ঢাকা , শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রাচীন মসজিদে ঘেরা বারোবাজার শহর

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানার বারোবাজার ইউনিয়ন। পূর্বনাম শহর মোহাম্মদাবাদ। প্রায় তিন বর্গকিলোমিটারের নগরী। প্রাচীন স্থাপত্যের বিস্ময়কর অধ্যায়, শহর মোহাম্মদাবাদের পুরানো ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় প্রাচীনকালে মোহাম্মদাবাদের নাম ছিল ছাপাইনগর। হিন্দু আর বৌদ্ধ শাসকদের রাজধানী। পরবর্তী সময়ে বারোজন সহচর নিয়ে খানজাহান আলী এখানে আসেন। সেখান থেকেই এর নাম বারোবাজার। যুদ্ধ কিংবা মহামারিতে ছাপাইনগর ধ্বংস হয়ে যায়। থেকে যায় প্রাচীন ইতিহাস। ১৯৯৩ সালে এখানকার মাটি খুঁড়ে সন্ধান মিলে পনেরটিরও বেশি প্রততাত্ত্বিক নিদর্শনের। তার নয়টিই মসজিদ। প্রায় প্রতিটি মসজিদের সঙ্গে আছে একটি করে প্রাচীন দিঘি। সরেজমিন ঘুরে এসে মসজিদগুলোর  বিবরণ তুলে ধরেছেন ইখলাছ আল ফাহীম।

সাতগাছিয়া মসজিদ
বারোবাজারের মসজিদগুলোর সবচেয়ে বড় সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ। বারোবাজারের একেবারে প্রায় শেষ মাথায় পাকা সড়ক ছেড়ে হাতের ডানে গ্রাম্যপথে সামান্য সামনের দিকে চলতে হয়। সরেজমিন গিয়ে দেখলাম, এটির শুধু দেয়াল আর নিচের অংশ অবশিষ্ট আছে। স্থানীয়রা ওপরে টিনের চালা দিয়েছে। জানা যায়, সর্বপ্রথম গ্রামের লোকজনই মাটির নিচ থেকে এই মসজিদ উদ্ধার করে। প্রায় ৭৭ ফুট লম্বা ও ৫৫ ফুট চওড়া মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে লতাপাতার নকশা সমৃদ্ধ তিনটি মেহরাব রয়েছে।

প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদের ভেতরে এখনও ৪৮টি পিলার দেখা যায়। লাল ইটের তৈরি এ মসজিদ দীর্ঘদিন মাটিচাপা পড়ে থাকার পর ২০০৭ সালে প্রততত্ত্ব অধিদপ্তর কিছুটা সংস্কার করে। সুলতানি আমলে নির্মিত এ মসজিদের সঙ্গে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল বলে জানা যায়। মসজিদের পাশেই একটি বিরাট দিঘি। নাম পিঠেগড়া পুকুর।

গলাকাটা মসজিদ
বারোবাজার তাহেরপুর রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থিত গলাকাটা মসজিদটি সুলতানি আমলের আরেক অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য শিল্প। প্রায় ২১ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া এই মসজিদ খনন করে তোলা হয় ১৯৯৪ সালে। গোলাকার ঢিবির ওপর স্থাপিত মসজিদটির ভেতরের দিকের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি অর্ধবৃত্তাকারাকৃতির সুসজ্জিত মেহরাব আছে। মেহরাবগুলো অলঙ্কৃত ইট দ্বারা সুসজ্জিত। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের প্রতিটিতে আছে দুটি করে জালিবিশিষ্ট জানালা। পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ ও মসজিদের ভেতরে ২.৯৮ মিটার ব্যবধানে দুটি বহুভুজাকার পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। এর দেয়ালগুলো প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া।

মাঝখানে আছে লম্বা দুটি কালো পাথর। মেহরাবের দুপাশের দেয়ালে উৎকীর্ণ হয়েছে পোড়া মাটির রেখাকৃতির, বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক ও ফুলের নকশা। এছাড়া মসজিদের দেয়াল ও ছাদজুড়ে আছে পোড়া মাটির ঘণ্টা ও চেইনের নকশা। মসজিদটি চৌকোণ অষ্টভুজাকার বুরুজ দ্বারা সুশোভিত, যেগুলো সুষম ব্যবধানে আনুভূমিক বন্ধনী ও ছাঁচে তৈরি অফসেট দ্বারা সুসজ্জিত। মসজিদের সামনে একটি বারান্দা আছে পুনর্নির্মিত হয়েছে।

মসজিদের উত্তরে ‘গলাকাটা দিঘির’ অবস্থান। জনশ্রুতি আছে, বারোবাজারে এক অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তিনি প্রজাদের বলি দিয়ে এই দিঘির মধ্যে ফেলে দিতেন। এ কারণেই এর নাম হয় গলাকাটা দিঘি।

জোড় বাংলা মসজিদ
গলাকাটা মসজিদ থেকে সামান্য পশ্চিম পাশে, সড়কের বিপরীত দিকে এক গম্বুজ বিশিষ্ট জোড় বাংলা মসজিদের অবস্থান। মসজিদটি খনন করা হয় ১৯৯৩ সালে। খননের সময় এখানে একটি ইট পাওয়া যায়, তাতে আরবি অক্ষরে লেখা ছিল ‘শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইন, ৮০০ হিজরি।’ ধারণা করা হয় ৮০০ হিজরির দিকে সুলতান মাহমুদ এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৯২-১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রততত্ত্ব বিভাগ খনন করে এটি উন্মোচিত করে। ছোট ছোট পাতলা ইটে গাঁথা এই মসজিদ ১১ ফুট উচুঁ একটি প্লাটফর্মের ওপর স্থাপিত।

মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার পোড়ামাটির নকশা অলঙ্করণে তিনটি মেহরাব। তার দুই পাশে রয়েছে ছোট ছোট পিলার। মাঝের কেন্দ্রীয় মেহরাবটিতে ফুল ও লতাপাতা আঁকা ইটের কাজ দৃষ্টিগোচর হয়। এটি মসজিদটির সংস্কৃত রূপ। মসজিদের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে। এটি অন্ধপুকুর নামে পরিচিত। জনশ্রুতি আছে, মসজিদের পাশে জোড়া কুঁড়েঘর ছিল বলেই এর নাম জোড় বাংলা মসজিদ।

মনোহর মসজিদ
১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রততত্ত্ব অধিদপ্তর বারোবাজার প্রতস্থলে খননকার্য পরিচালনা করে। সে সময় মনোহর ঢিবি নামক স্থান থেকে এই প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এ মসজিদটি যেখানে আবিষ্কৃত হয় তার পাশে একটি জলাশয় থাকায় একে মনোহর দিঘির মসজিদ নামে ডাকা হয়। খননের পর থেকে এটি প্রততত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন রয়েছে।

মনোহর মসজিদটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে লম্বাভাবে নির্মিত। অভ্যন্তরের আয়তন ২২.৬৭ ও ২২.৬৭ ফুট এবং মসজিদের দেয়ালগুলোর পুরুত্ব প্রায় পাঁচ ফুট। মসজিদের মিনারগুলো নির্মাণে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি সারিতে ৪টি করে স্তম্ভ মিলিয়ে মোট স্তম্ভের পরিমাণ ২৪টি। ধ্বংসাবশেষ দেখে ধারণা করা হয়, মসজিদের মাথায় গম্বুজ ছিল ৩৫টি এবং ৪টি মিনার ছিল। খননের ফলে দুটি মিনারের ৫ ফুট পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এর উত্তর-পশ্চিম কোণায় ছোট একটি কামরা রয়েছে যা ইমামের জন্য ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়।

