বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ঠোঁট বাঁকিয়ে সেলফি তুলছেন অনেকেই। তাদের ঠোঁট জোড়া রাঙানো লাল, কমলা, গোলাপি রঙের লিপস্টিকে। এক বা দুইজন নয় শত শত নারীর মিলন মেলা একটি খোলা মাঠে। তাদের বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ১৮ বছর। জানেন কি?তাদের সবার মধ্যেই একটি মিল রয়েছে। এসব সুন্দরী নারীরা সবাই কুমারী। পৃথিবীর কোথাও একসঙ্গে এতো শত কুমারী নারীর মিলনমেলা সম্ভবত কোথাও ঘটে না! তবে এ কীসের মিলনমেলা?
এসব যুবতী নারীরা বুলগেরিয়ার কালাইধাঝি সম্প্রদায়ের বাসিন্দা। তারা সবাই রোমা কমিউনিটির আওতাধীন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। পুরো বিশ্বে অন্তত ১৮ হাজার কালাইধাঝি’র বাসিন্দা রয়েছে। এই উপজাতিরা এক ভিন্ন সংস্কৃতি চর্চা করে। সেই বিষয়ক অবাক করা তথ্য থাকছে আজকের এই লেখায়। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক বুলগেরিয়ার কালাইধাঝি সম্প্রদায়ের এক অবিশ্বাস্য কর্মকাণ্ড সম্পর্কে-
কালাইধাঝি সম্প্রদায়ের কুমারী নারীদেরকে ‘ব্রাইডাল মার্কেট’ বা ‘বউ হাটে’ বিক্রি করা হয়। একজন কিশোরীর প্রথম মাসিকের পরই তার পড়ালেখার পাঠ চুকে যায়। তাকে বউ হাটে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। সেখানে পুরুষরা জড়ো হন বউ খোঁজার আশায়। মন মতো সুন্দরী নারী মিললে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়া হয় কুমারীকে। যুগ যুগ ধরে কালাইধাঝি সম্প্রদায়ের মানুষরা এই রীতিই মেনে আসছে।
বুলগেরিয়ান একাডেমিক অব সায়েন্সের অধ্যাপক অ্যালেক্সি পামপোরভের মতে, জোর করে হলেও সদ্য মাসিক হওয়া কুমারী মেয়েটিকে পরিবারই এ কাজে বাধ্য করে। স্কুলে পড়াও বন্ধ করে দেয়া হয় তাদের। তখন পরিবার থেকে তাদেরকে উপযুক্ত পাত্রীর ন্যায় তৈরি করে হাটে পাঠানো হয়। অনেক মায়েরা তাদের মেয়েকে সুন্দরী করতে ফর্সা হওয়ার ক্রিম ব্যবহার করান। আবার দামি পোশাক ও মেকআপে মেয়ের চেহারায় পরিবর্তন আনেন।
বিয়ের জন্য এভাবেই মেয়েকে প্রস্তুত করা হয়। কারণ মেয়ে বেশি টাকায় বিক্রি হলে লাভবান হবে পরিবারগুলো। অ্যালেক্সি পামপোরভ আরো বলেন, অত্যন্ত বর্বরতম এই নিয়মটি যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে কালাইধাঝি সম্প্রদায়ের মানুষরা। একটি খোলা মাঠেই বসে বউয়ের বাজার।
সেখানে জড়ো হয় সব সুন্দরীরা। গাউন পরে কুমারীরা একে একে লাল রঙা কার্পেটের উপর দিয়ে হাঁটে। তখনই পাশে থাকা পুরুষরা তাদেরকে মনে ভরে দেখেন। কেউ এসে আলাপ সারেন আবার কেউ পছন্দের নারীর সঙ্গে নাচেন এবং খোশগল্পে মশগুল হয়ে সময় কাটান। অতঃপর বিয়ের প্রস্তাব ও অর্থের বিয়ে নিয়ে আলাপচারিতা করেন।
অর্থের মাধ্যমে বউ কেনার এই প্রথার মাধ্যমে অনেকেই হয়ত কুমারী নারীকে কিনতে পারেন। তবে সেখানে বিয়ের বিষয়টি আদৌ সুসম্পন্ন হয় কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়!
অ্যালেক্সি বলেন, আমি কালাইধাঝি’র অনেক নারীর সঙ্গে কথা বলেছি। তবে তারা কেউই যুগ যুগ ধরে চলে আশা এই নিষ্ঠুরতম প্রথা মেনে নিতে পারেননি। তারা নিজেদের জীবনকে এক অভিশাপ হিসেবেই ভাবে। এসব নারীরা স্বাধীন হতে চায়।
নিয়মমাফিক বিয়ের প্রথা মেনে সুন্দরভাবে বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে চায়। তবে তারা সবাই সামাজিক রীতির বেড়াজালে আটকে রয়েছে। তারা কেউই এ কাজ করতে চায় না। পরিবার তাদেরকে বাধ্য করে। তাদেরই একজন হলেন ১৩ বছরের মিল্কা নিকোভা। এই ছোট্ট মেয়েটির বিয়ে হয়েছে মাত্র ১৭ বছরের একটি ছেলের সঙ্গে।
এবার আপনিই ভাবুন, তাদের ভবিষ্যৎ কী? কে কার দায়ত্ব নেবে তারা? ব্রাইডাল মার্কেটেই তাদের পরিচয়। এরপর বিয়ে অর্থাৎ টাকার মাধ্যমে তার স্বামী ইভান আনকোভ কিনে নেয় তাকে। জানলে অবাক হবেন, মাত্র তিন লাখ টাকায় মিল্কিকে তার স্বামী কিনে নেয় বউ হিসেবে।
এ বিষয়ে মিল্কি জানায়, স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার পর মা আমাকে এই বাজারে নিয়ে আসে। প্রথমবারই আমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় হয় এই বাজারে। এরপর তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মা আমাকে বিক্রি করে দেয়। শুধু আমি নয় বরং আমাদের সম্প্রদায়ের সব মেয়েরাই এভাবে বউ হাটে বিক্রি হয়।
দুই লাখ ৩০ হাজার থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বউ কেনা বেচা হয়ে থাকে এই বাজারে। বছরে চারবার এই ব্রাইডাল মার্কেট বসে। যেখান থেকে পুরুষরা দরদাম করে বউ কিনতে পারে। অবশ্য সঙ্গিনীর সঙ্গে পরিচিত হতে পুরুষরা একটু হাত মেলানো কিংবা কোমর ধরে নাচতেও পারেন। এতোটুকু সুযোগ অবশ্য দিয়েছে কুমারীরা।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, মা-বাবা নিজ হাতে দরদাম করে কন্যাকে অন্য ছেলের হাতে তুলে দেন শুধু অর্থের বিনিময়ে। তেমনই এক মা ভিরা। তিনি তার কন্যার জন্য দামি দামি জামা কাপড় কিনেছেন, সুন্দর করে সাজিয়েছেন। তিনি জানান, প্রথম মাসিকের পরই আমার মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ আমরা ঝুঁকি নিতে চাইনি, যদি সে কুমারীত্ব হারায়।
প্রতিটি পরিবারের সদস্যরাই তাদের মেয়ের কুমারীত্ব নিয়ে ভয়ে থাকে। যদি কেউ কুমারীত্ব হারায় তবে তাদেরকে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা যায় না। এমনকি সমাজ তাদের অত্যন্ত নিচু স্তরের বলে মনে করে। ভিরার কন্যা পেপা বলেন, আমার বয়স মাত্র ১২। মা আমাকে ব্রাইডাল মার্কেটে নেয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাদের সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী অবশ্যই নারীদের প্রথম বিয়ের আগে কুমারী থাকতে হয়।
এতে করে স্বামীর কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়। পেপার চাচাতো বোন মিমা বলেন, ব্রাইডাল মার্কেটে পুরুষদের সঙ্গেও তাদের পরিবারের লোকেরা আসেন। এমনো হয় যে, ছেলে একটি মেয়েকে পছন্দ করেছে কিন্তু তার পরিবার করেনি, সেক্ষেত্রে বিয়ে হবে না।
আবার অনেক সময় পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে একটি ছেলে অপছন্দ স্বত্ত্বেও হাট থেকে বউ কেনেন। এক্ষেত্রে ওই মেয়েটি শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে নানা ধরনের অত্যাচারের সম্মুখীণ হয়। যদিও মেয়ের পরিবার সবসময়ই চায় উপযুক্ত ও বিত্তবান পুরুষের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে।
তবে যদি কম বয়স্ক ছেলে অত্যাধিক দাম দিতে পারে তবে তার সঙ্গেও কন্যাকে বিয়ে দেন অনেক পরিবার। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল মিল্কির সঙ্গে। স্বামী ইভান তিন লাখ টাকা দিয়ে তাকে বিয়ে করেছিল। এই ব্রাইডাল মার্কেট প্রসঙ্গে অধ্যাপক অ্যালেক্সি বলেন, প্রাচীন এই প্রথায় সেখানকার কোনো নারীই প্রকৃত সুখী নয়।
অর্থের বিনিময়ে ঘটা এই বিয়ের ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারা স্বামীর পরিবারে গিয়ে অত্যাচার ও বিবাহ বিচ্ছেদের সম্মুখীণ হয়। যদি বর্তমান প্রজন্মের নারীরা এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানায় তবে নিষ্ঠুর এই প্রথা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাবে।