ঢাকা , রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ৩ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মা পিঠা বিক্রি করে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় রাজধানী ঢাকার অনেকেই চেষ্টা করেন অর্থকরী ছোট-বড় যে কোনো কাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখতে। চাকরিজীবীরাও চাকরির পাশাপাশি অন্য কাজ করেন। এমনই একজন গৃহিণী নুরুন নাহার। শৈশবে সখের বশে বানানো পিঠাই যে এক দিন খুলে দেবে সম্ভাবনার দুয়ার-ভাবতে পারেননি। বাণিজ্যিকভাবে পিঠা বিক্রি করে তিনি ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চুকিয়েছেন পিঠা বিক্রির রোজগারের টাকা থেকেই।

সেই ছেলে যখন ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব’ হিসেবে পরিচিতি পেলেন, নুরুন নাহারের গর্ব আকাশ ছুঁতেই পারে! বাঙালি সংস্কৃতি পিঠা খাওয়া সংস্কৃতির বড় একটি অংশ দখল করে থাকলেও নগরজীবনে ব্যস্ত মানুষের সময় হয় না পিঠা বানানোর। এদের কেউ কেউ বাজারে বানানো পিঠা খান। যদিও সেই পিঠার স্বাদ ও মান ঘরে তৈরি পিঠার মতো হয় না। এ শূন্যস্থান থেকেই প্রতিষ্ঠা পেল নুরুন নাহার পিঠাঘর। গৃহিণী নুরুন নাহার নিজের ঘরে গড়ে তুলেছেন পিঠাঘর। সৌখিন্যের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছেন পিঠেপুলির কারবারি। পিঠাঘরের কারখানা তার ফ্ল্যাটের রান্নাঘরেই।

নুরুন নাহার পিঠাঘর প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে আটপৌরে একটি ইতিহাস। নুরুন নাহারের মা খুব সুন্দর পিঠা বানাতেন। সাত আট বছর বয়সে তিনি একদিন মাকে বললেন, আমাকেও একটু দাও, পিঠা বানাই। আবদার শুনে মা বললেন, হ্যাঁ, নাও বানাও। বানাতে বানাতেই শিখবে। এখন পারবে না, আস্তে আস্তে করো।

কাঁচা হাতে পিঠা বানাতে শুরু করলেন তিনি। কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর মা অনুপ্রেরণা দিয়ে বললেন, সুন্দর হচ্ছে তোমার পিঠাগুলো। পিঠা বানানোয় উৎসাহ বাড়ল আরও।

ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটল দীর্ঘদিন পর, পরবর্তী প্রজন্মের বাস্তববাদী চিন্তায়। নুরুন নাহার তখন বিয়ে থা করে রীতিমতো সংসারি। এক দিন তার মেয়ে বলেন, ‘আম্মু, তুমি এত সুন্দর পিঠা বানাতে পারো। এখন তো বিভিন্ন জায়গায় পিঠা বিক্রি হয়। দেখো, তোমার পিঠাগুলোও বিক্রি হবে।’ নুরুন নাহার এটাকে অনেক কষ্টের ব্যাপার হিসেবে অভিহিত করলেও মেয়ে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘না, তুমি পারবে’।

তখন তাদের বাসার নিচে ছোট্ট একটা দোকান ছিল। সেই দোকানদারও জানতেন ‘পিঠা কারিগরের’ গুণপনার খবর; কদরও বুঝতেন। এক দিন দোকানদার বললেন, ‘ভাবি, আমার দোকানের জন্য কিছু পিঠা তৈরি করে দেন। বিক্রি করব।’

প্রতিশ্রুতি মোতাবেক পিঠা তৈরি করে দিলেন। তবে পরিমাণে অল্প। বিক্রি হয়ে গেল সব পিঠা। উৎসাহ পেলেন নুরুন। শুরু হলো নতুন যাত্রা; বিন্দু থেকে বৃত্ত অভিমুখী। কুটির শিল্পের গণ্ডি পেরিয়ে নুরুন নাহারের পিঠা পেয়েছে বাণিজ্যিক রূপ। এসেছে নিজস্ব ‘ব্যানার’ও।

পিঠা বিক্রির টাকাতেই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন তিনি। ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব’ হিসেবে পরিচিত সেই ছেলে এখন পিঠা তৈরিতে মাকে সাহায্য করেন। পিঠাঘর নিয়েছে পারিবারিক রূপ। চাহিদার জোগান দিতে নুরুন নাহারের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তার ছেলে-মেয়ে ও স্বামী। চারজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাদ ছড়াচ্ছে পিঠাঘর। পিঠার মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকেই বাইরের কাউকে চাকরিতে রাখেননি নুরুন নাহার।

নুরুন নাহার জানান, শীতের সিজনেই পিঠা বেশি বিক্রি হয়। মোট ৩০ আইটেমের পিঠা বানাতে পারঙ্গম তিনি। বাইরের অর্ডার এলেই সব ধরনের পিঠা সরবরাহ করেন। অন্যদিকে দোকানে বিক্রির জন্য দেন শুধু তিন আইটেমের পিঠা। আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। বৈশাখী উৎসবে যথারীতি এবারও বাইরে থেকে বেশ কিছু অর্ডার পেয়েছেন তিনি।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তার স্বামী অফিস থেকে ফেরার পর শুরু হয় পিঠা বানানো। দেড়শ থেকে দুইশর মতো পিঠা বানানো হয়। দোকানে পিঠা দেওয়ার পর সব পিঠাই বিক্রি হয়ে গেলে নুরুন নাহার বুঝতে পারেন, অনেক মানুষের পিঠা খাওয়ার ইচ্ছা আছে কিন্তু বানানোর মতো ধৈর্য এবং সময় নেই।

নুরুন নাহার পিঠাঘরের স্বত্বাধিকারী নুরুন নাহার স্বনির্ভর হওয়ার গল্প শুনিয়ে বলেন, মেয়েরা উপার্জন করলে কারও কাছে হাত পাততে হয় না। এ টাকা দিয়েই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছি।

দোকানে বিক্রিতব্য পিঠার ওপর স্টিকার সাঁটানো থাকে। তাতে লেখা থাকে ‘হোম মেড’। পিঠার নাম ও দাম লেখা থাকায় ক্রেতারা সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন পিঠা কেনা বা না কেনার বিষয়ে।

নানা রকম উপাদান ব্যবহার করে শৈল্পিক পিঠা বানান নুরুন নাহার। বক্সে সাজানো পিঠায় দেওয়া থাকে ফোন নম্বরও। খেয়ে কারও ভালো লাগলে পরে যোগাযোগ করে আরও পিঠা নিতে পারেন। অর্ডার দিতে পারেন পারিবারিক কিংবা সামাজিক যে কোনো উৎসব ও অনুষ্ঠানের জন্যও। শৈশবের কৌতূহলে শেখা পিঠা বিক্রিই যে হয়ে উঠবে জীবিকার অন্যতম উৎস, ভাবলে এখন বিস্মিত হতে হয় নুরুন নাহারকে; অন্যদের তো বটেই!

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

মা পিঠা বিক্রি করে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার

আপডেট টাইম : ০৭:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় রাজধানী ঢাকার অনেকেই চেষ্টা করেন অর্থকরী ছোট-বড় যে কোনো কাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখতে। চাকরিজীবীরাও চাকরির পাশাপাশি অন্য কাজ করেন। এমনই একজন গৃহিণী নুরুন নাহার। শৈশবে সখের বশে বানানো পিঠাই যে এক দিন খুলে দেবে সম্ভাবনার দুয়ার-ভাবতে পারেননি। বাণিজ্যিকভাবে পিঠা বিক্রি করে তিনি ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চুকিয়েছেন পিঠা বিক্রির রোজগারের টাকা থেকেই।

সেই ছেলে যখন ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব’ হিসেবে পরিচিতি পেলেন, নুরুন নাহারের গর্ব আকাশ ছুঁতেই পারে! বাঙালি সংস্কৃতি পিঠা খাওয়া সংস্কৃতির বড় একটি অংশ দখল করে থাকলেও নগরজীবনে ব্যস্ত মানুষের সময় হয় না পিঠা বানানোর। এদের কেউ কেউ বাজারে বানানো পিঠা খান। যদিও সেই পিঠার স্বাদ ও মান ঘরে তৈরি পিঠার মতো হয় না। এ শূন্যস্থান থেকেই প্রতিষ্ঠা পেল নুরুন নাহার পিঠাঘর। গৃহিণী নুরুন নাহার নিজের ঘরে গড়ে তুলেছেন পিঠাঘর। সৌখিন্যের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছেন পিঠেপুলির কারবারি। পিঠাঘরের কারখানা তার ফ্ল্যাটের রান্নাঘরেই।

নুরুন নাহার পিঠাঘর প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে আটপৌরে একটি ইতিহাস। নুরুন নাহারের মা খুব সুন্দর পিঠা বানাতেন। সাত আট বছর বয়সে তিনি একদিন মাকে বললেন, আমাকেও একটু দাও, পিঠা বানাই। আবদার শুনে মা বললেন, হ্যাঁ, নাও বানাও। বানাতে বানাতেই শিখবে। এখন পারবে না, আস্তে আস্তে করো।

কাঁচা হাতে পিঠা বানাতে শুরু করলেন তিনি। কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর মা অনুপ্রেরণা দিয়ে বললেন, সুন্দর হচ্ছে তোমার পিঠাগুলো। পিঠা বানানোয় উৎসাহ বাড়ল আরও।

ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটল দীর্ঘদিন পর, পরবর্তী প্রজন্মের বাস্তববাদী চিন্তায়। নুরুন নাহার তখন বিয়ে থা করে রীতিমতো সংসারি। এক দিন তার মেয়ে বলেন, ‘আম্মু, তুমি এত সুন্দর পিঠা বানাতে পারো। এখন তো বিভিন্ন জায়গায় পিঠা বিক্রি হয়। দেখো, তোমার পিঠাগুলোও বিক্রি হবে।’ নুরুন নাহার এটাকে অনেক কষ্টের ব্যাপার হিসেবে অভিহিত করলেও মেয়ে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘না, তুমি পারবে’।

তখন তাদের বাসার নিচে ছোট্ট একটা দোকান ছিল। সেই দোকানদারও জানতেন ‘পিঠা কারিগরের’ গুণপনার খবর; কদরও বুঝতেন। এক দিন দোকানদার বললেন, ‘ভাবি, আমার দোকানের জন্য কিছু পিঠা তৈরি করে দেন। বিক্রি করব।’

প্রতিশ্রুতি মোতাবেক পিঠা তৈরি করে দিলেন। তবে পরিমাণে অল্প। বিক্রি হয়ে গেল সব পিঠা। উৎসাহ পেলেন নুরুন। শুরু হলো নতুন যাত্রা; বিন্দু থেকে বৃত্ত অভিমুখী। কুটির শিল্পের গণ্ডি পেরিয়ে নুরুন নাহারের পিঠা পেয়েছে বাণিজ্যিক রূপ। এসেছে নিজস্ব ‘ব্যানার’ও।

পিঠা বিক্রির টাকাতেই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন তিনি। ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব’ হিসেবে পরিচিত সেই ছেলে এখন পিঠা তৈরিতে মাকে সাহায্য করেন। পিঠাঘর নিয়েছে পারিবারিক রূপ। চাহিদার জোগান দিতে নুরুন নাহারের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তার ছেলে-মেয়ে ও স্বামী। চারজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাদ ছড়াচ্ছে পিঠাঘর। পিঠার মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকেই বাইরের কাউকে চাকরিতে রাখেননি নুরুন নাহার।

নুরুন নাহার জানান, শীতের সিজনেই পিঠা বেশি বিক্রি হয়। মোট ৩০ আইটেমের পিঠা বানাতে পারঙ্গম তিনি। বাইরের অর্ডার এলেই সব ধরনের পিঠা সরবরাহ করেন। অন্যদিকে দোকানে বিক্রির জন্য দেন শুধু তিন আইটেমের পিঠা। আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। বৈশাখী উৎসবে যথারীতি এবারও বাইরে থেকে বেশ কিছু অর্ডার পেয়েছেন তিনি।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তার স্বামী অফিস থেকে ফেরার পর শুরু হয় পিঠা বানানো। দেড়শ থেকে দুইশর মতো পিঠা বানানো হয়। দোকানে পিঠা দেওয়ার পর সব পিঠাই বিক্রি হয়ে গেলে নুরুন নাহার বুঝতে পারেন, অনেক মানুষের পিঠা খাওয়ার ইচ্ছা আছে কিন্তু বানানোর মতো ধৈর্য এবং সময় নেই।

নুরুন নাহার পিঠাঘরের স্বত্বাধিকারী নুরুন নাহার স্বনির্ভর হওয়ার গল্প শুনিয়ে বলেন, মেয়েরা উপার্জন করলে কারও কাছে হাত পাততে হয় না। এ টাকা দিয়েই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছি।

দোকানে বিক্রিতব্য পিঠার ওপর স্টিকার সাঁটানো থাকে। তাতে লেখা থাকে ‘হোম মেড’। পিঠার নাম ও দাম লেখা থাকায় ক্রেতারা সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন পিঠা কেনা বা না কেনার বিষয়ে।

নানা রকম উপাদান ব্যবহার করে শৈল্পিক পিঠা বানান নুরুন নাহার। বক্সে সাজানো পিঠায় দেওয়া থাকে ফোন নম্বরও। খেয়ে কারও ভালো লাগলে পরে যোগাযোগ করে আরও পিঠা নিতে পারেন। অর্ডার দিতে পারেন পারিবারিক কিংবা সামাজিক যে কোনো উৎসব ও অনুষ্ঠানের জন্যও। শৈশবের কৌতূহলে শেখা পিঠা বিক্রিই যে হয়ে উঠবে জীবিকার অন্যতম উৎস, ভাবলে এখন বিস্মিত হতে হয় নুরুন নাহারকে; অন্যদের তো বটেই!