বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সুদূর পল্লী গ্রামের স্বপ্ন নিয়ে কাফেলা রওনা হলো। শহুরে ধনী তার সন্তানদের আর সফরের মালসামানা বোঝাই করেছেন উটের পিঠে। শহরের সীমানা পার হতেই তাদের মনে বেজে ওঠে বন্দি জীবন থেকে মুক্তির সংগীত।
শা’দমা’ন সূয়ে সাহরা’ রা’ন্দন্দ
সা’ফেরু তা তাগনামূ বর খা’ন্দন্দ
পুলকিত মনে প্রান্তর পানে কাফেলা চলে
‘সফর কর লাভবান হও’ সংগীতে সুর তুলে।
শহুরে ধনী গ্রামে বেড়াতে যেতে প্রথমে রাজি ছিল না; কিন্তু শহরের বাইরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে বন্দিত্বের জিন্দানখানা থেকে মুক্তির মহাময়দানে উপনীত। যে গ্রাম্য লোকের দাওয়াতে তারা আজ নিসর্গের হাতছানি পেয়ে পুলকিত, ধনী তার অনেক উপকার করেছিল। লোকটি শহরে এলে ধনীর বাসায় উঠত। থাকা-খাওয়ার সব আয়োজন অবারিত ছিল তার জন্য। ধনী জানতেন, যার উপকার করা হয়েছে তার অনিষ্ট থেকে সাবধান থাকতে হবে। এটিই ছিল সফরে যেতে রাজি না হওয়ার মূল কারণ। এক জ্ঞানী লোককে জানানো হলো, অমুক ব্যক্তি আপনার বদনাম করে বেড়াচ্ছে। তিনি বললেন, আমার তো মনে পড়ে না, কখনও আমি তার উপকার করেছি।
শহরের বাইরে নির্মল বাতাসের হাতছানিতে ধনী ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল তার এসব যুক্তিদর্শন। তার চিন্তায় এখন একের পর এক উদ্ভাসিত হচ্ছে কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত সফরের যত কল্যাণ। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘সফর করো তাহলে সুস্থ থাকবে, ধনসম্পদ লাভ করবে। ’
এখান থেকেই সুফিরা তাদের আধ্যাত্মিক সাধনার প্রেরণা সংগ্রহ করেছেন। তারা আত্মার জগতে সফর বা সাইরে আনফুসকে যেমন গুরুত্ব দেন, জাগতিক সফরের মূল্যও তাদের কাছে অত্যধিক। মওলানা রুমির (রহ.) চিন্তায় এখন এসব বিষয় ভিড় করছে। তিনি বলেন, নতুন চাঁদ আকাশের বুকে সফর করে, তাই একদিন পূর্ণিমা চাঁদে পরিণত হতে পারে। দাবা খেলায় পদাতিক ঘুঁটি সফর করতে করতে উজিরে রূপান্তরিত হয়। ইউসুফ (আ.) যে মিসরের রাজত্বে বরিত হয়েছেন, তাতেও ছিল সফরের অবদান। কাজেই আফাকি সফর বা দিকদিগন্তে পরিভ্রমণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এসব মধুর চিন্তা নিয়ে সারা দিনমান খোলা আকাশের নিচে পথ চলে মুসাফির। সূর্যের তাপে পুড়ে যায় তাদের নাজুক শরীর। রাত এলে চাঁদ ও তারকারাজির সঙ্গে চলে মিতালী। গ্রামে পৌঁছতে, গ্রাম্য চাচার সাক্ষাৎ পেতে ধনীর ছেলেরা অধীর। পথের ক্লান্তি, প্রখর তাপের ভোগান্তি তাদের মনে হচ্ছে কেমন যেন মিষ্টি মাধুরী। কারণ,
তালখ আয শীরীন লবা’ন খোশ মী শওয়াদ
খা’র আয গুলজার দিলকশ মী শওয়াদ
মিষ্টি ঠোঁট যার, তার তিতা ব্যবহার মধুর লাগে
কাঁটার আঘাত আদরের মনে হয় গোলাপ বাগে।
প্রিয়তমের হাতের মাকাল ফলও মনে হয় খুরমা মেওয়া
পর্ণকুটিরে যদি প্রিয়তম থাকে, মনে হবে বিশাল সাহারা।
কাজেই দুঃখ-কষ্ট আপেক্ষিক। জীবনের ঘানি টানতে মানুষ যে কষ্ট করে, আপনজনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, কঠোর সাধনা চালায়, তাতেই নিহিত প্রেমের আনন্দ। বহু প্রিয়জন আছে সারাদিন গতর খাটে, বনবাদাড় চষে কাঠের বোঝা টানে; তবে ঘরে যে চাঁদমুখী রেখে এসেছে, তার কাছে ফিরে যাওয়ার চিন্তায় আনন্দে বিভোর থাকে। হাঁপরের ধোঁয়ায় কামারের চেহারা কালো হয়ে যায়; তবু রাতে প্রিয়তমের সুন্দর মুখে চুম্বন আঁকার স্বপ্নে কষ্টের কথা ভুলে যায়। দোকানি সারাদিন ঘানি টানে বিকিকিনির জঞ্জালে। কিন্তু মোটেও কষ্ট মনে করে না, যেহেতু আপনজনদের নিয়ে সুখী জীবনের স্বপ্ন বুনে। বণিক জলে-স্থলে পণ্য নিয়ে প্রাণপণে ছুটে দেশ-বিদেশে। তার মন আনন্দে দোলে, কারণ সে জানে ঘরে ফিরে প্রিয়জনের মুখে হাসি দেখবে। এভাবে নানা পেশার লোক কষ্টকে কষ্ট মনে করে না, কারণ তার মনের আয়নায় থাকে প্রিয়জনের মুখচ্ছবি। মওলানা রুমি (রহ.) পরামর্শ দেন :
বর উমীদে জিন্দেয়ী কুন ইজতিহাদ
কূ নগরদদ বা’দে রূযী দো জমা’দ
জীবন্তকে পাওয়ার আশায় কর চেষ্টা সাধনা তুমি
কারণ, দু’দিন পর নিঃশেষ হয়ে যাবেন না তিনি।
যাদের ভালোবাসায় জীবনের দুঃখ-কষ্টকে খুশি মনে বরণ করছ, তারা ক’দিন পর মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেবে। তাদের সঙ্গে ভালোবাসার দিন একদিন ফুরিয়ে যাবে। কাজেই এমন একজন জীবন্তকে পাওয়ার জন্য চেষ্টা সাধনা করো, যার শেষ নেই, লয় নেই, চিরজীবন্ত, অমর। হীন চিন্তার বশে ভালোবাসার পাত্র বানিও না নিচহীন কাউকে। কারণ দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী যারা তাদের প্রতি ভালোবাসার আকর্ষণ অন্যের কাছ থেকে ধার করা, হাকিকি নয়।
মওলানা রুমি বলেন, আল্লাহ ছাড়া কেউ যদি তোমার ভালোবাসার অকৃত্রিম উৎস হয়ে থাকে, তারা তোমার মা-বাবা; কিন্তু তাদের সঙ্গেও কি ভালোবাসার সম্পর্ক অটুট থাকে? মৃত্যুর পর তো তারাও তোমাকে বিদায় জানায়। কেউ কারও হয় না। শৈশবে ধাত্রীর প্রতি, দুধের সন্তানের সঙ্গে তোমার যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, তা কি এখন আছে? ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার সবকিছুর সঙ্গে তোমার আকর্ষণ ও ভালোবাসার স্বরূপ এমনই। মওলানা একটি সূক্ষ্মতত্ত্বের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলছেন,
অ’ন শোআয়ী বূদ বর দীওয়া’রে শা’ন
জা’নেবে খুরশীদ ওয়া রফত অ’ন নেশা’ন
অস্তিত্বের দেয়ালে পড়েছিল সূর্যের আলোকচ্ছটা
ফিরে গেছে পুনঃ সূর্যের পানে উৎস ঠিকানা যথা।
মওলানা আরও বুঝিয়ে বলেন, প্রেমের সূর্যের আলোকচ্ছটা যেখানে পতিত হয় সেখানে তুমি প্রেমের সন্ধান পাও। অস্তিত্ব জগতের যত কিছুর প্রতি তুমি আসক্ত হও, তার মধ্যে যে আকর্ষণ ও ভালোবাসার মতো উপকরণ, তা আল্লাহর গুণেরই বিচ্ছুরণ, তামায় স্বর্ণের প্রলেপের মতো।
হাদিস শরিফে বর্ণিত, আল্লাহ তায়ালা তার রহমতের ১০০ ভাগের ১ ভাগ দিয়েছেন পৃথিবীতে। তার সুবাদে বন্যপ্রাণীরা নিজেদের বাচ্চাদের ভালোবাসে। মানুষে মানুষে ভালোবাসা প্রেম, মায়া-মমতার বন্ধনও এই রহমতের কল্যাণে। (দ্র. মুসলিম শরিফ : ২৭৫২)।
কাজেই অস্তিত্ব জগতের যত কিছুর প্রতি তুমি আসক্ত হও, মূলত আল্লাহর কোনো না কোনো গুণের প্রতিফলন তার ওপর হয়েছে। বিষয়টি তামার অলঙ্কারের ওপর স্বর্ণের প্রলেপের মতো।
চোন যরী বা আসল রফত ও মস বেমা’ন্দ
তাবএ সীর আ’মদ তালাকে উ নমা’ন্দ
স্বর্ণের প্রলেপ যখন ফিরে যায় উৎসের কাছে
কালো স্বভাব ফুটে তামায়, থাকে না চকচকে।
কাজেই পরম প্রিয়তমের গুণের প্রতিভাসের কারণে যেসব ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি তুমি আসক্ত হয়েছ, তা থেকে তোমার দিলকে ছাড়িয়ে নাও। স্বর্ণের প্রলেপ ছেড়ে যাও সেই খনিতে, যেখানে প্রলেপ তার আসলে ফিরে গেছে। তুমি কিরণের প্রতি আসক্ত, অথচ তোমার উচিত কিরণের উৎস সূর্যের ভালোবাসায় উজ্জীবিত, আলোকিত হওয়া।
নূর আয দীওয়া’র তা’ খোর মী রওদ
তো বেদা’ন খোর রও কে দর খোর মী রওদ
আলো দেয়াল হতে আলগা হয়ে ফিরে যায় সূর্যে
তুমিও যাও সেদিকে যেথা হাকিকতের সূর্য হাসে।
মওলানা বলছেন, সূর্যের আলোকচ্ছটা যেহেতু দেয়াল থেকে আলগা হয়ে সূর্যের কাছে ফিরে যায়, সেহেতু হে সাধক! তুমিও চলো জগতের হাকিকি সূর্যের সন্নিধানে। আলোর লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়ে বেভোল হইও না। আবার গ্রামমুখী কাফেলার ধারা ভাষ্যে ফিরে চলে মওলানার বর্ণনা।
কাফেলার মাথার ওপর ছিল নিসর্গের হাতছানি। হাসি খুশি আনন্দে আহ্লাদে ছুটে চলে ধনী। গ্রামী ও ছায়নিবিড় গ্রামে হারিয়ে যাওয়ার বাসনায় কেটে যায় দিবস রজনী। গ্রামের দিক থেকে যখন উড়ে আসে কোনো পাখি, মনে করে এই বুঝি পেয়ে গেলাম গ্রামীর স্বপ্নভূমি।
হারকে মী আ’মদ যে দাহ আয সূয়ে উ
বুসে মী দা’দন্দ খোশ বর রূয়ে উ
যে কেউ আসে গ্রামের দিক থেকে তাদের পানে
তার চেহারায় চুমু এঁকে দেয় মধুর আলিঙ্গনে।
কে তো রূয়ে য়্যারে মা রা’ দীদে ঈ
বস তো জা’ন রা’ জা’ন ও মা’রা’ দীদে ঈ
তুমি যেহেতু দেখেছ আমার প্রিয়তমের বদনখানি
তুমি তাই মোর প্রাণের প্রাণ, আমার নয়নের মণি।
গ্রামের পথে শহুরে ধনীর কাফেলা যত এগিয়ে যায়, দাওয়াতকারী গ্রামীর সাক্ষাতের জন্য তাদের মন তত তড়পায়। স্বপনে জাগরণে শুধু তার মুখচ্ছবিই দেখে। ভাষা জানে না এমন দেশে কপর্দকহীন মুসাফিরের মন যেমন পরিচিতজনের সাক্ষাৎ আশায় ছটফট করে, সফরক্লান্ত ধনীর মনও সেভাবে অধীর অস্থির। মনে করে এই বুঝি পৌঁছে গেলাম গ্রামে। সেদিক থেকে আসতে দেখলে জড়িয়ে ধরে যে কোনো লোককে। সফরের এতটুকু বর্ণনায় মওলানা রুমির কল্পনা আবার ডানা মেলে উড়াল দিল মিলন মদিরার সন্ধানে। ওদিকের কোনো লোক পেয়ে জড়িয়ে ধরে মুখে চুম্বন এঁকে দেয়ার চিত্রকল্পে ফুটে উঠেছে ফারসি সাহিত্যের বহুল আলোচিত লাইলী-মজনুর প্রেম কাহিনীর একটি উপাখ্যানে। কায়স তার প্রেয়সী লাইলীর দেশে উ™£ান্ত ঘুরছিল প্রিয়ার চেহারার একটুখানি ঝলক দেখার আশায়। হঠাৎ দেখে একটি কুকুর এগিয়ে আসছে লাইলীর বাড়ির ওদিক থেকে। মজনু তখনই লুটিয়ে পড়ে চুম্বন করে কুকুরের পা জড়িয়ে। বেরসিক পথিকরা প্রশ্ন করে,
পায়ে সগ বূসীদা মজনু খালক পুরসিদ ইন চে বুদ
গোফত ইন সগ গা’হ গা’হী কূয়ে লাইলা রফতে বুদ
কুকুরের পায়ে চুমো দেয় মজনু, মানুষ বলে এ কেমন আচরণ?
বলল, এই কুকুর মাঝে মাঝে লাইলীর গলিতে করেছে বিচরণ।
তুমি কুকুরের বাহ্যিক অবয়ব দেখছ, আমি দেখছি অন্যকিছু। আমার কাছে তার পরিচয়, সে লাইলীর গলিতে বিচরণ করেছে। আমি দেখিনি, সে লাইলীকে দেখেছে, লাইলীর খুশবু পেয়েছে।