ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোরগঞ্জের হাওর যেন অপার সৌন্দর্যের এক লীলাাভূমির পর্যটক

জাকির হোসাইন : কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। কখনও শীতে কখনও বা বর্ষায় হাওর অঞ্চলে দেখা যায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। বর্ষায় সাগরের মতো এখানেও ডুব দেয় চন্দ্র সূর্য তারা। ছবির মতো ভেসে বেড়ায় মাছ ধরার নৌকা। উথাল-পাতাল ঢেউয়ে একাকার জীবন, সাহস জোগায় অন্যদেরও। আছে হিজল তমাল করচ বনের মোহময় হাতছানি। প্রকৃতির অবিচারটুকু বাদ দিলে কিশোরগঞ্জের হাওর যেন অপার সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।
এখন বর্ষার রাজত্ব চলছে হাওরে। যেন কূলহীন সাগর। দ্বীপের মতো ভেসে আছে গ্রামগুলো। জলে নাক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল গাছগুলো যেন দাড়ি-কমার মতো একেকটি বিরাম চিহ্ন। পানির নিচ থেকে জেগে উঠা করচের বন, বরুণ গাছ, নদীতে শুশুকের লাফ-ঝাঁপ দেখার মতো দৃশ্য। সাগরে যেভাবে সূর্য ডুবে, হাওরেও তাই। ভোরে পানির নিচ থেকে উঠে আসা সূর্যকে দেখলে পবিত্র এক অনুভূতি জাগে মনে। রাতের হাওরে ঢেউ আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, অনেকের ঘুম কেড়ে নেয়। যারা এই বৈচিত্র্যময় জনপদ দেখেনি, তাদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম হাওর।
জলে-ভাসা এক জনপদের নাম শিমুলবাগ। এর কিছু দূরেই চোখে পড়ে এক জনমানবহীন ভাসমান বনভূমি। রাংচাবন নামেই ডাকা হয় তাকে। এটি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায়। সারি সারি হিজল-তমাল-করচ গাছ যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। বর্ষায় কাঠবিড়ালিসহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণির আশ্রয় হয়ে উঠে গাছগুলো। আর শীতে মুখরিত হয় পরিযায়ী পাখির কলরবে। স্থানীয় লোকজনই এ বনটিকে দেখে রাখে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রকৃতির খেয়ালেই সৃষ্টি হয়েছে রাংচাবন। অনেকে এ বনটিকে সিলেটের রাতারগুলের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। শীত-বর্ষা দুই ঋতুতেই বাইরের লোকজন সেখানে বেড়াতে যায়। তবে কষ্টসহিষ্ণুরা সেখানে বেশি যায়।
পর্যটন সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে জেলার নিকলীতে হাওরকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল বেড়িবাঁধ। ঈদ-উল্লাসের মতো বিভিন্ন উৎসবে সেখানে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। প্রায় আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে ছোট ছোট বেঞ্চ। সেখানে পানিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে ছোট ছোট নৌকা, স্পিডবোট। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এই বেড়িবাঁধে গিয়ে সেখানে থাকার কোনও উপায় নেই। খাওয়া-দাওয়া ও আবাসন সমস্যার কারণে লোকজন সেখানে অবস্থান করতে পারে না। দিনে গিয়ে দিনে চলে আসতে হয়। আছে নিরাপত্তাসহ আরো কিছু ঝামেলা। তবে এতসব সমস্যার পরও এ বেড়িবাঁধটি জেলার জনপ্রিয় একটি পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে।
হাওরের পানি, মাছ, হিজলবন, পাখপাখালি, সবুজমাঠ ছাড়াও দেখার মতো বেশ কিছু জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের দিল্লির আখড়া ভালো লাগবে সবার। এখানে রয়েছে শত শত হিজল গাছ। চারশো বছরের পুরনো এই আখড়া সম্পর্কে সুন্দর একটি গল্প আছে। এক সাধক নাকি এখানে এসেছিলেন ধ্যান করতে। তার ধ্যান ভাঙার জন্য কিছু দৈত্য তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতো। একদিন এই সাধক মহাবিরক্ত হয়ে তার দিক্ষাগুরুর মন্ত্রবলে এই দৈত্যগুলোকে হিজল গাছ বানিয়ে রাখেন। জায়গাটির নাম দিল্লির আখড়া কিভাবে হলো- সে গল্প ওখানে গেলেই জানা যাবে।
