পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) ক্ষমতাধর দুই কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আমিনুল ইসলাম ও যুগ্ম পরিচালক মনারুল ইসলাম। এই দায়িত্বসহ প্রতিষ্ঠানের সাতটি পদে আছেন এই দুই কর্মকর্তা। কেবল তাই নয়, গত ছয় বছরে পাঁচটি পদোন্নতি হয়েছে একজনের।
প্রতিষ্ঠানের একাধিক পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগে পিডিবিএফের ওই দুই কর্মকর্তা অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিচ্যুত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহবুবুর রহমান এর পেছনে ছিলেন বলে পিডিবিএফ সূত্রে জানা গেছে।
পিডিবিএফের কর্মকর্তারা জানান, লাগামহীন দুর্নীতি করতেই মাহবুব প্রতিষ্ঠানের বিধি উপেক্ষা করে তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই কর্মকর্তা আমিনুল ও মনারুল ইসলামকে অল্প সময়ের মধ্যেই পদোন্নতি এবং একাধিক পদে থাকার সুযোগ করে দেন।
পিডিবিএফ সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতির কারণে গত ডিসেম্বরে চাকরিচ্যুত হন এমডি মাহবুব। দুর্নীতির একই ধারা ধরে রেখেছেন তাঁর দুই শিষ্য আমিনুল ও মনারুল। মাহবুব থাকার সময় থেকে এ পর্যন্ত গত ছয় বছরে ঋণ ও প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎসহ নানাভাবে অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। দুর্নীতির অভিযোগে মামলাসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে তাঁরা বরখাস্তও হয়েছিলেন। পিডিবিএফের ওই দুই কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগও করা হয়েছে। অভিযোগটি যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। গতকাল রবিবার আমিনুল ও মনারুলসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে দুদক।
দুজনের দখলে সাত পদ : ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের পদটি ছাড়াও আমিনুল ইসলাম চারটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর একটি হাজামাজা বা পতিত পুকুর পুনঃখননের মাধ্যমে সংগঠিত জনগোষ্ঠীর পাট পচানো-পরবর্তী মাছ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প। ৫৯ কোটি ৭১ লাখ ২১ হাজার টাকার এই প্রকল্পের কাজ চলমান। প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের শস্য সংগ্রহ-পরবর্তী সহযোগিতার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ, এই প্রকল্পের ব্যয় ৬১ কোটি টাকা। এ ছাড়া তিনি কাজ করেছেন ১৯ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকা ব্যয়ের জলবায়ু দুর্গত এলাকায় সৌরশক্তি উন্নয়ন কর্মসূচি, ২৪ কোটি ৯৫ লাখ দুই হাজার টাকা ব্যয়ের ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে সোলার সিস্টেম স্থাপন কর্মসূচি এবং আট কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনে সৌরচালিত সড়ক বাতি স্থাপন কর্মসূচিতে।
আর মনারুল ইসলাম যুগ্ম পরিচালক (নীতি ও পরিকল্পনা), যুগ্ম পরিচালক (মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) এবং পিডিবিএফ সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আইসিটি প্রকল্প নামে আরেকটি প্রকল্পের দায়িত্ব পালন করলেও গত ৩১ মার্চ এর মেয়াদ শেষ হয়েছে। এমনকি ওপরের চাপে যুগ্ম পরিচালক (মানবসম্পদ বিভাগ) পদটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন মনারুল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন অনুযায়ী এক ব্যক্তি একাধিক পদে থাকার কোনো সুযোগ নেই। যদি এমনটি করে থাকে সেটা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। সরকারের উচিত তদন্ত সাপেক্ষে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হন আমিনুল : কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯০ সালে পিডিবিএফে যোগ দেন আমিনুল ইসলাম। দিনাজপুরে আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপক থাকাকালে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৪ সালের ২৮ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়। তদন্তে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরে তাঁর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) তিন বছর বন্ধ ছিল। সেই আমিনুল গত ছয় বছরে পাঁচটি পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, আইনবহির্ভূতভাবে তিনি একাই প্রতিষ্ঠানের তিনটি পদ আঁকড়ে রেখেছেন।
ছয় বছরে পাঁচ পদোন্নতি আমিনুলের : আমিনুল ইসলাম ২০০৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক (সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর) থেকে পদোন্নতি পেয়ে মাঠ পরিচালনা বিভাগের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব নেন। দুই বছর তিন মাস ১৬ দিন পর ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) থেকে পদোন্নতি পেয়ে উপপরিচালক হন। এর এক বছর ছয় মাস ৯ দিন পর ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই উপপরিচালক থেকে পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান যুগ্ম পরিচালক। যুগ্ম পরিচালক হিসেবে এক বছর আট মাস সাত দিন কাজ করার পর ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ তিনি পদোন্নতি পেয়ে হন অতিরিক্ত পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত)। সেই পদে ৯ মাস ৫ দিন কাজ করার পর ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর পদোন্নতি পেয়ে হন অতিরিক্ত পরিচালক। এর সাত মাস ২৪ দিনের মাথায় ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট অতিরিক্ত পরিচালক থেকে পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে পদোন্নতি পান আমিনুল ইসলাম।
অথচ পিডিবিএফের নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে—কোনো পদে বা গ্রেডে ন্যূনতম তিন বছর পূর্ণ না হলে প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী পরবর্তী পদোন্নতির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। পিডিবিএফের এই বিধানকে উপেক্ষা করে অন্যায়ভাবে আমিনুল ইসলাম পর পর পদোন্নতি পেয়ে এখন প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা।
মনারুলের পদোন্নতি : আর মনারুল ইসলামও একইভাবে পদোন্নতি পেয়ে প্রতিষ্ঠানের বড় পদে এসেছেন। ২০০৯ সালে জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক (সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর) থেকে চার পদ ডিঙ্গিয়ে সরাসরি ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর উপপরিচালকের দায়িত্ব পান। সেই পদ থেকে আবার হন যুগ্ম পরিচালক। মনারুলের সঙ্গে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছিলেন তাঁরা এখনো উপজেলা পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
পিডিবিএফে হামলা : পিডিবিএফের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমিনুল আর মনারুল সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিষ্ঠানটি পুরো জিম্মি হয়ে আছে। দুর্নীতির অভিযোগে দুদক অনুসন্ধান করছে। ’ ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা জানান, ওই দুই কর্মকর্তার ইন্ধনে গতকাল সকালে পিডিবিএফের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করা হয়েছে। তাদের হামলায় ১০ জন আহত হয়েছে। গুরুতর আহত পাঁচজনকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মদন মোহন সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেখুন দুই কর্মকর্তার পদোন্নতি যা হয়েছে সেটা আমার সময় হয়নি। তিন মাস হচ্ছে আমি এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। ’ একই কর্মকর্তা একাধিক দায়িত্বে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চলতি মাসেই একজনকে মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ’ শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দুদকের কাজ দুদক করছে। ’
অভিযুক্তদের বক্তব্য : ড. মনারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেখুন, দুদক আমাদের ডেকেছে সাবেক এমডির কিছু অনিয়মের অভিযোগে। সেই সময় আমি একটি প্রকল্পের পরিচালক ছিলাম। দুদক আমাদের যা যা জানতে চেয়েছে সেসব উত্তর দিয়েছি। ’ একাধিক পদে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এখন যুগ্ম পরিচালক (নীতি ও উন্নয়ন) এবং একটি প্রকল্পের পরিচালক পদে আছি। আর বাকি দুটি পদে এখন নেই। ’ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ যাঁরা করছেন তাঁরা তাঁর সুনাম নষ্ট করতেই এমন অভিযোগ করছেন বলে তিনি দাবি করেন।
তবে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে গতকাল রাতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি লাইন কেটে দেন। কালের কণ্ঠের ল্যান্ডফোন থেকে যোগাযোগ করা হলেও তিনি লাইন কেটে দিয়েছেন। মোবাইল ফোনে এসএমএস দেওয়া হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি বা ফিরতি এসএমএসে তাঁর বক্তব্য জানাননি।