পীর হাবিবুর রহমান:
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি হওয়ায় পাকিস্তান ও তুরস্ক সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করে রীতিমত ঔদ্বত্ত্যপূর্ণ আচরণ করছে। এই আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক শালীনতার মধ্যেই এই আচরণের কড়া জবাব দিতে ভুল করছে না। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রই নয় বাংলাদেশ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামানের ডাকে ৩০ লাখ মানুষ ও আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এই স্বাধীনতা এসেছে। তার আগে শোষণ-বঞ্চনা ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের পূর্বসুরিদের ইতিহাস রক্তে লেখা।
৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। অবাধ লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ আর গণধর্ষণ চালিয়েছে। জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব মানবতার সামনে পরাজিত পাকিস্তানের সঙ্গেই নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কে কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের সেতু রচনা করে সভ্যতার নজির স্থাপন করেছিলেন। যে পাকিস্তান জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য, যে পাকিস্তান তালেবানি সন্ত্রাসবাদের অভয়াশ্রম, যে পাকিস্তান জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদে ক্ষত-বিক্ষত এক ব্যর্থ রাষ্ট্র! তাদের চলমান সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশ কখনো জাতিসংঘ থেকে ওআইসি কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রশ্ন তোলেনি! তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলায়নি। সেখানে ৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের বর্বরতার সহযোগীদের বিচারের রায় দেওয়া মাত্রই যেন আত্মা বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
একেকজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয় আর পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের পার্লামেন্ট পর্যন্ত নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় তোলে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তারীণ বিষয়ে নির্লজ্জের মতো হস্তক্ষেপ করছে। মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে বলেছিল, ‘নিজামীর অপরাধ, নিজামী পাকিস্তানের সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করেননি।‘ জবাবে আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম পাল্টা বিবৃতিতে যথার্থই বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের ভূমিকা হতাশাজনক। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কাউকে স্বাগত জানাইনা।’
তিনি যথার্থই বলেছেন, ৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আর মার্চ মাসের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোশর হিসেবে আল-বদর বাহীনি গঠন করে মতিউর রহমান নিজামীরা মানবাতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত হন। এরপরপরই পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ার নিন্দা করে বলা হয়েছে, এই প্রক্রিয়া আইন, বিচার ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। তারা বলেন, নিজামীর ফাঁসি কার্যকর ৭৪ সালের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্য সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তির লঙ্ঘন ‘ তারা নিজামীর ফাঁসির প্রতিবাদে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেন, ফাঁসি কার্যকর করাটা একটা বিচারিক অধিকারকে হত্যা এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ঠিকই বলেছেন, ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের বিচার করা হবে না। সেখানে কিন্তু বলা হয়নি, যেসব যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশের নাগরিক তাদের বিচার করা হবে না।’ তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘আমি মনে করি মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আশ্বস্ত করার জায়গা খুঁজছে পাকিস্তান। এটা অনেক বেশি বিপদজনক। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে পাকিস্তানকে রিবত থাকার অনুরোধ জানান তিনি।’
ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করলেও সতর্ক হয়নি পাকিস্তান। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাবের পর ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার নাজমুল হুদাকে ডেকে নিয়ে পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় তাদের লিখিত প্রতিবাদ জানায় ও সতর্ক করে দেয়। ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকেও ঢেকে নিয়ে তাদের ভূমিকার প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানের হাইকমিশানার বলেছেন, এটি দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বারে বারে একেকটি ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তানের ঔদ্বত্ত্য ও প্রতিক্রিয়া জানানোর নমুনা সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে লঙ্ঘনই করেনি, সীমারেখা অতিক্রম করেছে।
৭১-এ পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, যে ধ্বংসজজ্ঞ করেছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসে সকল বর্বরতাকে হারই মানায়নি তাদের নাম কালো হরফে চিহ্নিত করেছে। ৭১-এর পরাজয়ের লজ্জা ও গ্লানি তারা যে ভুলতে পারেনি, তাদের এদেশীয় দোশরদের বিচারে পাকিস্তানের আত্মা যে ক্রন্ধন করছে সেটিই প্রমাণ করছে।
পাকিস্তান এখনো ৭১-এর অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি। পাকিস্তান এখনো আমাদের পাওনা পরিশোধ করেনি। একটি অসভ্য, অগণতান্ত্রিক জঙ্গিবাদি রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদের ইমেজকে বার বার তুলে ধরছে দুনিয়ার সামনে। পাকিস্তান যখন মানবাধিকার ও আইনের কথা বলে তখন ৭১-এর লাখো লাখো শহীদের আত্মা ক্রন্দন করে। সম্ভ্রম হারা মা-বোনের আর্তনাদ বাতাসে ভেসে ওঠে। পাকিস্তান কোনো সভ্য জাতি হলে আয়নায় তাকাতো। দেখতে পেত ৭১-এ কত নিরপারাধ, নিরস্ত্র নারী-শিশু ও মানুষকে হত্যা করেছে। আর এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে পাকিস্তানের স্বসস্ত্র সামরিক শক্তি, আর তাদের এদেশীয় দোসররা। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে পার্লামেন্ট জুড়ে আজকে নির্লজ্জ প্রতিবাদ ও আহাজারিতে দৃশ্যমান হয়, ৭১-এর বর্বরতার জন্য তারা যেমন অনুতপ্ত নয়, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের একটি শক্তি এখনো রয়ে গেছে। ৭১-এর বর্বরতা পাকিস্তান ভুলে যেতে চাইলেও বাংলাদেশের জনগণ ও মানবসভ্যতার ইতিহাস তা ভুলতে দেবে না।
মিশরের ইসলামি বিপ্লবের পথ হাঁটা হাসানুল বান্নাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জামাল আব্দুল নাসের ধর্মান্ধ শক্তিকে দমন করেছিলেন। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে উগ্রপন্থিদের দমন করেছিলেন তারও আগে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, নিজামীকে ফাঁসি দেয়ার প্রতিবাদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ঢাকায় নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলেছে, তাকে প্রত্যাহার করা হয়নি। একটি সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, নিজামীর ফাঁসি পরবর্তী পরিস্থিতি জানতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছেন। এর আগে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ও নিজামীর ফাঁসির নিন্দা জানিয়েছে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতা যে সব রাষ্ট্র করেছিল, বিচারের মান নিয়ে শুরু থেকে যারা প্রশ্ন তুলেছিল তাদের অন্যতম পাকিস্তান ও তুরস্ক। যে সব পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে সব হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জানিয়ে ফোন করেন, ছুটে আসেন, তারাই আবার এদেরকে স্নেহ ছায়া দেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নিজামীর ফাঁসির নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না নিজামী কোনো অপরাধ করতে পারেন। নিজামীকে তিনি একজন মুজাহিদ হিসেবে সম্বোধন করে তার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। এর আগে গোলাম আজমকে ফাঁসি না দিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছিলেন।
অনেক বিশ্ব মোড়লদের, অনেক মুসলিম উম্মাহর, অনেক সমাজতান্ত্রিক শক্তির বিরোধীতার মুখেও বাঙালী জাতি বীরত্বের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই স্বাধীনতা, এই স্বাধীন বাংলাদেশ কারো কাছেই মাথা নোয়াবার নয়। এখানে কে অপরাধ করেছেন আর কে করেননি যারা খুনিদের আশ্রয় দেন তাদের জানবার কথা নয়। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরে কি ঘটেছে বা ঘটছে তা দেখা এবং মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ নিজেই যথেষ্ট। এখানে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপের বিপরীতে অভিন্ন কণ্ঠ ও সত্ত্বা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। তুরস্কের উন্মানিসকতা ৭১-এর বর্বরতাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে। যা গ্রহণযোগ্য ও কাম্য নয়।