বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ কারিগরি শিল্পে উন্নত প্রযক্তির দেশ জাপান। বৌদ্ধ ধর্মের সংখ্যাধিক্যের দেশ হলেও সেখানে রয়েছে প্রায় লক্ষাধিক মুসলমান। এ মুসলমানদের মধ্যে ১০ শতাংশ মানুষ রয়েছৈ জাপানি বংশোদ্ভূত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হলেও সেখানে ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নতুন নয়। ১৮৮৬ সালের দিকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
জাপানে ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মসজিদ স্থাপনা সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপানের সৈন্যবাহিনী বিভিন্ন মুসলিম দেশে অবস্থান করে। সে সময়টিতে তারা ইসলামের সৌন্দর্য ও জীবন ব্যবস্থা দেখে ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
ঐ সময় জাপানের এক সেনাপ্রধান ইসলাম গ্রহণ করেন। তার নাম ছিল ওমর বোকেনা। তিনি জাপান ফিরে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। আবার চায়নিজ মুসলমানরা জাপান স্থানান্তরিত হয়েও সে অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখে। দিন দিন বাড়তে থাকে মুসলিমদের সংখ্যা।
এক সময় তাদের ইবাদত-বন্দেগি ও ধর্মীয় প্রয়োজনে অনুদিত হতে থাককে কুরআন, হাদিস ও বিভিন্ন ইসলামী বই। সে সঙ্গে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনাও চলতে থাকে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠ লাভ করে মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার। যা ইসলাম প্রচারে ব্যাপক অবদান রাখে। জাপানে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ হলো প্রসিদ্ধ ‘কোবে মসজিদ’। ‘মুসলিম সেন্টার’ নামেও এ মসজিদের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।
মসজিদটি নির্মাণে রয়েছে দুর্লভ ঘটনা। এ মসজিদটি জাপানের ষষ্ঠ বৃহত্তম নগরী ‘কোবে’তে অবস্থিত। কোবে নগরীটি হানশো দ্বীপের দক্ষিণদিকে এবং অকাসা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর দিকে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী এ নগরীর অবস্থান।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে জাপানে বসবাসরত স্থানীয় ও বিদেশী মুসলিম ব্যবসায়ীদের আন্তরিক নিষ্ঠা প্রচেষ্টায় অর্থ সংগ্রহ এবং মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
১৯৩৫ সালে কোবে মসজিদের নির্মাণকাজ পূর্ণ আলোর মুখ দেখে। তুরস্কের নির্মাণশৈলীতে নির্মিত মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন ইসলামি স্থাপত্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যা ২ আগস্ট ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার পবিত্র জুমআর নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু হয়।
মসজিদটি উদ্বোধনের সময় প্রচণ্ড গরম থাকায় ২ মাসের কিছু সময় পর ১১ অক্টোবর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় অমুসলিম জাপানী এবং কোবে নগরীর মেয়রকে মসজিদ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে ৬শতাধিক জাপানী উপস্থিত হয়ে মসজিদটি পরিদর্শন করেন।
মসজিদ পরিদর্শনকালে কোবে নগরীর মেয়র তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমি দৃঢ়বিশ্বাসী যে, এ মসজিদটি এখানকার মুসলিম এবং অমুসলিমদের মাঝে সহাবস্থান, সৌহার্দ ও সম্প্রীতির বন্ধন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সুন্দর শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।’
মসজিদ নির্মাণের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ‘কোবে মসজিদ’ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ও ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এটি জাপানের ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শনের অন্যতম একটি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আমেরিকান সৈন্যবাহিনী পুরো কোবে নগরীকে বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়। এতে কোবে নগরীর সব দালান ও স্থাপত্যগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ঐ সময় কোবে নগরীর এ মসজিদটি সমহিমায় কোবে নগরীর ঐতিহ্যকে ধারণ করে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। সে সময়ের আক্রমণে মসজিদটির কয়েকটি কাচের জানালা এবং কিছু আস্তর খসে পড়েছিল।
ঐ যুদ্ধকালীন সময়ে আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর বর্বরতা ও আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় জাপানী সৈন্যবাহিনী এ মসজিদের একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ মসজিদটি ছাড়া তাদের লুকানো এবং আত্মরক্ষার আর কোনো জায়গা ছিল না। এভাবে মসজিদটি এক সময় সব জাতির মানুষের জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিগণিত হয়।
শুধু তাই নয়
১৯৯৫ সালে জাপানের ইতিহাসে যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূমিকম্প অনুষ্ঠিত হয়; জাপানের হেনশিন বা কোবের ভয়াবহ ভূমিকম্পে যখন নগরীর সব বিল্ডিং ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। ঐ ভূমিকম্পের সময়টিতেও এ মসজিদটি নিরাপদে বহাল থাকে।
ইসলামের স্থাপত্যের ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক কোবে মসজিদ বা মুসলিম সেন্টার আজও ইসলামের সুমহান আদর্শকে ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যা ইসলামের সত্যতার অনুপ্রেরণা।