গোড়ার মসজিদ
তাহেরপুর সড়ক ধরে সামান্য পশ্চিম দিকে এগুলে হাতের বাঁয়ে একটু ভেতরের দিকে আরেকটি মসজিদের দেখা মিলবে। এর নাম গোড়ার মসজিদ। এই মসজিদ চার গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদ থেকে ৩০ গজ পূর্ব দিকে প্রায় ৪-৫ বিঘা আয়তনের একটি প্রাচীন জলাশয় আছে। নাম গোড়াই পুকুর বা গোড়া পুকুর। বর্গাকারে নির্মিত এ মসজিদের প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে প্রায় ৩ ফুট এবং ভেতরের দিকে ২০ ফুট। লম্বা দেয়ালগুলো ৫ ফুট প্রশস্ত। চারকোণে আছে চারটি সুন্দর অষ্টকোনাকৃতির মিনার। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে ৩টি ও উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে ১টি করে খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ আছে। পশ্চিম দেয়ালে আছে দরজা বরাবর তিনটি মেহরাব। কেন্দ্রীয় মেহরাব অপেক্ষাকৃত বড়। মেহরাবগুলোতে পোড়া মাটির ফলকে ফল ও লতাপাতার অলঙ্করণ ছিল। এতদিন পরও পোড়া মাটির চিত্র ফলকগুলোর সৌন্দর্য তেমন নষ্ট হয়নি।

মসজিদটি খান জাহান আলী কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে প্রবল জনশ্রুতি আছে। ১৯৮৩ সালে এই মসজিদের সন্ধান পায় প্রততত্ত্ব অধিদপ্তর। মসজিদটি খননের সময় একটি কবরের সন্ধান মেলে। আরও শোনা যায়, পাশের কবরটি গোড়াই নামের কোনো এক দরবেশের। এ থেকেই এর নাম গোড়াই বা গোড়ার মসজিদ।

পীর পুকুর মসজিদ
আবারও তাহেরপুর সড়ক ধরে সামনে এগুতে হবে। দুটি বাঁক ঘুরলেই বিশাল দিঘি, নাম পীর পুকুর। পশ্চিম পাড়ের মাঝ বরাবর বেশ বড় আকৃতির মসজিদ পীর পুকুর মসজিদ। এই মসজিদও ছিল মাটির নিচে। এই মসজিদে ছাদ নেই, শুধু দেয়াল আছে। মসজিদটি লাল ইটের তৈরি। পীরপুকুর প্রতস্থলের পশ্চিমে মসজিদটির অবস্থান। ১৯৯৪ সালে খননের ফলে এ স্থানে ১৮.৪০দ্ধ১০.৮৫ মিটার পরিমাপের ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়। গম্বুজগুলোর সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। শুধ্ মসজিদের দেয়ালগুলো নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত টিকে আছে। মসজিদটির চার কোণে অলঙ্কৃত অষ্টভুজ কৌণিক বুরুজ সুষম ব্যবধানে আনুভূমিক বন্ধনী দ্বারা সজ্জিত ছিল।

পাঠাগার মসিজদ
মিঠাপুকুর মৌজায় একটি ছোট ও অনুচ্চ মসজিদ। আয়তাকার মসজিদটির পরিমাপ ১৫দ্ধ১২ মি.। ১৯৯৫ সালে খননের ফলে বহির্ভাগে ৬.৯দ্ধ৬.৯ মিটার পরিমাপের একটি বর্গাকার মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়। মসজিদের দেয়াল ১.৩৮ মিটার পুরু। মসজিদটির উপরের অংশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

নুনগোলা মসজিদ
বারোবাজার হাসিলবাগে অবস্থিত নুনগোলা মসজিদটিও বর্গাকৃতির একটি মসজিদ। মসজিদটিতে তিনটি অর্ধবৃত্তাকৃতির মেহরাব আছে। মেহরাবে ছোট ছোট বর্গাকৃতির মধ্যে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা আছে। মসজিদের বাইরের দেওয়ালে পর্যায়ক্রমিক খাড়া চাল ও খাঁজ আছে। এগুলোতে দিগন্ত রেখাকৃতির ছাচে গড়া নকশা আছে। মসজিদের ওপরে একটি গম্বুজ আছে।

শুকুর মল্লিক মসজিদ
শুকুর মল্লিক মসজিদ হাসিলবাগ মৌজায় অবস্থিত। এটি বারোবাজার থেকে ৩০০ মিটার দক্ষিণে। মোচাকৃতি মসজিদটি আনুমানিক ১২দ্ধ১০ মিটার পরিমাপের। পার্শ্ববর্তী কৃষিজমি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৩ মিটার। ১৯৯৬ সালের খননে বহির্পার্শ্বে ৬দ্ধ৬ মিটার পরিমাপের এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বর্গাকার মসজিদের ধ্বংসাবশেষ বের করা হয়। এর দেয়াল ১.২২ মিটার পুরু। গম্বুজ বিলুপ্ত এবং দেয়াল নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এর ৪টি অষ্টভুজ কৌণিক মিনার নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত টিকে আছে। মসজিদটির পূর্বদিকে আছে একটি প্রবেশপথ। কেন্দ্রীয় মেহরাবটি বহির্দিকে উদ্গত, ১.৫০ মিটার প্রশস্ত এবং ৪৯ সেন্টিমিটার গভীর। এটি মূলত বর্গাকাকৃতির এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। মসজিদটির উভয় পাশে একটি করে বন্ধ মেহরাবসহ পশ্চিম পাশে একটি অর্ধবৃত্তাকৃতির মেহরাব আছে। এই মেহরাবগুলো সজ্জিত করা হয়েছে পোড়া মাটির ঘণ্টা ও চেইন নকশায়। অপরূপ নকশাগুলো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

প্রতিটি মসজিদ ঘুরে দেখার সময় স্থানীয় মানুষ নানা গল্প শোনালেন। প্রততত্ত্ব বিভাগ মসজিদগুলোর তত্ত্বাবধান নিলেও চোখে পড়ার মতো তেমন সংস্কার করেনি। বর্ষা কিংবা দুর্যোগের দিনে নামাজ পড়তে বিশেষ অসুবিধে হয় মুসল্লিদের। সাতগাছিয়া মসজিদে এক অশীতিপর বৃদ্ধের দেখা মিলল। তিনি জানালেন, সেই যে খননের পর দায়সারা সংস্কার করে মোটামুটিভাবে নামাজ পড়ার উপযুক্ত করা হয়েছে, তারপর থেকে এর উন্নয়নে কারও তেমন উদ্যোগ কিংবা আয়োজনের দেখা মেলেনি। অথচ এই মসজিদগুলো সংস্কার করলে বারোবাজারও একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারত। বিদেশি পর্যটকদের কেউ কেউ শুধু এই মসজিদগুলো দেখার জন্য এখানে আসতেন। আশা করছি, প্রততত্ত্ব অধিদপ্তর বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

প্রাচীন মসজিদে ঘেরা বারোবাজার শহর

আপডেট টাইম : ১০:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানার বারোবাজার ইউনিয়ন। পূর্বনাম শহর মোহাম্মদাবাদ। প্রায় তিন বর্গকিলোমিটারের নগরী। প্রাচীন স্থাপত্যের বিস্ময়কর অধ্যায়, শহর মোহাম্মদাবাদের পুরানো ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় প্রাচীনকালে মোহাম্মদাবাদের নাম ছিল ছাপাইনগর। হিন্দু আর বৌদ্ধ শাসকদের রাজধানী। পরবর্তী সময়ে বারোজন সহচর নিয়ে খানজাহান আলী এখানে আসেন। সেখান থেকেই এর নাম বারোবাজার। যুদ্ধ কিংবা মহামারিতে ছাপাইনগর ধ্বংস হয়ে যায়। থেকে যায় প্রাচীন ইতিহাস। ১৯৯৩ সালে এখানকার মাটি খুঁড়ে সন্ধান মিলে পনেরটিরও বেশি প্রততাত্ত্বিক নিদর্শনের। তার নয়টিই মসজিদ। প্রায় প্রতিটি মসজিদের সঙ্গে আছে একটি করে প্রাচীন দিঘি। সরেজমিন ঘুরে এসে মসজিদগুলোর  বিবরণ তুলে ধরেছেন ইখলাছ আল ফাহীম।

সাতগাছিয়া মসজিদ
বারোবাজারের মসজিদগুলোর সবচেয়ে বড় সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ। বারোবাজারের একেবারে প্রায় শেষ মাথায় পাকা সড়ক ছেড়ে হাতের ডানে গ্রাম্যপথে সামান্য সামনের দিকে চলতে হয়। সরেজমিন গিয়ে দেখলাম, এটির শুধু দেয়াল আর নিচের অংশ অবশিষ্ট আছে। স্থানীয়রা ওপরে টিনের চালা দিয়েছে। জানা যায়, সর্বপ্রথম গ্রামের লোকজনই মাটির নিচ থেকে এই মসজিদ উদ্ধার করে। প্রায় ৭৭ ফুট লম্বা ও ৫৫ ফুট চওড়া মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে লতাপাতার নকশা সমৃদ্ধ তিনটি মেহরাব রয়েছে।

প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদের ভেতরে এখনও ৪৮টি পিলার দেখা যায়। লাল ইটের তৈরি এ মসজিদ দীর্ঘদিন মাটিচাপা পড়ে থাকার পর ২০০৭ সালে প্রততত্ত্ব অধিদপ্তর কিছুটা সংস্কার করে। সুলতানি আমলে নির্মিত এ মসজিদের সঙ্গে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল বলে জানা যায়। মসজিদের পাশেই একটি বিরাট দিঘি। নাম পিঠেগড়া পুকুর।

গলাকাটা মসজিদ
বারোবাজার তাহেরপুর রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থিত গলাকাটা মসজিদটি সুলতানি আমলের আরেক অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য শিল্প। প্রায় ২১ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া এই মসজিদ খনন করে তোলা হয় ১৯৯৪ সালে। গোলাকার ঢিবির ওপর স্থাপিত মসজিদটির ভেতরের দিকের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি অর্ধবৃত্তাকারাকৃতির সুসজ্জিত মেহরাব আছে। মেহরাবগুলো অলঙ্কৃত ইট দ্বারা সুসজ্জিত। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের প্রতিটিতে আছে দুটি করে জালিবিশিষ্ট জানালা। পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ ও মসজিদের ভেতরে ২.৯৮ মিটার ব্যবধানে দুটি বহুভুজাকার পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। এর দেয়ালগুলো প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া।

মাঝখানে আছে লম্বা দুটি কালো পাথর। মেহরাবের দুপাশের দেয়ালে উৎকীর্ণ হয়েছে পোড়া মাটির রেখাকৃতির, বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক ও ফুলের নকশা। এছাড়া মসজিদের দেয়াল ও ছাদজুড়ে আছে পোড়া মাটির ঘণ্টা ও চেইনের নকশা। মসজিদটি চৌকোণ অষ্টভুজাকার বুরুজ দ্বারা সুশোভিত, যেগুলো সুষম ব্যবধানে আনুভূমিক বন্ধনী ও ছাঁচে তৈরি অফসেট দ্বারা সুসজ্জিত। মসজিদের সামনে একটি বারান্দা আছে পুনর্নির্মিত হয়েছে।

মসজিদের উত্তরে ‘গলাকাটা দিঘির’ অবস্থান। জনশ্রুতি আছে, বারোবাজারে এক অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তিনি প্রজাদের বলি দিয়ে এই দিঘির মধ্যে ফেলে দিতেন। এ কারণেই এর নাম হয় গলাকাটা দিঘি।

জোড় বাংলা মসজিদ
গলাকাটা মসজিদ থেকে সামান্য পশ্চিম পাশে, সড়কের বিপরীত দিকে এক গম্বুজ বিশিষ্ট জোড় বাংলা মসজিদের অবস্থান। মসজিদটি খনন করা হয় ১৯৯৩ সালে। খননের সময় এখানে একটি ইট পাওয়া যায়, তাতে আরবি অক্ষরে লেখা ছিল ‘শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইন, ৮০০ হিজরি।’ ধারণা করা হয় ৮০০ হিজরির দিকে সুলতান মাহমুদ এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৯২-১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রততত্ত্ব বিভাগ খনন করে এটি উন্মোচিত করে। ছোট ছোট পাতলা ইটে গাঁথা এই মসজিদ ১১ ফুট উচুঁ একটি প্লাটফর্মের ওপর স্থাপিত।

মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার পোড়ামাটির নকশা অলঙ্করণে তিনটি মেহরাব। তার দুই পাশে রয়েছে ছোট ছোট পিলার। মাঝের কেন্দ্রীয় মেহরাবটিতে ফুল ও লতাপাতা আঁকা ইটের কাজ দৃষ্টিগোচর হয়। এটি মসজিদটির সংস্কৃত রূপ। মসজিদের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে। এটি অন্ধপুকুর নামে পরিচিত। জনশ্রুতি আছে, মসজিদের পাশে জোড়া কুঁড়েঘর ছিল বলেই এর নাম জোড় বাংলা মসজিদ।

মনোহর মসজিদ
১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রততত্ত্ব অধিদপ্তর বারোবাজার প্রতস্থলে খননকার্য পরিচালনা করে। সে সময় মনোহর ঢিবি নামক স্থান থেকে এই প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এ মসজিদটি যেখানে আবিষ্কৃত হয় তার পাশে একটি জলাশয় থাকায় একে মনোহর দিঘির মসজিদ নামে ডাকা হয়। খননের পর থেকে এটি প্রততত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন রয়েছে।

মনোহর মসজিদটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে লম্বাভাবে নির্মিত। অভ্যন্তরের আয়তন ২২.৬৭ ও ২২.৬৭ ফুট এবং মসজিদের দেয়ালগুলোর পুরুত্ব প্রায় পাঁচ ফুট। মসজিদের মিনারগুলো নির্মাণে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি সারিতে ৪টি করে স্তম্ভ মিলিয়ে মোট স্তম্ভের পরিমাণ ২৪টি। ধ্বংসাবশেষ দেখে ধারণা করা হয়, মসজিদের মাথায় গম্বুজ ছিল ৩৫টি এবং ৪টি মিনার ছিল। খননের ফলে দুটি মিনারের ৫ ফুট পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এর উত্তর-পশ্চিম কোণায় ছোট একটি কামরা রয়েছে যা ইমামের জন্য ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়।

গোড়ার মসজিদ
তাহেরপুর সড়ক ধরে সামান্য পশ্চিম দিকে এগুলে হাতের বাঁয়ে একটু ভেতরের দিকে আরেকটি মসজিদের দেখা মিলবে। এর নাম গোড়ার মসজিদ। এই মসজিদ চার গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদ থেকে ৩০ গজ পূর্ব দিকে প্রায় ৪-৫ বিঘা আয়তনের একটি প্রাচীন জলাশয় আছে। নাম গোড়াই পুকুর বা গোড়া পুকুর। বর্গাকারে নির্মিত এ মসজিদের প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে প্রায় ৩ ফুট এবং ভেতরের দিকে ২০ ফুট। লম্বা দেয়ালগুলো ৫ ফুট প্রশস্ত। চারকোণে আছে চারটি সুন্দর অষ্টকোনাকৃতির মিনার। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে ৩টি ও উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে ১টি করে খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ আছে। পশ্চিম দেয়ালে আছে দরজা বরাবর তিনটি মেহরাব। কেন্দ্রীয় মেহরাব অপেক্ষাকৃত বড়। মেহরাবগুলোতে পোড়া মাটির ফলকে ফল ও লতাপাতার অলঙ্করণ ছিল। এতদিন পরও পোড়া মাটির চিত্র ফলকগুলোর সৌন্দর্য তেমন নষ্ট হয়নি।

মসজিদটি খান জাহান আলী কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে প্রবল জনশ্রুতি আছে। ১৯৮৩ সালে এই মসজিদের সন্ধান পায় প্রততত্ত্ব অধিদপ্তর। মসজিদটি খননের সময় একটি কবরের সন্ধান মেলে। আরও শোনা যায়, পাশের কবরটি গোড়াই নামের কোনো এক দরবেশের। এ থেকেই এর নাম গোড়াই বা গোড়ার মসজিদ।

পীর পুকুর মসজিদ
আবারও তাহেরপুর সড়ক ধরে সামনে এগুতে হবে। দুটি বাঁক ঘুরলেই বিশাল দিঘি, নাম পীর পুকুর। পশ্চিম পাড়ের মাঝ বরাবর বেশ বড় আকৃতির মসজিদ পীর পুকুর মসজিদ। এই মসজিদও ছিল মাটির নিচে। এই মসজিদে ছাদ নেই, শুধু দেয়াল আছে। মসজিদটি লাল ইটের তৈরি। পীরপুকুর প্রতস্থলের পশ্চিমে মসজিদটির অবস্থান। ১৯৯৪ সালে খননের ফলে এ স্থানে ১৮.৪০দ্ধ১০.৮৫ মিটার পরিমাপের ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়। গম্বুজগুলোর সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। শুধ্ মসজিদের দেয়ালগুলো নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত টিকে আছে। মসজিদটির চার কোণে অলঙ্কৃত অষ্টভুজ কৌণিক বুরুজ সুষম ব্যবধানে আনুভূমিক বন্ধনী দ্বারা সজ্জিত ছিল।

