ঢাকা , শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিশুদের মসজিদে নেয়া প্রসঙ্গে

রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করতেন, তখন নাতিদ্বয় হাসান ও হুসাইন (রা.) তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসতেন। এমনকি তাদের এ খেলায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সে কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) সিজদায় বিশেষ সময় ক্ষেপণ করতেন। সাহাবিরাও তা প্রত্যক্ষ করতেন। এমন কোনো হাদিস পাওয়া যায় না যে, রাসুল (সা.) শিশুদের মসজিদে নিতে নিরুৎসাহিত কিংবা নিষেধ করেছেন 

আমাদের মাঝে বিশেষ একটা ভুল ধারণা হলো, ছোট ছোট শিশুকে মসজিদে নেয়া যাবে না কিংবা গেলেও তাদের সবার পেছনে অথবা একেবারে এক পাশেই দাঁড়াতে দিতে হবে। তাতে যতটা না সমস্যা, তার চেয়ে বেশি সমস্যা এমনভাবে এটা বলা হয় অথবা এমন ব্যবহার তাদের এবং তাদের অভিভাবকের সঙ্গে করা হয় সেটা। অভিভাবকরা অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। অথচ আমরা জানি, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করতেন, তখন তাঁর নাতিদ্বয় হাসান ও হুসাইন (রা.) তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসতেন। এমনকি তাদের এ খেলায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সে কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) সিজদায় বিশেষ সময় ক্ষেপণ করতেন। সাহাবিরাও তা প্রত্যক্ষ করতেন। এমন কোনো হাদিস পাওয়া যায় না যে, রাসুল (সা.) শিশুদের মসজিদে নিতে নিরুৎসাহিত কিংবা নিষেধ করেছেন। বরং আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) তাদের মসজিদে এবং ঈদের মাঠে নিতে আদেশ করেছেন। (বোখারি)। এছাড়া মসজিদে নববি ছিল তখনকার পাঠশালা-স্কুল-মাদরাসা-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী ও শিশু সবাই শিক্ষাগ্রহণ করতেন। মসজিদ ছিল সব ধরনের বিনোদন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের স্থান। সেখানে শিশুদের অবাধ চলাফেরাও ছিল স্বাভাবিকভাবে। তাহলে আমরা কেন আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করব?

হ্যাঁ একটা যুক্তি হয়তো দেয়া যেতে পারে, ছোট শিশুদের মসজিদে নিলে তারা প্রস্রাব-পায়খানা বা নোংরা করে দিতে পারে। এমন সম্ভাবনা থাকলে সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে। তাই বলে তাদের মসজিদে নেয়া যাবে না, তা কখনোই হতে পারে না। তাছাড়া এখন তো বাচ্চারা প্যাম্পার্স পরে থাকে, তাতে সে সম্ভাবনা আর থাকে না। সুতরাং এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করা উচিত।
অপর পক্ষে একটা কথা চিন্তা করুন, ছোট বাচ্চাদের যদি এ বয়সেই মসজিদে নেয়ার অভ্যাস না করি, তাহলে ওদের অভ্যাস কীভাবে হবে? যেদিন তাদের ওপর সালাত ফরজ হবে আর সকালে উঠেই যদি বলেন ‘চলো মসজিদে যাই’ আর ওমনি সে আপনার সঙ্গে মসজিদে যাবে, এমন ভাবা কতটা যৌক্তিক হবে বিবেচনা করুন। অন্যভাবেও চিন্তা করে দেখুন, যে সময়টা সে আপনার সঙ্গে মসজিদে যাবে-আসবে এবং সালাতসহ অন্যান্য কাজে মগ্ন থাকবে, সে সময়টাতে কিন্তু বাসায় পড়ালেখার পাশাপশি হয়তো বসে টিভি দেখা, কম্পিউটারে কিংবা মোবাইলে গেম খেলায় ব্যস্ত থাকে। ভার্চুয়াল জগতের আজকের শিশুদের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত করতে তাদের ছোটবেলাতেই মসজিদমুখী করতে হবে।
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে তাদের মসজিদে নিলে একটা বিশেষ শিক্ষা তারা পাবে, যাতে আরও জীবনমুখী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ইসলামের শিক্ষাটাও তেমন। চিন্তা করে দেখুন, বিভিন্ন ও জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে শিশুদের তাদের মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরা ঘাড়ে চড়িয়ে নিয়ে যায়। তাতে শিশুরা এসব কাজে আরও উৎসাহ বোধ করে। অপর পক্ষে ইসলামী অনুশাসনের বেলায় তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়, যা তাদের ইসলাম থেকে যোজন যোজন দূরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করছে। তারা হয়তো এসব ইসলামী কার্যক্রমের কথা জানতেই পারছে না।
আমি মালয়েশিয়ায় থাকাকালীন আইআইইউএমের মসজিদে দেখেছি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে উভয়ই তাদের মা-বাবার সঙ্গে ইতিকাফ পর্যন্ত করতে। কাবার চত্বরে তাওয়াফ করতে, সাঈ করতে, কাতারে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে দেখেছি অনেককেÑ এটাই তো ইসলামের শিক্ষা। এ শিক্ষা থেকে আমরা আমাদের সন্তান, ভাই-বোনদের দূরে রাখছি বলেই শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে অপসংস্কৃতিতে, ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে। এসবের প্রতিকার এখন আবশ্যক।
আপনার-আমার একটু দৃষ্টিভঙ্গিই পরিবর্তন করতে পারে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে পারবে সুন্দর জীবন। শিশু ও কিশোরদের অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে নিশ্চিত। সুতরাং আসুন আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
লেখক ও গবেষক

