বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নব্বইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বরাবর বিএনপির দখলে ছিল নাটোর-৩ সিংড়া আসনটি। বিএনপির এই জয়রথ থামে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের উদীয়মান নেতা জুনাইদ আহমেদ পলকের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে থাকলেও মনোনয়ন-দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী পলক।
আর বিএনপির নেতারা মরিয়া আসনটি পুনরুদ্ধারে। হারানো দুর্গ ফিরে পেতে কৌশলে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
সিংড়া উপজেলাটি জেলার বৃহৎ ও শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত। ইতিমধ্যে এই উপজেলা তথা চলনবিল জুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের মধ্যে অতীতের বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনের মতো সংসদ নির্বাচনেও অনিয়মের শঙ্কা বিরাজ করছে। তবে এরই মধ্যে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকায় সরব হয়ে উঠেছেন।
অনেকে প্রকাশ্যে মাঠে না থাকলেও কৌশলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আবার অনেকে গণসংযোগের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের ছবি সংবলিত পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন ঝুলছে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে। চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও ভালো-মন্দের বাছবিচার।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ এবং সিংড়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিকের সঙ্গে পলকের নীতিগত মতবিরোধ তৈরি হওয়ায় আওয়ামী লীগ যেমন কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে, তেমনি সম্প্রতি বিএনপির সাবেক সফল মেয়র ও ম্যাব মহাসচিব অধ্যাপক শামিম আল রাজির আকস্মিক মৃত্যুতে এই আসনে বড় ধরনের শূন্যতায় ভুগছে বিএনপি।
নাটোর-৩ আসনে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ। পরের দফায় ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির প্রয়াত নেতা অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে ফের বিজয়ী হন কাজী গোলাম মোর্শেদ। ২০০১ সালের ভোটেও এমপি হন গোলাম মোর্শেদ।
কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটের হিসাব পাল্টে যায়। বিজয় ছিনিয়ে নেন আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা অ্যাডভোকেট জুনাইদ আহমেদ পলক। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও পলক বিজয়ী হন সরাসরি ভোটে।
২ লাখ ৭৬ হাজার ৪০০ জন ভোটারের এই আসনে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে একাধিক প্রার্থী থাকলেও এগিয়ে আছেন বর্তমান সংসদ সদস্য প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
পলক জানান, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে সিংড়ার মাটিতে ২২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ডিজিটাল হাব গড়ে তোলা হচ্ছে। আগামী তিন বছরে এর নিমাণ কাজ শেষ হলে এই এলাকার প্রায় ২০ হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। চলনবিলের সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ ডুবন্ত সড়কসহ এলাকায় শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে বহু ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি করেছেন। বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী পলক মোটরসাইকেলে চড়ে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ঘুরে সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধান করছেন।
তবে পরপর দুবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগও আছে। এর মধ্যে বিশেষ করে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভিযোগ প্রধান। সম্প্রতি সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলামের শোক দিবস উপলক্ষে সাঁটানো পোস্টার প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলায় মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ। তাই পলকের বিকল্প হিসেবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিককে প্রার্থী হিসেবে ভাবছেন অনেক সিনিয়র নেতা।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিক ১৯৯৬ সালে গোল-ই আফরোজ সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও ১৯৯৮ সালে একই কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগে ২০০৯ সালে তিনি সিংড়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনীতিতে একজন পরিচ্ছন্ন ও ভদ্র, ব্যক্তি হিসেবে এলাকায় তার সুখ্যাতি রয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান শফিক বলেন, সিংড়ার আওয়ামী লীগ পরিবারগুলো খুবই অবহেলিত। তাদের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। এখানে বিতর্কিত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে আরও রয়েছেন সাবেক এমপি মরহুম আশরাফুল ইসলামের ছেলে নাটোর নবাব সিরাজ উদ-দৌলা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ১ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম দুলু।
এই মনোনয়ন-প্রত্যাশী বলেন, তার বাবা আশরাফুল ইসলামের হাত ধরে সিংড়া আওয়ামী লীগের জন্ম। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। বর্তমানে সিংড়ার ত্যাগী নেতাকর্মীরা অবহেলিত। তাই তাদের দাবির মুখে তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে আশা করছেন।
এলাকার মনোনয়ন তৎপরতার বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ওহিদুর রহমান শেখ বলেন, ‘এই আসনে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক একক প্রার্থী। তবে বড় দল হিসেবে নেতাদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ থাকতেই পারে, সেটা সাময়িক।’ আসনটি তাদের দখলেই থাকবে বলে আশা করেন তিনি।
বিএনপিতে হাফ ডজন
বিএনপিতে প্রার্থী হতে হাফ ডজন নেতা মাঠে নেমেছেন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে রয়েছেন- জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ।
বিএনপির অন্য মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন-জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক, সিংড়া উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউসুফ আলী। থানা বিএনপির সভাপতি ও জেলা জাতীয়তাবাদী আইজীবী ফোরামের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান মন্টু। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম হোসেন।
নব্বইয়ের দশকে সিংড়ার মেধাবী তরুণ ছাত্রনেতা এম ইউসুফ আলী জার্মানি থেকে আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ইউসুফ আলী বলেন, মরহুম অধ্যাপক শামিম আল রাজির অবর্তমানে তার শূন্যস্থান পূরণে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মিথ্যা মামলায় বিএনপির আটক নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে তিনি কাজ করছেন।
নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে কথা হয় বিএনপির মনোনয়ন-প্রত্যাশী মজিবুর রহমান মন্টুর সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রয়াত নেতা আবুল কালাম আজাদ ও শামিম আল রাজির অবর্তমানে শক্ত হাতে সিংড়া বিএনপির হাল ধরেছেন তিনি। রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর নির্দেশে সিংড়া বিএনপি সংঘবদ্ধ। তবে কিছুটা অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক ম-লী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতির নাটোর জেলার সভাপতি এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান মাঠে রয়েছেন। তিনি বলেন, ৩০ বছর ধরে কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন তিনি। সেসব বিবেচনা করে তাকেই মনোনয়ন দেবে মহাজোট।
এ ছাড়া মাঠে রয়েছেন উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি প্রকৌশলী আনিসুর রহমান, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সিংড়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক শাহ মোস্তফা ওলিউল্লাহ।
সূত্রঃ ঢাকাটাইমস