পাঠাগার মসিজদ
মিঠাপুকুর মৌজায় একটি ছোট ও অনুচ্চ মসজিদ। আয়তাকার মসজিদটির পরিমাপ ১৫দ্ধ১২ মি.। ১৯৯৫ সালে খননের ফলে বহির্ভাগে ৬.৯দ্ধ৬.৯ মিটার পরিমাপের একটি বর্গাকার মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়। মসজিদের দেয়াল ১.৩৮ মিটার পুরু। মসজিদটির উপরের অংশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

নুনগোলা মসজিদ
বারোবাজার হাসিলবাগে অবস্থিত নুনগোলা মসজিদটিও বর্গাকৃতির একটি মসজিদ। মসজিদটিতে তিনটি অর্ধবৃত্তাকৃতির মেহরাব আছে। মেহরাবে ছোট ছোট বর্গাকৃতির মধ্যে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা আছে। মসজিদের বাইরের দেওয়ালে পর্যায়ক্রমিক খাড়া চাল ও খাঁজ আছে। এগুলোতে দিগন্ত রেখাকৃতির ছাচে গড়া নকশা আছে। মসজিদের ওপরে একটি গম্বুজ আছে।

শুকুর মল্লিক মসজিদ
শুকুর মল্লিক মসজিদ হাসিলবাগ মৌজায় অবস্থিত। এটি বারোবাজার থেকে ৩০০ মিটার দক্ষিণে। মোচাকৃতি মসজিদটি আনুমানিক ১২দ্ধ১০ মিটার পরিমাপের। পার্শ্ববর্তী কৃষিজমি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৩ মিটার। ১৯৯৬ সালের খননে বহির্পার্শ্বে ৬দ্ধ৬ মিটার পরিমাপের এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বর্গাকার মসজিদের ধ্বংসাবশেষ বের করা হয়। এর দেয়াল ১.২২ মিটার পুরু। গম্বুজ বিলুপ্ত এবং দেয়াল নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এর ৪টি অষ্টভুজ কৌণিক মিনার নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত টিকে আছে। মসজিদটির পূর্বদিকে আছে একটি প্রবেশপথ। কেন্দ্রীয় মেহরাবটি বহির্দিকে উদ্গত, ১.৫০ মিটার প্রশস্ত এবং ৪৯ সেন্টিমিটার গভীর। এটি মূলত বর্গাকাকৃতির এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। মসজিদটির উভয় পাশে একটি করে বন্ধ মেহরাবসহ পশ্চিম পাশে একটি অর্ধবৃত্তাকৃতির মেহরাব আছে। এই মেহরাবগুলো সজ্জিত করা হয়েছে পোড়া মাটির ঘণ্টা ও চেইন নকশায়। অপরূপ নকশাগুলো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

প্রতিটি মসজিদ ঘুরে দেখার সময় স্থানীয় মানুষ নানা গল্প শোনালেন। প্রততত্ত্ব বিভাগ মসজিদগুলোর তত্ত্বাবধান নিলেও চোখে পড়ার মতো তেমন সংস্কার করেনি। বর্ষা কিংবা দুর্যোগের দিনে নামাজ পড়তে বিশেষ অসুবিধে হয় মুসল্লিদের। সাতগাছিয়া মসজিদে এক অশীতিপর বৃদ্ধের দেখা মিলল। তিনি জানালেন, সেই যে খননের পর দায়সারা সংস্কার করে মোটামুটিভাবে নামাজ পড়ার উপযুক্ত করা হয়েছে, তারপর থেকে এর উন্নয়নে কারও তেমন উদ্যোগ কিংবা আয়োজনের দেখা মেলেনি। অথচ এই মসজিদগুলো সংস্কার করলে বারোবাজারও একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারত। বিদেশি পর্যটকদের কেউ কেউ শুধু এই মসজিদগুলো দেখার জন্য এখানে আসতেন। আশা করছি, প্রততত্ত্ব অধিদপ্তর বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে।