অসিম কুমার ও অপু উকিলের রাজনৈতিক বিয়ের গল্প

দু’জনের জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শ অভিন্ন। দেশ, মানুষ ও সমাজের জন্য রাজনীতি। দু’জনারই অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধু। তাদের পরিচয় রাজপথের মিছিলে। সংগঠনের কাজের আঙিনায় নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় ঘটে শুভ পরিণয়। বলা যায়, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রেম ও পরিণয়ের গল্প।

বলছিলাম বাংলাদেশের রাজনীতির পরিচিত মুখ অসীম কুমার উকিল ও অধ্যাপিকা অপু উকিলের কথা। একজন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক। অন্যজন যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জল এই দম্পতি বর্তমানে দুই ছেলে সন্তানের জনক-জননী। বড় ছেলে শায়ক উকিল ফ্লোরিডায় আটলান্টিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। ছোট ছেলে শুদ্ধ উকিল এবার ও লেভেল দেবেন।



আসলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের এক হওয়া, দু’জনকে এক করা- তাতে সফল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই জুটির প্রেম ও বিয়ের সেতু বন্ধনের মূল দ্বায়িত্বটা তিনিই পালন করেছিলেন।

অপু উকিল বলেন, আমি যখন ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকেই লেখালেখি করতাম। গল্প ছাপানোর জন্য বাংলার বাণীতে যেতাম। কাদের ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তখন থেকেই মূলত ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। সেই সময় কাদের ভাই বলতেন, প্রেমটেম করবে না। আমি তোমার জন্য ছেলে ঠিক করে দেব।

আমি যখন অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি, তখন কাদের ভাই একদিন বললেন- আমি কিন্তু তোমার জন্য পাত্র ঠিক করে ফেলেছি। তখন নাম বললেন- অসীম কুমার উকিল। তিনি তখন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আমি কিছুই বললাম না। আসলে তখনও এগুলো নিয়ে ওইভাবে কিছু ভাবিনি। কাদের ভাই বললেন, দেখ আমি চাই না তুমি রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাও। হিন্দু মেয়েরা তো রাজনীতিতে আসেই না। বেশিরভাগই আবার বিয়ের পরে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়। তুমি রাজনীতিতে যাতে থাকো; সেজন্য আমি চাই সেই রকম একটা ছেলে। যার সঙ্গে বিয়ে হলে তোমার রাজনীতিতে সে বাধা না হয়। আবার সে নিজেও রাজনীতি করবে।

শুরুতেই বলেছি তাদের প্রেম বা পরিণয় কোনোটাই আর দশজনের মতো নয়। তাদের প্রথম দেখাটাও তেমন। অসীম কুমার উকিল তখন বড় নেতা। তার সঙ্গে সেইভাবে কথাবার্তা বলেন না অপু উকিল। আসলে বলতে ভয় পান। …আমি তখন একটা কলেজ শাখার সভাপতি। আর সে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আমি তো চুপ। বলছিলেন অপু উকিল।

অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের ভাই একই কথা বলেছেন অসীম কুমার কেও। ‘আমি তোমার জন্য পাত্রী ঠিক করে রেখেছি। কিন্তু নাম বলেননি। অনেক সময় স্ত্রীরা রাজনীতি করতে দিতে চায় না। তাই আমি এই মেয়েটিকে ঠিক করেছি। দেখো কথা বলে..’

প্রথম দিনে দাদার সঙ্গে কী কথা হলো? হেসে জবাব- কী আর হবে। সাংগঠনিক কথাবার্তাই হলো। উনি জিজ্ঞেস করলেন সংগঠনের কী অবস্থা? মিছিল আছে কাল, চলে এসো। আসলে দু’জনই অ্যাবনরমাল হয়ে গিয়েছিলাম। তাই পরিবেশটা নরমাল করার জন্য এগুলো বলছিলো। পরে সেদিনের মতো চলে আসি।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সেই সময় ছাত্ররাজনীতিটা সহজ ছিল না, তা বোঝা গেল কথাতেই। ‘আমি তখন দল-বল নিয়ে চলতাম। একা কোথাও যেতাম না। তখন রাজনীতি এত সহজ ছিল না। কার কখন কী হয়, কিছুই বলা যায় না। তো সেখানেও (প্রথম দেখা করার দিন) দল নিয়েই গেছি। ওরা বিষয়টা টের পেয়ে গেছে। এর পরে তো আমি লজ্জায় আর মধুর ক্যান্টিনে যাই না, প্রোগ্রামে যাই।’

‘১০-১২ দিন পরে আলম ভাই (শাহ আলম, ছাত্রলীগের সভাপতি) ফোন দিলেন। তখন তো এখনকার মতো মোবাইল ফোন ছিল না। হলের ল্যান্ডফোনে কল দিলেন। পরের দিন পান্না ভাইকে (ইসহাক আলী পান্না) আমার হলের নিচে পাঠান একটা চিরকুট দিয়ে। তাতে লেখেন ৫০ জন নেতাকর্মী নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে আসার জন্য। প্রোগাম শেষে মেয়েরা রিকশায় উঠছে, চলে আসবে। এর মধ্যে সুজন ভাই আমাকে এসে বলেন- ‘এই শোনো, তুমি যেও না। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
‘তারা তো সিনিয়র নেতা আমি ভয় পেয়ে গেছি। আমি বললাম, আমার সঙ্গে দু’জন থাকুক। বললো না, তুমি ওদের বিদায় করো। পরে দেখি একটা গাড়ির মধ্যে আলম ভাই আর সুজন ভাই বসে আছেন। আমাকে বললেন উঠ, উঠ…উঠালো। পরে শাহবাগ থেকে আপনার অসীম দাকে তুলে নিল ওরা। তখন ঢাকা তো অনেক ফাঁকা। এতো দোকান ছিল না। একটা চাইনিজ ছিল বলাকা। ওখানে খেতাম। কিন্তু আমাকে তখন গুলশানে নিয়ে গেলেন। সি ফুড নামে একটি রেস্তোরায়। আমি তো ভয়ে ভয়ে বললাম আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমাকে আলম ভাই বললেন, ভয় পেও না, আমি তো তোমার ভাই আছিই।

সেখানেই প্রথম তোমার দাদার সঙ্গে একাকী কথা বললাম। প্রথম দিনেই তোমার দাদা তার সম্পর্কে তার পরিবার সম্পর্কে সব কথা আমাকে বললেন। তিনি বললেন যে, এগুলো তোমার জানার দরকার। তবে আমার সম্পর্কে বললেন- তুমি ছাত্রলীগ করো, তাই আর কোনো খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই। এটাই বড় পরিচায়।

সেদিনই আমাকে তার বাসার পারসোনাল ফোন নম্বর দিলেন। বললেন- (হেসে) দেখ এখন আমার বিয়ের বয়স। প্রেম করার বয়স নেই। আন্দোলন সংগ্রাম করতে করতে প্রেমের বয়স শেষ। এভাবেই চলছিল। ফোনে কথা হতো খুব কম। দেখা যা হওয়ার তা হতো সংগঠনের কর্মসূচিতেই। এর মধ্যে আমার কলেজের নির্বাচন হলো। ছাত্রদলের সঙ্গে মারামারিও হলো একবার। পরে একবার আমি হলে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তখন দেখলাম ছাত্র নেতারা আমাকে দেখতে আসছে। আসলে ভেতরে ভেতরে সবাই জেনে গেছে। আমি তখন ব্যাকওয়ার্ড পজিশনে (হাসি)। ভাবছি আরে কী হলো। এর পরে আস্তে আস্তে আর কী…তবে আমাদের যতটা তার চেয়েও নেতাকর্মীদের মুখে মুখে আরও বেশি। এরই মধ্যে কাদের ভাই নেত্রীকে (আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) জানিয়েছেন।

আর দশটা প্রেমিক প্রেমিকার মতো রমনায় গিয়ে প্রেমটা হয়নি কখনো। মহিলা হোস্টেলের সামনেও কথা হয়নি কোনো দিন। দেখা কথা বা প্রেম সবই হতো, মিছিল, রাজপথে বা দলীয় কর্মসূচিতে। এ বিষয়ে মৃদু হেসে অপু উকিল বলেন, আপনার দাদা আসলে তখন খুব মুডি মানুষ ছিলেন। কেউ তাকে নিয়ে কিছু বলুক, এটা তিনি কোনোভাবেই চাইতেন না।

বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও সুতো গাঁথার দ্বায়িত্বটাও পালন করেন রাজনৈতিক সতীর্থরাই। এ প্রসঙ্গে অপু উকিল বলেন, প্রয়াত রাজ্জাক ভাই (আবদুর রাজ্জাক) আমার বাবা-মামার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমার শ্বশুরবাড়ির লোজজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। কাদের ভাই নিজেও আমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কথা বলেছেন। পরে দুই পরিবারই রাজি হয়।

১৯৯৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের দিনের মজার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের বিয়েটাও ঐতিহাসিক। তখন তো শরিয়তপুরে রাস্তাঘাট তেমন ছিল না। সবাই লঞ্চে করে গেছেন, ব্যানার নিয়ে, মিছিল নিয়ে। ব্যানারে লেখা অসীম-অপু পরিষদ (হাসি)। তখন মোটামুটি ছাত্রলীগের সবাই গিয়েছিল। বিয়েতে যাতে কম না পড়ে সেজন্য অতিরিক্ত খাসি-টাসি কেনা ছিল। তারা আসার সময় ওগুলো নিয়ে এসেছে। ঢাকায় এনে টিংকু ভাইয়ের বাসায় (পল্টনে) রেখেছে। পরে আবার ছাত্রলীগের সব নেতাকর্মীরা মিলে রান্না করে খেয়েছে। মানে এক কথায় বললে- পুরো রাজিনৈতিক বিয়ে হয়েছিল।

এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। আজকের অপু উকিল আর অসীম উকিলকে চেনেন দেশের রাজনীতি সচেতন অধিকাংশ মানুষ। তাদের সেই জুটি এখনো অটুট আছে, থাকবে।

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর