সাশ্রয়ী দাম ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃপ্রকৃতি সংরক্ষণ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদনের আহ্বান জানিয়েছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। কমিটি মনে করে, বিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রধান উত্স হতে হবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি। আর মূল চালিকাশক্তি হবে জাতীয় সংস্থা, দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও জনউদ্যোগ। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সরকারের জ্বালানি ও বিদ্যুত্ মহাপরিকল্পনা (২০১৭-৪১)-এর বিপরীতে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবের খসড়া রূপরেখায় এসব কথা বলা হয়। সরকারের মহাপরিকল্পনার বিপরীতে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সাল পর্যন্ত ৯১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার রয়েছে ৫৫ শতাংশ, প্রাকৃতিক গ্যাস ৩৭ শতাংশ ও অন্যান্য উত্স ৮ শতাংশ। এসব বিদ্যুতের দামও অনেক কম দেখানো হয়েছে। প্রস্তাবিত রূপরেখা তুলে ধরেন জাতীয় কমিটির সদস্য ও গবেষক মাহা মির্জা। তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠীর আধিপত্য থেকে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতকে মুক্ত করতে হবে। এতে দেশ ও জনগণের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি না করে সর্বোচ্চ চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত্ ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো সম্ভব। অনুষ্ঠানে জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, বিদ্যুত্ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার মূল বৈশিষ্ট্য হল আমদানি ও রাশিয়া-চীন-ভারতের ঋণনির্ভরতা। সরকারের বিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রধান উত্স হল কয়লা, এলএনজি ও পারমাণবিক। যা পরিবেশবিধ্বংসী। এর মূল চালিকাশক্তি হল বিদেশি কোম্পানি অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক। এর বিপরীতে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়, এই খাতের মূল বৈশিষ্ট্য হতে হবে দেশের সম্পদের ওপর নির্ভরতা। রাশিয়া-চীন-ভারতের ঋণমুক্ত ও অনুকূল পরিবেশ। প্রস্তাবে বলা হয়, ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তার বিপরীতে ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে টার্গেট থেকে অনেক বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন সম্ভব। প্রস্তাবে বলা হয়, বিদ্যুতের দামও এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী (২০১৫-এর দাম স্তর অনুযায়ী) ১২ টাকা ৭৯ পয়সার বিপরীতে ৫ টাকা ১০ পয়সায় আনা সম্ভব। সভায় আনু মুহাম্মদ বলেন, জ্বালানি ও বিদ্যুত্ খাতে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, আমরা কখনও দ্বিমত করিনি যে আমাদের বিদ্যুত্ প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা দেখিয়ে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লা প্রকল্পের প্রয়োজন নেই। সরকার যেভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে চায়, এটা হলে দেশ ঋণের শৃঙ্খল ও আধিপত্যের মধ্যে পড়বে, পানি-মাটি-পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে জাতীয় কমিটি বিকল্প প্রস্তাব হাজির করছে। তিনি বলেন, শুধু এলএনজি আমদানির কথা বলা হচ্ছে। এর ফলে গ্যাসের এবং বিদ্যুতের দামও বাড়বে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথাও সরকার বলে। বিদেশে এ নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে অথচ দেশে কোনো অগ্রগতি নেই। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিবেশবিনাশী পথ বাতিল করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভরতার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অথচ আমরা এসব চিন্তা করছি না। তাই দেশের সৌর-বায়ু-বর্জ্যের ব্যবহার বাড়িয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুত্ উত্পাদন ধরা হয়েছে ২৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট; ব্যবহার করা হবে গ্যাস ৩৪ শতাংশ, এলএনজি ১১ শতাংশ, কয়লায় ৩০ শতাংশ, তেল ১৫ শতাংশ, আমদানি/নবায়নযোগ্য ১০ শতাংশ। অন্যদিকে বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবে এ সময়ে ২৫ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস ৫৯ শতাংশ, তেল ১৯ শতাংশ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ১০ শতাংশ ব্যবহার করা হবে, অন্যান্য ১২ শতাংশ। একইভাবে ২০৩১ সাল পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে সরকার কয়লা ব্যবহার করবে ২৬ শতাংশ, এলএনজি ১৭ শতাংশ, গ্যাস ১৩ শতাংশ, পারমাণবিক শক্তি থেকে ১৪ শতাংশ, তেল ১৫ শতাংশ। বিপরীতে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই সাল পর্যন্ত ৪৯ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে ব্যবহার হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৩৯ শতাংশ, গ্যাস ৪৯ শতাংশ, অন্যান্য ১২ শতাংশ। ২০৪১ সাল পর্যন্ত ৫৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে সরকার ব্যবহার করবে কয়লা ৩৫ শতাংশ, এলএনজি ২৩.৭ শতাংশ, গ্যাস ১১.৩ শতাংশ আমদানি, নবায়নযোগ্য ১৫ শতাংশ, তেল ৫ শতাংশ, পারমাণবিক শক্তি থেকে ১০ শতাংশ। জাতীয় কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে ৯১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার রয়েছে ৫৫ শতাংশ, প্রাকৃতিক গ্যাস ৩৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ৮ শতাংশ যা পরিবেশ রক্ষায় উপযুক্ত এবং উত্পাদন খরচ অনেক কম। আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, সরকারের এ পরিকল্পনায় ২০২১ সালে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ১১.৫৬ টাকা, ২০৩১ সালে ৩১.৯৪ টাকা ও ২০৪১ সালে ৭৯.১৪ টাকা। জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় এই দাম হবে যথাক্রমে ৭.৬৫ টাকা, ২০.০৭ টাকা এবং ৫০.১৯ টাকা। সভায় বক্তব্য রাখেন রাজনীতিক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, প্রকৌশলী মাহাবুব সুমন, সুজিত চৌধুরী, রাজনীতিক সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকী, টিপু বিশ্বাস, রুহিন হোসেন প্রিন্স, মোশরেফা মিশু প্রমুখ।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর