দুজন বডিগার্ড নিয়ে হলি আর্টিজান ক্যাফে বেকারিতে গিয়েছিলেন ব্যবসায়ী লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন। দুই বডিগার্ডের মধ্যে একজন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত নিরাপত্তা রক্ষী ঘটনার সময় ভিতরে অবস্থান করছিলেন। আরেকজন ছিলেন গাড়ির সঙ্গে। হামলার সময় দেশি-বিদেশি ১৩ জনসহ অবসরপ্রাপ্ত এই সেনাসদস্যও লুকিয়ে ছিলেন রেস্তোরাঁর নিচতলায়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় এই বডিগার্ড তার সঙ্গে আসেন। ফারাজ এই রেস্তোরাঁয় ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দুই বান্ধবীকে। এর মধ্যে একজন ভারতীয় নাগরিক তারুশি জৈন। তার বাবা দীর্ঘ ২০ বছর বাংলাদেশে বসবাস করছেন। বাবাকে দেখতে মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকা থেকে তাদের ভারত যাওয়ার কথা ছিল। আরেক বান্ধবী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অবিন্তা কবির। ফারাজ ও তার বান্ধবীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে জঙ্গিরা। পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে আর্টিজান রেস্তোরাঁয় প্রথম অভিযান চলার সময় বাইরে ফারাজের নিরাপত্তা রক্ষীর কাছে ভিতর থেকে ফোন করেন অপর নিরাপত্তা রক্ষী। এই সময় পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই ফোনে কথা বলেন ভিতরে অবস্থানকারী সদস্যের সঙ্গে। নিরাপত্তারক্ষী পুলিশকে বলেন, ‘স্যার আমি অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য। ফারাজের নিরাপত্তার জন্য ভিতরে ছিলাম। বিদেশিরাসহ আমরা আটকে আছি। আপনারা গুলি শুরু করে সামনে এগিয়ে এলে এদেরকে নিয়ে আমি বেরিয়ে আসতে পারব। কিন্তু আমার স্যার আমার সঙ্গে নেই। তিনি জিম্মি অবস্থায় কীভাবে আছেন, জানি না।’ এরপরই পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা গুলি চালাতে চালাতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় অনেক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এর মাঝে একটি সংস্থার দুজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে আহত হন। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, পাঁচ সন্ত্রাসী একে একে প্রবেশ করে হলি আর্টিজানে। প্রথমে একজন প্রবেশের দুই মিনিট পর আরেক অস্ত্রধারী ভিতরে ঢুকে। এভাবেই কয়েক মিনিটের মধ্যে পাঁচ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রেস্তোরাঁর ভিতরে মিলিত হয়। এরপরই শুরু হয় সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব। পুলিশের কাছে প্রথম খবর আসে, একদল সন্ত্রাসী চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গোলাগুলি করছে। সে অনুযায়ী পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে গুলশানের ডিসি মোসতাক ফোন করেন পুলিশ কমিশনারকে। তিনি কমিশনারকে জানান, স্যার ভয়াবহ ঘটনা। যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি, তা-ই ঘটতে যাচ্ছে। আমি স্পটে গেলাম, আপনি আসুন, স্যার। পুলিশ কমিশনার সঙ্গে সঙ্গে তারবার্তায় ডিএমপির পুলিশ সদস্যদের অ্যালার্ট করেন। গুলশান জোনের ছয় থানার পুলিশকে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলার নির্দেশ দেন। যাতে কোনো সন্ত্রাসী পালাতে না পারে। পুলিশ কমিশনারের নির্দেশ অনুযায়ী, ছয় থানার পুলিশ অবস্থান নেয়। এর মধ্যে দ্রুত পুলিশ কমিশনার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। গাড়িতে উঠেই তিনি সোয়াত টিমকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। একই সঙ্গে ডিএমপির সব পুলিশকে অ্যালার্ট করে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হতে বলেন। পুলিশ কমিশনার এসেই হলি আর্টিজানের কাছে চলে আসেন। তার পরনে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছিল না। বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন পুলিশ কমিশনারকে জ্যাকেট পরিয়ে দেন। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কমিশনার কথা বলেন। এরপরই আসে ফারাজের বডিগার্ডের ফোন। পুলিশ কমিশনার এ সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, যে কোনো মূল্যে আমরা ভিতরে প্রবেশ করে সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করব এবং চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করতে করতে পুলিশ সদস্যরা রেস্তোরাঁর মূল ফটকের ভিতের ঢুকে পড়ে। সন্ত্রাসীরা এ সময় গুলি চালাতে থাকে। গুলিবিনিময় চলাকালেই ফারাজের বডিগার্ড ও কয়েকজন বিদেশি নাগরিকসহ বেশ কয়েকজন বেরিয়ে আসেন। প্রধান ফটকের দিকে অগ্রসর হয়ে পুলিশ যখন গুলি চালাতে থাকে, ভিতর থেকে জঙ্গিরা গ্রেনেড চার্জ করে। এতে গোয়েন্দা পুলিশের এসি রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খানসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ আহত হন। পরে হাসপাতালে মারা যান এই দুই কর্মকর্তা। জানা গেছে, পুলিশ দ্বিতীয় দফা অভিযান চালানোর জন্য সাউন্ড গ্রেনেড, এপিসি গাড়ি, কাঁদানো গ্যাস নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। এ সময় বিদেশিদের রক্ষার জন্য এ অভিযান ধীরে যাওয়া ও সেনা নৌ কমান্ডোদের দিয়ে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ভোরে ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সফল অভিযান পরিচালিত হয়। মাত্র সাড়ে ১১ মিনিটের এই অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী একজন কর্মকর্তা জানান, পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে দৌড়ে পালাতে গিয়ে হোটেলের সেফ নিহত হন। জঙ্গিদের সঙ্গে দৌড়ানোর কারণেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন হোটেল সেফ সাইফুল। এ কারণে পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জঙ্গিদের সঙ্গে সাইফুলের মৃতদেহের ছবিও মিডিয়ায় পাঠানো হয়। পরে তার আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত আরও কয়েকজন জানিয়েছেন, সেই রাতে সেনা-নৌ, পুলিশ ও র্যাবের মধ্যে সমন্বয় ছিল। যে কারণে এই অভিযান সকালে পুরোপুরিভাবে সফল হয়। এ ছাড়াও বিজিবি গুলশান এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। আশপাশের ভবনে ছিল সোয়াত টিমও। শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদেরও দেখা যায় ঘটনাস্থলে। যা অভিযানকে সফল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিয়েছে। এভাবেই সেই রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা চরম ঝুঁকি নিয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে।
‘সন্দেহভাজন’ শাওনের মৃত্যু : রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় আহত জাকির হোসেন শাওন (২২) মারা গেছেন। শুক্রবার বিকাল সোয়া পাঁচটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে ১ জুলাই হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশ তাকে আটক করে। পুলিশ বলছে, শাওন সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী ছিল। তবে পরিবার বলছে, শাওন এক বছর ধরে হলি আর্টিজানে বাবুর্চির সহকারী হিসাবে কাজ করছিল। সে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয়। শাওনের কোনো খোঁজ-খবর না পেয়ে ৩ জুলাই বিকালে হলি আর্টিজান বেকারির সামনের সড়কে আসেন তার মা মাহমুদা বেগম। মোবাইলে ছেলের পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবিও তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের দেখান।এরপর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ছেলেকে না পেয়ে পরদিন আবারো হলি আর্টিজানের সামনে আসেন।