এছাড়া অষ্টগ্রামের প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট কুতুব শাহ মসজিদ, আওরঙ্গজেব মসজিদ, ঈশাখাঁ’র সময়ে নির্মিত ইটনার শাহী মসজিদ, মোঘল আমলে নির্মিত নিকলীর গুরুই মসজিদ হাওর পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে।
বর্ষা শেষে হাওরে যখন পানি কমতে শুরু করে তখন আকাশে সাদা মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়াউড়ি করে ধবল বক। মেহমান হয়ে আসে পরিযায়ী পাখি। হাওরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিজল বনগুলো এসময় চলে যায় এদের দখলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিলগুলোও যেন শাপলা ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। পানি যখন পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে তখন সবুজ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। যেখানেই চোখ যাবে সবুজ আজ সবুজ। এগুলো কৃষকের বোনা বোরোধান। দেখা মিলবে হোগলা বন ও কলমিলতার সঙ্গেও।
হাওরের ডুবোসড়ক ভালো লাগবে সবার। কংক্রিটের তৈরি এ ধরনের সড়ক বর্ষায় তলিয়ে যায়। শুকনো মৌসুমে ভেসে উঠে। ছয়মাস এ সড়ক দিয়ে চলাচল করা যায়। কিশোরগঞ্জ জেলার পুরো হাওরজুড়েই বর্তমানে অসংখ্য ডুবো সড়ক দেখা যায়। যা হাওরবাসীর যোগযোগ ব্যবস্থাকে অনেক সহজ করেছে। এগুলোও দেখার মতো জিনিস। তাছাড়া কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামে উপজেলায় বেশ কয়েকটা বেড়িবাঁধ রয়েছে। এসব বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও গ্রাম চোখে পড়ে না। বাঁধে দাঁড়িয়ে হাওর দেখা সাগর দেখার মতোই উপভোগ্য।
কিশোরগঞ্জের হাওরের পর্যটন সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে হাওরবাসি জানান, বেসরকারীভাবে যদি কোনও প্রতিষ্ঠান হাওরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায় তাহলে সরকার এবং হাওর এলাকার সকলের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

কিশোরগঞ্জের হাওর যেন অপার সৌন্দর্যের এক লীলাাভূমির পর্যটক

আপডেট টাইম : ০৫:৫১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জাকির হোসাইন : কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। কখনও শীতে কখনও বা বর্ষায় হাওর অঞ্চলে দেখা যায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। বর্ষায় সাগরের মতো এখানেও ডুব দেয় চন্দ্র সূর্য তারা। ছবির মতো ভেসে বেড়ায় মাছ ধরার নৌকা। উথাল-পাতাল ঢেউয়ে একাকার জীবন, সাহস জোগায় অন্যদেরও। আছে হিজল তমাল করচ বনের মোহময় হাতছানি। প্রকৃতির অবিচারটুকু বাদ দিলে কিশোরগঞ্জের হাওর যেন অপার সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।
এখন বর্ষার রাজত্ব চলছে হাওরে। যেন কূলহীন সাগর। দ্বীপের মতো ভেসে আছে গ্রামগুলো। জলে নাক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল গাছগুলো যেন দাড়ি-কমার মতো একেকটি বিরাম চিহ্ন। পানির নিচ থেকে জেগে উঠা করচের বন, বরুণ গাছ, নদীতে শুশুকের লাফ-ঝাঁপ দেখার মতো দৃশ্য। সাগরে যেভাবে সূর্য ডুবে, হাওরেও তাই। ভোরে পানির নিচ থেকে উঠে আসা সূর্যকে দেখলে পবিত্র এক অনুভূতি জাগে মনে। রাতের হাওরে ঢেউ আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, অনেকের ঘুম কেড়ে নেয়। যারা এই বৈচিত্র্যময় জনপদ দেখেনি, তাদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম হাওর।
জলে-ভাসা এক জনপদের নাম শিমুলবাগ। এর কিছু দূরেই চোখে পড়ে এক জনমানবহীন ভাসমান বনভূমি। রাংচাবন নামেই ডাকা হয় তাকে। এটি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায়। সারি সারি হিজল-তমাল-করচ গাছ যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। বর্ষায় কাঠবিড়ালিসহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণির আশ্রয় হয়ে উঠে গাছগুলো। আর শীতে মুখরিত হয় পরিযায়ী পাখির কলরবে। স্থানীয় লোকজনই এ বনটিকে দেখে রাখে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রকৃতির খেয়ালেই সৃষ্টি হয়েছে রাংচাবন। অনেকে এ বনটিকে সিলেটের রাতারগুলের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। শীত-বর্ষা দুই ঋতুতেই বাইরের লোকজন সেখানে বেড়াতে যায়। তবে কষ্টসহিষ্ণুরা সেখানে বেশি যায়।
পর্যটন সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে জেলার নিকলীতে হাওরকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল বেড়িবাঁধ। ঈদ-উল্লাসের মতো বিভিন্ন উৎসবে সেখানে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। প্রায় আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে ছোট ছোট বেঞ্চ। সেখানে পানিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে ছোট ছোট নৌকা, স্পিডবোট। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এই বেড়িবাঁধে গিয়ে সেখানে থাকার কোনও উপায় নেই। খাওয়া-দাওয়া ও আবাসন সমস্যার কারণে লোকজন সেখানে অবস্থান করতে পারে না। দিনে গিয়ে দিনে চলে আসতে হয়। আছে নিরাপত্তাসহ আরো কিছু ঝামেলা। তবে এতসব সমস্যার পরও এ বেড়িবাঁধটি জেলার জনপ্রিয় একটি পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে।
হাওরের পানি, মাছ, হিজলবন, পাখপাখালি, সবুজমাঠ ছাড়াও দেখার মতো বেশ কিছু জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের দিল্লির আখড়া ভালো লাগবে সবার। এখানে রয়েছে শত শত হিজল গাছ। চারশো বছরের পুরনো এই আখড়া সম্পর্কে সুন্দর একটি গল্প আছে। এক সাধক নাকি এখানে এসেছিলেন ধ্যান করতে। তার ধ্যান ভাঙার জন্য কিছু দৈত্য তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতো। একদিন এই সাধক মহাবিরক্ত হয়ে তার দিক্ষাগুরুর মন্ত্রবলে এই দৈত্যগুলোকে হিজল গাছ বানিয়ে রাখেন। জায়গাটির নাম দিল্লির আখড়া কিভাবে হলো- সে গল্প ওখানে গেলেই জানা যাবে।
এছাড়া অষ্টগ্রামের প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট কুতুব শাহ মসজিদ, আওরঙ্গজেব মসজিদ, ঈশাখাঁ’র সময়ে নির্মিত ইটনার শাহী মসজিদ, মোঘল আমলে নির্মিত নিকলীর গুরুই মসজিদ হাওর পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে।
বর্ষা শেষে হাওরে যখন পানি কমতে শুরু করে তখন আকাশে সাদা মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়াউড়ি করে ধবল বক। মেহমান হয়ে আসে পরিযায়ী পাখি। হাওরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিজল বনগুলো এসময় চলে যায় এদের দখলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিলগুলোও যেন শাপলা ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। পানি যখন পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে তখন সবুজ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। যেখানেই চোখ যাবে সবুজ আজ সবুজ। এগুলো কৃষকের বোনা বোরোধান। দেখা মিলবে হোগলা বন ও কলমিলতার সঙ্গেও।
হাওরের ডুবোসড়ক ভালো লাগবে সবার। কংক্রিটের তৈরি এ ধরনের সড়ক বর্ষায় তলিয়ে যায়। শুকনো মৌসুমে ভেসে উঠে। ছয়মাস এ সড়ক দিয়ে চলাচল করা যায়। কিশোরগঞ্জ জেলার পুরো হাওরজুড়েই বর্তমানে অসংখ্য ডুবো সড়ক দেখা যায়। যা হাওরবাসীর যোগযোগ ব্যবস্থাকে অনেক সহজ করেছে। এগুলোও দেখার মতো জিনিস। তাছাড়া কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামে উপজেলায় বেশ কয়েকটা বেড়িবাঁধ রয়েছে। এসব বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও গ্রাম চোখে পড়ে না। বাঁধে দাঁড়িয়ে হাওর দেখা সাগর দেখার মতোই উপভোগ্য।
কিশোরগঞ্জের হাওরের পর্যটন সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে হাওরবাসি জানান, বেসরকারীভাবে যদি কোনও প্রতিষ্ঠান হাওরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায় তাহলে সরকার এবং হাওর এলাকার সকলের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।