ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শীতলপাটির গ্রাম

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে কনের সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে একটি শীতলপাটি দেওয়ার দৃশ্য এখনও অহরহ চোখে পড়ে। কালের বিবর্তনে শীতলপাটি বোনার পেশা এখন বিলুপ্তির পথে। তবে ফেনীর পরশুরামের পৌর এলাকার অনন্তপুর গ্রামে প্রতিটি পরিবারই পাটি বানানোর পেশায় নিয়োজিত। তাই এটি ‘শীতলপাটির গ্রাম’ বলে পরিচিত। গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে একই দৃশ্য চোখে পড়ে। স্কুলপড়ুয়া কিশোরী থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধা সবাই পাটি বানানোর কাজে ব্যস্ত। পাটি বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে অনেক পরিবারের সংসার ও ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ।      অনন্তপুর গ্রামের প্রায় সবাই সনাতন ধর্মাবলম্বী। লোকজনের একমাত্র পেশা পাটি বানানো হওয়াতে এই গ্রামের কেউ বিয়ে করতে গেলে পাটি বানানোর অভিজ্ঞতাকে পাত্রীর প্রধান যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই চট্টগ্রামের মিরসরাই, করেরহাট, ফেনী, সোনাগাজীতে পাটি বানাতে পারে এমন পাত্রীর সঙ্গে এই গ্রামের যুবকদের বিবাহের সম্পর্কের ঘটনা অহরহ ঘটছে। অনন্তপুরের পাটি দিয়ে পরশুরাম উপজেলার ও ফেনীর চাহিদা পূরণ করা হয়। তাছাড়া বাইরের ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের জন্য এই গ্রাম থেকে কিনে নিয়ে যায়। শীতল পাটি ছাড়া এখানে সাধারণ পাটিও বানানো হয়। শীতল পাটি শরীরকে ঠাণ্ডা করে। এই পাটিতে ঘুমালে আরামদায়ক ঘুম হয়। শীতল পাটি তৈরির কাজটা অনেক কঠিন এবং পরিশ্রমের। প্রথমে পুরুষরা বাজার থেকে পাটি পাতা কিনে আনেন। স্থানীয়ভাবে এর নাম মোর্তাক গাছ। প্রতিটি মোর্তাককে তিনবার চিরতে হয়। প্রথম অংশ ‘নেল’ দিয়ে পাটি বানানো হয়। নেলগুলো ছিকন ছিকন করে চিরে বেত বানিয়ে গরম পানিতে সিদ্ধ করতে হয়। তারপর ওই বেতে কখনও রঙ লাগিয়ে কখনওবা রং ছাড়া পাটি বানানো হয়। একটি ৪-৫ হাতের পাটি বানাতে একজন শিল্পীর ৬-৭ দিন সময় লাগে। অনন্তপুর গ্রামের সরেস চন্দ্রনাথ ও বাবুল চন্দ্রনাথ জানান, তাদের মা-বাবা, দাদা-দাদিরাও পাটি বানাতেন। তখনই তারা এটা শিখেছেন। এটা তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা। অনন্তপুর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সবাই হাতের মাপে পাটি বানায়। ৪-৫ হাতের একটি সাধারণ পাটি ৫-৬শ’ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। একই মাপের একটি শীতল পাটি ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। সাড়ে তিন হাত থেকে সাড়ে চার হাতের একটি পাটি ৪শ’-৫শ’ টাকা আর একই মাপের শীতল পাটির দাম প্রায় ৭শ’-৮শ’ টাকা। পরশুরাম পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবু তাহের জানান, অনন্তপুর গ্রামের প্রায় সব পরিবারই পাটি বানানোর সঙ্গে জড়িত। তাদের অধিকাংশই শুধু পাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামীণ ব্যাংক ও বেসরকারি সংস্থা রিক থেকে ঋণ নিয়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবার। পরশুরাম উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার জানান, অনন্তপুর গ্রামের লোকেরা তাদের বাপ-দাদার আমল থেকে পাটি বানানোর পেশায় জড়িত। দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন লোকজন ও ব্যবসায়ীরা শীতল পাটি কিনতে অনন্তপুর চলে যায়।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

শীতলপাটির গ্রাম

আপডেট টাইম : ০৫:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মে ২০১৭

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে কনের সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে একটি শীতলপাটি দেওয়ার দৃশ্য এখনও অহরহ চোখে পড়ে। কালের বিবর্তনে শীতলপাটি বোনার পেশা এখন বিলুপ্তির পথে। তবে ফেনীর পরশুরামের পৌর এলাকার অনন্তপুর গ্রামে প্রতিটি পরিবারই পাটি বানানোর পেশায় নিয়োজিত। তাই এটি ‘শীতলপাটির গ্রাম’ বলে পরিচিত। গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে একই দৃশ্য চোখে পড়ে। স্কুলপড়ুয়া কিশোরী থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধা সবাই পাটি বানানোর কাজে ব্যস্ত। পাটি বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে অনেক পরিবারের সংসার ও ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ।      অনন্তপুর গ্রামের প্রায় সবাই সনাতন ধর্মাবলম্বী। লোকজনের একমাত্র পেশা পাটি বানানো হওয়াতে এই গ্রামের কেউ বিয়ে করতে গেলে পাটি বানানোর অভিজ্ঞতাকে পাত্রীর প্রধান যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই চট্টগ্রামের মিরসরাই, করেরহাট, ফেনী, সোনাগাজীতে পাটি বানাতে পারে এমন পাত্রীর সঙ্গে এই গ্রামের যুবকদের বিবাহের সম্পর্কের ঘটনা অহরহ ঘটছে। অনন্তপুরের পাটি দিয়ে পরশুরাম উপজেলার ও ফেনীর চাহিদা পূরণ করা হয়। তাছাড়া বাইরের ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের জন্য এই গ্রাম থেকে কিনে নিয়ে যায়। শীতল পাটি ছাড়া এখানে সাধারণ পাটিও বানানো হয়। শীতল পাটি শরীরকে ঠাণ্ডা করে। এই পাটিতে ঘুমালে আরামদায়ক ঘুম হয়। শীতল পাটি তৈরির কাজটা অনেক কঠিন এবং পরিশ্রমের। প্রথমে পুরুষরা বাজার থেকে পাটি পাতা কিনে আনেন। স্থানীয়ভাবে এর নাম মোর্তাক গাছ। প্রতিটি মোর্তাককে তিনবার চিরতে হয়। প্রথম অংশ ‘নেল’ দিয়ে পাটি বানানো হয়। নেলগুলো ছিকন ছিকন করে চিরে বেত বানিয়ে গরম পানিতে সিদ্ধ করতে হয়। তারপর ওই বেতে কখনও রঙ লাগিয়ে কখনওবা রং ছাড়া পাটি বানানো হয়। একটি ৪-৫ হাতের পাটি বানাতে একজন শিল্পীর ৬-৭ দিন সময় লাগে। অনন্তপুর গ্রামের সরেস চন্দ্রনাথ ও বাবুল চন্দ্রনাথ জানান, তাদের মা-বাবা, দাদা-দাদিরাও পাটি বানাতেন। তখনই তারা এটা শিখেছেন। এটা তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা। অনন্তপুর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সবাই হাতের মাপে পাটি বানায়। ৪-৫ হাতের একটি সাধারণ পাটি ৫-৬শ’ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। একই মাপের একটি শীতল পাটি ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। সাড়ে তিন হাত থেকে সাড়ে চার হাতের একটি পাটি ৪শ’-৫শ’ টাকা আর একই মাপের শীতল পাটির দাম প্রায় ৭শ’-৮শ’ টাকা। পরশুরাম পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবু তাহের জানান, অনন্তপুর গ্রামের প্রায় সব পরিবারই পাটি বানানোর সঙ্গে জড়িত। তাদের অধিকাংশই শুধু পাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামীণ ব্যাংক ও বেসরকারি সংস্থা রিক থেকে ঋণ নিয়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবার। পরশুরাম উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার জানান, অনন্তপুর গ্রামের লোকেরা তাদের বাপ-দাদার আমল থেকে পাটি বানানোর পেশায় জড়িত। দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন লোকজন ও ব্যবসায়ীরা শীতল পাটি কিনতে অনন্তপুর চলে যায়।