বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ একাদশ সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, আওয়ামী লীগ সরকার ততই মরিয়া হয়ে উঠছে; বিরোধী দল বিশেষভাবে বিএনপিকে নানাভাবে হয়রানি করে নাস্তানাবুদ করতে। সুস্থ ধারায়, রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে ঘায়েল করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এখন সম্ভাব্য সবকিছু করে চলেছে ক্ষমতা ধরে রাখতে। একটা গণতান্ত্রিক সরকার চালাতে ও রাষ্ট্রের সুশাসনকে প্রকৃতপক্ষেই অগ্রাধিকার দিয়ে চলতে হলে যে নূ্যনতম সদাচার করতে হয় সব নাগরিকের সঙ্গে, সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে, তাদের কর্মী-নেতাদের সঙ্গে; তার ধারে-কাছে নেই তারা। সমানে মিথ্যাচার করছে আর সব দোষ দিচ্ছে বিরোধী দল, বিশেষভাবে বিএনপির ওপরে।
সম্প্রতি পুলিশ ‘গায়েবি মামলা’ করছে বিএনপি কর্মীসহ আরও কিছু বিরোধীদলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে। এক/দুটি নয়; শত শত মামলা করছে পুলিশ। মিথ্যা মামলা করতে করতে পুলিশ এমনি দিশেহারা হয়ে পড়েছে যে, মৃত মানুষ, জেল-বন্দি বা প্রবাসী লোকজনও এসব মামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না। যে লোকটির মামলার ঘটনাস্থলে (অপরাধ সংঘটনস্থল) উপস্থিত থাকার সুযোগই নেই; সেই মানুষকেও মামলায় জড়ানো হচ্ছে। দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সমানে প্রতিবাদ করে চলেছে এসব গায়েবি ও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব বিশ্ব-সংস্থা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। ওইসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে অনুরোধ করে চলেছে তারা একযোগে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের হেলদোল নেই সে ব্যাপারে। বরং পুলিশ দিয়ে মিথ্যা মামলা করার অপতৎপরতা অব্যাহত রাখছে সমান উদ্যমে। শান্তিপূর্ণ জনসভা থেকে ঘরে ফেরার সময় কর্মীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর ওইসব ভুয়া মামলায় জড়াচ্ছে পুলিশ। দেশের সংবাদপত্রগুলো ও টেলিভিশন মিডিয়াও এসব মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে কথা বলছে। তবে সরকারের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে- ‘যতই চিল্লাও, কানে দিয়েছি তুলো’। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তার দৃশ্যমান তৎপরতা থেকে সুস্পষ্ট- বিরোধী দল বিশেষভাবে বিএনপিকে যে কোনোভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। তার মূল কারণও পরিস্কার-বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের পরাজয় সুনিশ্চিত। সারাদেশে গুম-খুন, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা, সামগ্রিক সুশাসন সংকট, ঘুষ-দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম, অর্থনৈতিক লুটপাট, বাজারদরের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে মানুষ দিশেহারা। এসব মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে কেন! কোন যুক্তিতে? এ দেশের মানুষ ভালোভাবে খেতে-পরতে না পারলেও তারা এখন অনেক সচেতন। তারা আওয়ামী লীগের দুঃশাসন অনুভব করেছে হাড়ে হাড়ে। তার জবাব তারা ভোটের মাধ্যমে দিতে চায় আগামী নির্বাচনে। সেটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেই আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্ব ২০১৪ সালের ‘মোডিফায়েড এডিশন’ নির্বাচন করতে চায়। তাদের ক্ষমতা লাভ শতভাগ নিশ্চিত করতে চায়।
এখন সবচেয়ে গুরুত্ববহ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, পুলিশকে দিয়ে হাজার হাজার মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বিরোধী দলের কর্মী-নেতাদের মাঝে ‘ট্রমা’ সৃষ্টি করে এ সরকার কী অর্জন করতে চায়? এর একটা সাইড অ্যাফেক্ট হলো, আগামী দিনে এই অপরাজনীতি আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে; আসতে বাধ্য। তার ওপর, এখনকার সময়েই এর বড় সাইড অ্যাফেক্ট হয়ে এই সরকারের জন্য ভয়ানক সংকট সৃষ্টি করবে নিশ্চিতভাবে। পুলিশ মিথ্যা মামলা করতে করতে, চরম অসাধু রাষ্ট্রীয় কর্মচারী হয়ে পড়বে অবধারিতভাবে। তখন পুলিশকে দিয়ে যথাযথভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
পুলিশ বেসামরিক নাগরিকদের সব ধরনের নিরাপত্তা সুরক্ষা দেওয়ার কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ। একটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর রাষ্ট্রের আইনসঙ্গত সমাজ কায়েম রাখা ও তাদের উপযুক্ত নিরাপত্তা বিধানই প্রধান কাজ-‘ দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন’ নীতি অনুসারে। সেই কাজে যে প্রধান শৃঙ্খলার বিষয়, তা হচ্ছে তার পেশাগত সততা সংরক্ষণ। সেটি অপরিহার্য। যে পুলিশকে দিয়ে রাজনৈতিক দলের সরকার চরম অসাধুতা করে অগণন মিথ্যা মামলা দেয় বিরোধী দলের কর্মী, মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে; সেই পুলিশের পেশাগত সততা কীভাবে থাকবে! আর সরকারের শীর্ষ নেতারা যখন পুলিশকে বিরোধী দলের কর্মী ও নেতাদের দমনে অবৈধ শক্তি প্রয়োগে বাড়াবাড়ি ও জুলুমবাজি করে, তখন সেই পুলিশ পেশাগত সততা হারিয়ে ফেলে।
তার নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যায়। এমনিতেই আমাদের দেশের পুলিশ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে (বা তারও আগে থেকেই; এ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই) শুরু করে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া এবং অহরহ ঘুষ-বাণিজ্য চালাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেই পুলিশ কীভাবে অপরাধী ধরবে! যে পুলিশ বাহিনী নিজেই অপরাধী হয়ে পড়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে সুনাগরিকদের বিরুদ্ধে; সে অপরাধ দমনে নিরপেক্ষ অবস্থান নেবে কীভাবে? কীভাবে ডাকাত, খুনি ধরে ‘টাকা খেয়ে’ ছেড়ে না দিয়ে নিজের লোভ সামলাবে? তার মধ্যে কি সেই নৈতিকতা অবশিষ্ট থাকতে পারে? কোনোভাবেই পারে না। নীতি-নৈতিকতা এমনই এক বিষয়, সেটা প্রতিটি নাগরিকের জীবনাচারের সর্বক্ষেত্রে একটানা ধরে রাখতে হয়, অনুশীলন করতে হয়। তার ব্যত্যয় ঘটানো চলে না; এক মুহূর্তের জন্যও না।
পুলিশের অবস্থানটি একটি সীমাহীন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান সবদিক বিবেচনায়। তার হাতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র, যা রাষ্ট্র প্রদত্ত। সেই আগ্নেয়াস্ত্র নাগরিক সমাজকে রক্ষা করতে পারে, আবার তা দিয়ে নাগরিকদের অবিরাম ব্ল্যাকমেইল করতে পারে; ভয় দেখিয়ে ট্রমা সৃষ্টি করতে পারে। সেই আগ্নেয়াস্ত্র যেমন নাগরিক শান্তি রক্ষা করতে পারে, আবার সেই অস্ত্র নাগরিকদের শান্তির ঘুম কেড়ে নিতে পারে। রাষ্ট্র প্রদত্ত আগ্নেয়াস্ত্রটির দায়িত্বশীল ও সৎ ব্যবহারের একমাত্র উপায় হচ্ছে এর যথাযথ প্রয়োগ। যখন মিথ্যা মামলা দেওয়ার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা হয় পুলিশকে, সেই পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্রকে ব্ল্যাকমেইলিং কাজে ব্যবহার করবে নিশ্চিতভাবে। তখন পুলিশ রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী না হয়ে হবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী।
এ ধরনের রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর মিথ্যাচার ও অসাধুতা আমাদের রাষ্ট্রকে ‘দেশপ্রেমবোধহীন’ নাগরিকে ভরিয়ে দেবে। কারণ, যেসব নাগরিক পাইকারি হারে ‘গায়েবি’ ও মিথ্যা মামলার শিকার হবে, তাদের মধ্যে এই রাষ্ট্রের প্রতি কোনো দায়বোধ থাকবে না। তা থাকতে না পারাই যৌক্তিক। তারা ভয়ানক ‘ট্রমা’য় আক্রান্ত হবে। তাদের স্বজনদের মাঝেও একই ধরনের ট্রমা সৃষ্টি হবে।
আমাদের রাষ্ট্রনেতারা যারা রাষ্ট্র-প্রশাসন চালান, তারা এই কঠিন সত্যটি কেন বুঝতে চান না? শুধুই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য? দলবাজি আর ক্ষমতাবাজি নয়; রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণ চাই আমাদের ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের কাছে। তাদেরকে বুঝতে হবে, গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে- ক্ষমতা থাকলেই রাষ্ট্রনায়কের সুনাম পাওয়া যাবে না।