বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রোহিঙ্গাদের ফেরত না-নিতে নতুন কৌশল এঁটেছে মিয়ানমার। প্রতিদিন ৩০০ রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার যে প্রস্তাব দেশটি করেছে, এর সঙ্গে ‘নাগরিক’ শব্দ যুক্ত করে নামমাত্র প্রত্যাবাসনের পথে এগোতে চাইছে দেশটি। কারণ গত ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দুই দফায় নাগরিকত্ব পাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি নয়। এমনকি পালিয়ে আসা ওই সব রোহিঙ্গার কাছে এখন আর সে কাগজটুকুও অবশিষ্ট নেই। আর থাকলেও মিয়ানমার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের দোহাই দিয়ে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করতে পারে। কারণ ওই আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় দেশটি।
অন্যদিকে, নিজেরাই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিয়ে বিলম্বের জন্য বাংলাদেশকে দুষছে মিয়ানমার। দেশটির নেত্রী অং সান সুচির একজন মুখপাত্র বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য কোটি কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তা হাতে পাওয়ার আগে বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় কি না-সে বিষয়েই তাদের সন্দেহ রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটি দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে একধরনের উত্তেজনা ও বৈরী পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মিয়ানমার চাইছে বাংলাদেশকে সে ফাঁদে ফেলতে। তা হলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি অন্য খাতে প্রবাহিত করতে পারবে।
মিয়ানমারের এই দুই নতুন কৌশলে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ। বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে কূটনৈতিক মহলে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, অবশ্যই বাংলাদেশে মিয়ানমারের এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করবে না। এই দোষারোপ ও প্রস্তাবের বিপক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরবে। এসব যে মিয়ানমারের কৌশল এবং বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি চায় না, তার পক্ষে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রকে লিখিতভাবে জানাবে। এমনকি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে এ-সংক্রান্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, মিয়ানমারের অযৌক্তিক কোনো প্রস্তাব বাংলাদেশ মেনে নেবে না। আমরা চাই, কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হোক। আশা করছি, মিয়ানমারের বোধোদয় হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান পাব।
সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মিয়ানমারের এমন প্রস্তাব ও দোষারোপকে রোহিঙ্গা ইস্যুকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার কৌশল হিসেবেই দেখছেন। তারা বলছেন, এগুলো ‘অগ্রহণযোগ্য’ ও ‘অযৌক্তিক’। অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার এখন বেকায়দায় পড়েছে। ভবিষ্যতে এই চাপ আরো বাড়বে। এমন অবস্থায় নামমাত্র রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানকে প্রলম্বিত করতে চায়। পাশপাশি দুই দেশের মধ্যেকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একধরনের উত্তেজনাও তৈরি করতে চাইছে। বাংলাদেশ সে ফাঁদে পা দিলে রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি সরে যেতে পারে। তাতে মিয়ানমার সুবিধা পাবে।
‘কিন্তু বাংলাদেশের সে ফাঁদে পা দেওয়া উচিত হবে না’-উল্লেখ করে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের এসব প্রস্তাব ও অভিযোগ হাস্যকর। বাংলাদেশ কী বলেছে যে অত্যাচার করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে? আমরা কি বিদেশি সহায়তা চেয়েছি? এটি মিয়ানমারের পূর্বপরিকল্পিত। সুতরাং বাংলাদেশকে তৈরি থাকতে হবে। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুকে অন্য খাতে প্রবাহিত করতে চায়। এ জন্য অজুহাত তৈরি করছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের এসব প্রস্তাব গ্রহণ করবে না। এগুলো অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক।
১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৩০০ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত নেওয়ার পরিকল্পনা করছে মিয়ানমার। গত সোমবার ব্যাংককে নির্বাসিত মিয়ানমারের কয়েকজন সাংবাদিক পরিচালিত সংবাদমাধ্যম ইরাবতী এ খবর জানিয়েছে। এই প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়ায় যৌথ ঘোষণার চারটি প্রধান নীতি অনুযায়ী যাচাইয়ের পর রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে দেশটি। দেশটির শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মিন্ট কাইং বলেছেন, তারা শনাক্ত করে, মিয়ানমারে যাদের বসবাস ছিল এবং এমন প্রমাণ যারা দেখাতে পারবে, শুধু তাদের ফেরত নেওয়া হবে। প্রতিদিন একটি চেক পয়েন্টে প্রায় ১৫০ জনকে যাচাই-বাছাই করতে পারব। এরপর তাদের মংডু শহরের দারগিই জার গ্রামে পুনর্বাসিত করা হবে।
বিশ্লেষকরা মিয়ানমারের এ প্রস্তাবকে সব রোহিঙ্গার ফেরত না-নেওয়ার ‘কৌশল’ হিসেবেই দেখছেন। তারা বলেন, নাগরিকত্বের শর্ত জুড়ে দেওয়ায় মিয়ানমার যে সবাইকে ফেরত নিতে চায় না-তা স্পষ্ট। আর যদি নেওয়াও হয়, তাহলেও দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। হিসাব করে তারা জানান, প্রতিদিন ৩০০ জন করে ফেরত নিলে, বাংলাদেশে বর্তমানে অবস্থানরত আনুমানিক ১০ লাখ রোহিঙ্গার ফেরত যেতে সময় লাগবে নয় বছরের কিছু বেশি সময়। আর সেই হিসাবে গেল দুই মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ছয় লাখ রোহিঙ্গার ফিরতে লাগবে সাড়ে পাঁচ বছর।
বিশ্লেষকরা এমনও বলছেন, মিয়ানমার নাগরিকত্বের যে শর্ত জুড়ে দিয়েছে, তাতে ১৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। এর পক্ষে তথ্য দিয়ে তারা জানান, ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ২০১৪ সালে মিয়ানমারে পুনরায় নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তখন বিশেষ শর্তে মাত্র চার হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। পরে ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গাদের কাছে যে অস্থায়ী অধিবাসী কার্ড ছিল, সেটাও বাতিল করে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। সু চি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ সালের জুনে আবারও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আরো ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাঙালি পরিচয়ে নাগরিকত্ব পায়। সে হিসাবে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পারার মতো রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ হাজার। ফলে মিয়ানমার অনেক হিসাব-নিকাশ করেই ১৯৭৮ সালের ফর্মুলা না এনে, ১৯৯২ সালের ফর্মুলার কথা বলছে। তবে বর্তমানে এই সংখ্যক রোহিঙ্গাও তাদের নাগরিকত্বের কাগজপত্র দেখাতে পারবে না বলে জানিয়েছেন সম্প্রতি কক্সবাজার ঘুরে আসা এক কূটনীতিক। তিনি বলেন, প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সঙ্গে কিছুই আনতে পারেনি। আগুনে ঘরবাড়ির সঙ্গে সবকিছুই পুড়ে গেছে।
‘আর মিয়ানমার যদি প্রতিদিন ৩০০ করে নেয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত এই ১৪ হাজার রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে’ উল্লেখ করে গবেষকরা জানান, এর আগেও মিয়ানমার ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তি ভঙ্গ করেছে। দ্বিতীয় দফার এ চুক্তি অনুযায়ী, সে বছরের ১৫ মে থেকে ছয় মাসের মধ্যে সব রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও তা মানেনি মিয়ানমার। শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত-দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়। ওই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এখনো প্রায় ২২ হাজার শরণার্থী প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানাধীন কুতুপালং এবং টেকনাফ থানাধীন নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে।
অন্যদিকে, বিশ্লেষকরা মিয়ানমারের এ ধরনের দোষারোপ অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, মানবিক কারণে আপাতত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও তাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় দুই দেশের বৈঠকে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সম্প্রতি মিয়ানমারে যান বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সেখানে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ ১০ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। তবে ওই ১০ দফা প্রস্তাবের বিষয়ে মিয়ানমার এখনো সম্মতি দেয়নি। এমনকি তারা এখন কফি আনান কমিশন সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেও জানিয়ে দিয়েছে।
কেন মিয়ানমার এমন কৌশল নিচ্ছে এবং বাংলাদেশেরই বা করণীয় কী-জানতে চাইলে অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিতে চায় না। বাহানা করছে। তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের কোনো কাগজপত্রই দেয়নি। নাগরিকত্বই তো দেয়নি। সেখানে কী কাগজ দেখাবে? কী নাগরিকত্ব দেখাবে? তারা যে সে দেশের অধিবাসী, তার প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এদের সন্তানের সেখানকার স্কুল-কলেজে পড়ত, প্রতিবেশীরা চেনে, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। এসবও প্রমাণ।
‘এসবের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার টালবাহানা করছে’ মন্তব্য করে এই গবেষক বলেন, তারা যে বিদেশি সহায়তার কথা বলছে, সেটা বিশ্বজুড়ে রয়েছে। একে আন্তর্জাতিক ভাষায় ‘বার্ডেন শেয়ারিং’ বলে। শরণার্থীদের সহায়তার নিয়ম পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। এ রকম সাহায্য পায়। এটাও মিয়ানমারের আরেক বাহানা। আরেকটি প্রতারণা। অথচ বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত দিতে নানা চেষ্টা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চাইছে। তার মানে এসব বলে মিয়ানমার দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করতে চাইছে। তা হলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশকে সে ফাঁদে পা দেওয়া উচিত হবে না। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।
সাবেক কূটনীতিক মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলে, অবশ্যই বাংলাদেশ মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেবে না। বিশ্বকে বোঝাতে হবে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। কোনো বিরোধ নেই। মিয়ানমারের এসব প্রস্তাব বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না। এগুলো অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক।