বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে হিসাব নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। এ আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হলেও দলীয় কোন্দলে দিশেহারা সাধারণ কর্মীরা। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আসনটি উদ্ধার করতে চাইছেন এ আসন থেকে তিনবার নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি প্রকৌশলী মো. ফজলুল আজিম। তবে এলাকা এবং কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। অন্যদিকে বর্তমান এমপি আয়েশা ফেরদৌস আলীও তার আসন ধরে রাখার চেষ্টার কমতি নেই। আওয়ামী লীগ থেকে নুতন করে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় যোগ হয়েছেন বিশিষ্ট শিল্পপতি মাহমুদ আলী রাতুন। এক পৌরসভা ও ১১ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি। রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসার কারণে নোয়াখালীর সবচেয়ে আলোচিত এ আসনটি। কোন্দলের মূল কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগের উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটি এবং বেশির ভাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে দলীয় এমপি আয়েশা ফেরদৌস আলী ও তার স্বামী সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর মুখোমুখি অবস্থান। আয়েশা ফেরদৌস এমপি হলেও মূল প্রভার তার স্বামী যুবদল থেকে জাতীয় পার্টি হয়ে আওয়ামী লীগে আসা মোহাম্মদ আলীর।
১৫ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের মামলা হামলার মাধ্যমে হয়রানি করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাকে জেলা কমিটির উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রিয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
হাতিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহম্মেদের ছোট ভাই, যুবলীগ কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য ও হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আশরাফ উদ্দিন, চরকিং ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য নুরুল আলম ও সোনাদিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য রিয়াজ উদ্দিন হত্যা মামলার আসামি করা হলে তিনি এখন হাতিয়া ছাড়া।
অন্যদিকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা আলী দুলালের ছোট ভাই হাতিয়া জনকল্যাণ সমিতির সভাপতি শিল্পপতি মাহমুদ আলী রাতুলকে সঙ্গে পেয়ে মোহাম্মদ আলীর প্রতিপক্ষ উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ এখন বেশ চাঙ্গা। এমপির প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানির পরও হাতিয়ার রাজনৈতিক মাঠ এখন তাদের দখলে।
জানা যায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আবু সুফিয়ার মো. পেয়ারু ৪ হাজার ভোট পেয়ে হাতিয়া ত্যাগ করেন। তখন বিএনপির হাল ধরেন প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিম। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও পরে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমকে শক্তিশালী করে সৃষ্টি করেছেন বিশাল এক কর্মীবাহিনী। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সংস্কারপন্থী হয়ায় বিএনপি থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হন ফজলুল আজিম। পরে তার কর্মী বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা সাখাওয়াত হোসেন সওকতকে। নির্বাচনে সওকত মাত্র ৬৮০ ভোট পেয়েছিলেন। জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি আর এলাকায় আসেননি। দলীয় কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এলাকায় আবারো যোগাযোগ শুরু করেছেন। তিনি মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে।
এ আসনে স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময় নির্বাচিত এমপিরা হলেন- ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিরুল ইসলাম কালাম, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ আলী, ১৯৯১ সালে বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ, ১৯৯৬ সালে বিএনপির প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিম, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান মোহাম্মদ আলী। কিন্তু ঋণখেলাপির দায়ে মনোনয়ন হারাতে হয়েছে তাকে। সে সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তনেরও আর সময় ছিল না। তাই এ আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী ছিল না। এ সময় মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী আয়েশা আলীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলে প্রচারণা চালানো হয়। সে সময় তাকে মেনে নেয়নি হাতিয়া আওয়ামী লীগ। যার কারণে এ আসনের অধিকাংশ আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রকৌশলী মো. ফজলুল আজিমের নির্বাচন করেন। পরে মোহাম্মদ আলী তার স্ত্রী আয়েশা ফেরদৌস আলীকে দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এ আসনে নির্বাচন করান এবং নির্বাচনে পরাজিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগ থেকে আয়েশা ফেরদৌস আলীকে দিয়ে নির্বাচন করে ৬০ হাজার ৫৪৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। সে নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিরুল ইসলাম। তিনি পেয়েছিলেন, ৩০ হাজার ৯১৯ ভোট। নির্বাচনের পর দলের নাম ব্যবহার করে ভূমি দখল, জল ও বনদস্যুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ এনে আয়েশা ফেরদৌস আলীর স্বামী মোহাম্মদ আলীকে দলীয় সব পদ থেকে বহিষ্কার করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করে জেলা আওয়ামী লীগ।
এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা আলী দুলালের ছোট ভাই হাতিয়া জনকল্যাণ সমিতির সভাপতি শিল্পপতি মাহমুদ আলী রাতুল, বর্তমান এমপি আয়েশা ফেরদৌস ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আমিরুল ইসলাম আমির।
মাহমুদ আলী রাতুলের পক্ষে গত কয়েক মাস থেকে হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চলছে। হাতিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ, পৌর আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা তার পক্ষে মাঠে নেমেছেন। এবার জাতীয় শোক দিবসে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষাধিক লোকের খাবার আয়োজন ও উপজেলা সদরে বিশাল শোডাউন করেন। দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব মাহমুদ আলী রাতুলকে নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চরকিং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহম্মেদ জানান, হাতিয়ায় মূলধারার আওয়ামী লীগের কোনো কোন্দল নেই। স্বাধীনতা বিরোধী কিছু সুবিধাবাদী দলে অনুপ্রবেশ করে আওয়ামী লীগকে ধবংস করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা এখন কোনঠাসা। দলের নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে এ সুবিধাবাদী অপশক্তির মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে।
হাতিয়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ছাইফ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, আগামী নির্বাচনে মোহাম্মদ আলী ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। সোনাদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান হাজী নুরুল ইসলাম জানান, মাহমুদ আলী রাতুলের পক্ষে ইতোমধ্যে হাতিয়ায় গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। হাতিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গত কয়েক বছর থেকে নীরবে শিক্ষা, চিকিৎসা ও সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তিনি মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন।
নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন জানান, এক ব্যক্তির অপশাসন থেকে হাতিয়াবাসীর মুক্তির জন্য মাহমুদ আলী রাতুলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। আগামী নির্বাচনে তিনিই দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি।
দল থেকে মনোনয়ন পেলে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করে হাতিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ইতিবাচক ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার কথা জানান রাতুন। সেই সঙ্গে নদী ভাঙন, বিদ্যুতায়ন, ভূমিহীন সমস্যা, দস্যুতাসহ দীর্ঘদিনের স্থায়ী সমস্যাগুলোর অগ্রাধিকারভিত্তিক সমাধানের পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
অন্যদিকে বর্তমান এমপি আয়েশা ফেরদৌস আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ধরে রাখার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধ এবং স্বামী সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য কেন্দ্রিয় কমিটিতে সুপারিশ পাঠানোর ঘটনা আয়েশা ফেরদৌসের মনোনয়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
এ আসনে বিএনপি লড়ছে অস্তিত্ব সংকটে। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বিএনপি। গত কয়েক বছরে উপজেলা পর্যায়ের একাধিক শীর্ষ নেতার দল ত্যাগের কারণে কর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে হাতিয়া উপজেলা বিএনপির দু’বারের সভাপতি মোহাম্মদ আলা উদ্দিন রয়েছেন। সংস্কারপন্থী নেতা মোহাম্মদ ফজলুল আজিমকে দল থেকে বহিষ্কারের পর দলে যে শূন্যতা দেখা দিয়েছে তা আলা উদ্দিনের একান্ত প্রচেষ্টায় পূরণ সম্ভব হয়। দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মোহাম্মদ আলা উদ্দিনকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে দেখতে আগ্রহী।
অন্যদিকে এক সময়ের বিএনপি ও পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত সাবেক এমপি শিল্পপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিমও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন বলে তার অনুসারীরা এলাকায় এলাকায় প্রচার করছেন। তবে, তিনি কোনো দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন তা এখনো খোলাশা করেননি।
নোয়াখালীর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদী ঘেরা দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াকে নিয়ে নোয়াখালী-৬ আসন। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৪৫ জন।