেনেন।’

‘ওইদিন আমি বাসায় ফিরে আসি। আমি সেদিন কারও সঙ্গে কথা বলিনি। এমন কী কিছু খাইওনি। আমি তখন মনে মনে বলছিলাম, আমার মেয়ে নেই এতেই আমি অনেক খুশি।’

কিছুটা উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, ‘ওই ঘটনার প্রায় আট বছর পর আমি একটি দুর্ঘটনার শিকার হই। আমি জ্ঞান হারাই। স্থানীয় মানুষজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি যখন জ্ঞান ফিরে পাই তখন দেখি আমার পাশে একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করল, কেন আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই নাই। আমি তার কথা বুঝতে পারছিলাম না।’

‘মেয়েটি ছিল সাদা অ্যাপ্রন পরা। আমার চিকিৎসা চলছিল। আমাকে বড় একটি চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলো। আমি শুনতে পেলাম মেয়েটি কাউকে বলছে, স্যার ওই লোকটি আমার বাবা। এরপর চিকিৎসক ইংরেজিতে কিছু বললেন। মেয়েটি আমার ভাঙা হাতটি ধরে উত্তর দিলো, যদি আমার এই বাবা আমাকে আগে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমি চিকিৎসক হতে পারতাম না,’ কথাগুলো বলার সময় চোখ দুটো তার টলোমলো করছিল।

বাবলু শেখ কিছুটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, ‘আমি আপনাকে বুঝাতে পারব না সেই সময়কার অনুভূতির কথাটি। একজন রিকশাচালকের মেয়ে আছে এবং সে একজন চিকিৎসক।’