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

শিশুদের মসজিদে নেয়া প্রসঙ্গে

আপডেট টাইম : ০১:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ জুলাই ২০১৭

রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করতেন, তখন নাতিদ্বয় হাসান ও হুসাইন (রা.) তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসতেন। এমনকি তাদের এ খেলায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সে কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) সিজদায় বিশেষ সময় ক্ষেপণ করতেন। সাহাবিরাও তা প্রত্যক্ষ করতেন। এমন কোনো হাদিস পাওয়া যায় না যে, রাসুল (সা.) শিশুদের মসজিদে নিতে নিরুৎসাহিত কিংবা নিষেধ করেছেন 

আমাদের মাঝে বিশেষ একটা ভুল ধারণা হলো, ছোট ছোট শিশুকে মসজিদে নেয়া যাবে না কিংবা গেলেও তাদের সবার পেছনে অথবা একেবারে এক পাশেই দাঁড়াতে দিতে হবে। তাতে যতটা না সমস্যা, তার চেয়ে বেশি সমস্যা এমনভাবে এটা বলা হয় অথবা এমন ব্যবহার তাদের এবং তাদের অভিভাবকের সঙ্গে করা হয় সেটা। অভিভাবকরা অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। অথচ আমরা জানি, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করতেন, তখন তাঁর নাতিদ্বয় হাসান ও হুসাইন (রা.) তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসতেন। এমনকি তাদের এ খেলায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সে কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) সিজদায় বিশেষ সময় ক্ষেপণ করতেন। সাহাবিরাও তা প্রত্যক্ষ করতেন। এমন কোনো হাদিস পাওয়া যায় না যে, রাসুল (সা.) শিশুদের মসজিদে নিতে নিরুৎসাহিত কিংবা নিষেধ করেছেন। বরং আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) তাদের মসজিদে এবং ঈদের মাঠে নিতে আদেশ করেছেন। (বোখারি)। এছাড়া মসজিদে নববি ছিল তখনকার পাঠশালা-স্কুল-মাদরাসা-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী ও শিশু সবাই শিক্ষাগ্রহণ করতেন। মসজিদ ছিল সব ধরনের বিনোদন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের স্থান। সেখানে শিশুদের অবাধ চলাফেরাও ছিল স্বাভাবিকভাবে। তাহলে আমরা কেন আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করব?

হ্যাঁ একটা যুক্তি হয়তো দেয়া যেতে পারে, ছোট শিশুদের মসজিদে নিলে তারা প্রস্রাব-পায়খানা বা নোংরা করে দিতে পারে। এমন সম্ভাবনা থাকলে সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে। তাই বলে তাদের মসজিদে নেয়া যাবে না, তা কখনোই হতে পারে না। তাছাড়া এখন তো বাচ্চারা প্যাম্পার্স পরে থাকে, তাতে সে সম্ভাবনা আর থাকে না। সুতরাং এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করা উচিত।
অপর পক্ষে একটা কথা চিন্তা করুন, ছোট বাচ্চাদের যদি এ বয়সেই মসজিদে নেয়ার অভ্যাস না করি, তাহলে ওদের অভ্যাস কীভাবে হবে? যেদিন তাদের ওপর সালাত ফরজ হবে আর সকালে উঠেই যদি বলেন ‘চলো মসজিদে যাই’ আর ওমনি সে আপনার সঙ্গে মসজিদে যাবে, এমন ভাবা কতটা যৌক্তিক হবে বিবেচনা করুন। অন্যভাবেও চিন্তা করে দেখুন, যে সময়টা সে আপনার সঙ্গে মসজিদে যাবে-আসবে এবং সালাতসহ অন্যান্য কাজে মগ্ন থাকবে, সে সময়টাতে কিন্তু বাসায় পড়ালেখার পাশাপশি হয়তো বসে টিভি দেখা, কম্পিউটারে কিংবা মোবাইলে গেম খেলায় ব্যস্ত থাকে। ভার্চুয়াল জগতের আজকের শিশুদের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত করতে তাদের ছোটবেলাতেই মসজিদমুখী করতে হবে।
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে তাদের মসজিদে নিলে একটা বিশেষ শিক্ষা তারা পাবে, যাতে আরও জীবনমুখী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ইসলামের শিক্ষাটাও তেমন। চিন্তা করে দেখুন, বিভিন্ন ও জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে শিশুদের তাদের মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরা ঘাড়ে চড়িয়ে নিয়ে যায়। তাতে শিশুরা এসব কাজে আরও উৎসাহ বোধ করে। অপর পক্ষে ইসলামী অনুশাসনের বেলায় তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়, যা তাদের ইসলাম থেকে যোজন যোজন দূরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করছে। তারা হয়তো এসব ইসলামী কার্যক্রমের কথা জানতেই পারছে না।
আমি মালয়েশিয়ায় থাকাকালীন আইআইইউএমের মসজিদে দেখেছি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে উভয়ই তাদের মা-বাবার সঙ্গে ইতিকাফ পর্যন্ত করতে। কাবার চত্বরে তাওয়াফ করতে, সাঈ করতে, কাতারে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে দেখেছি অনেককেÑ এটাই তো ইসলামের শিক্ষা। এ শিক্ষা থেকে আমরা আমাদের সন্তান, ভাই-বোনদের দূরে রাখছি বলেই শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে অপসংস্কৃতিতে, ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে। এসবের প্রতিকার এখন আবশ্যক।
আপনার-আমার একটু দৃষ্টিভঙ্গিই পরিবর্তন করতে পারে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে পারবে সুন্দর জীবন। শিশু ও কিশোরদের অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে নিশ্চিত। সুতরাং আসুন আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
লেখক ও গবেষক