ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গণমাধ্যম: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃষ্টান্ত গড়ো

রফিকুল ইসলামঃ‘রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির’ অভিযোগে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মামলায় কারারুদ্ধ থেকে জামিন পাওয়া প্রথম আলো পত্রিকার সচিবালয় বিটের অনুসন্ধানী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে অভিবাদন জানাতেই হয় সওগাদ পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তবে, বিশেষ তাৎপর্যের রেশ ধরে।

স্মৃতিচারণটি কবি নির্মলেন্দু গুণের মুখ থেকে শোনা। সাংবাদিক-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন গ্রামের বাড়ির পথে পথ চলতে গিয়ে জনতার ভিড় দেখে কৌতূহল বশে থমকে দাঁড়ান এবং ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে এক লোককে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। লোকটা ছিল সিঁদেল চোর এবং শত শাস্তিতেও চুরি না ছাড়ায় ক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে মারা গেছে শুনে চোরের পদধূলি নেন তিনি। এতে গণধিক্কারের শিকার হলে তিনি শোধান — কর্মকে ঘৃণা করি বটে, কিন্তু তার নিষ্ঠাকে অভিবাদন না জানিয়ে পারিনা।

সে ক্ষেত্রে সাংবাদিক রোজিনাকে যুক্তির খাতিরে তথ্যচোর না ধরাই গেল। তবে পরিপ্রেক্ষিত তলিয়ে দেখলে এটা তার পেশাগত বিশ্বস্বীকৃত রীতিসম্মত পদ্ধতি এবং আইনি অধিকারের পর্যায়ভুক্তও বটে।

বিচারাধীন মামলা। বিজ্ঞ আদালতই ভালো জানেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ইতোমধ্যেই জাতির বিবেক হয়ে ওঠা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে এতটুকুনই আস্বস্ত করতে পারি — ”মিথ্যা যদি জিতেও যায় /বুনে যায় চারা, /সত্যটা হেরে গেলেও /একদিন দেবেই মাথাচাড়া।”

গেলো ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রের গোপন নথি চুরি ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৮ মে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করে তার বিরুদ্ধে। তথ্য অধিকার আইনের দেশে ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ নামীয় এসব কী প্রসব করল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করা সরকারের আমলাদের উর্বর মগজ থেকে! যা হালে টক অব দ্যা ওয়ার্ডে পরিণত হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হাওয়া ভবন থেকে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করা মানবতার মাতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার।

গণতন্ত্রে অবাধ তথ্যপ্রবাহ আইনের দ্বারা একটা অধিকার নিশ্চিত করে। মত প্রকাশের অধিকার সেই কারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার, যা ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস্’ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত। তাতে বিশ্বের স্বাক্ষরকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

শুধু তাই নয়, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে জনগণের তথ্য জানার অধিকারও নিশ্চিত করেছে ২০০৯ সালের ১ জুলাই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তথ্য অধিকার অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত করে। এ প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছিলেন — দেশের সরকারি, বেসরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান এখন তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য।’

একটা শিশু পঁচিশ-ছাব্বিশ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় ঋণ নিয়ে জন্মায়। জনগণ জানতে চায় সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার, দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য নীতি, পররাষ্ট্র নীতি, রাজনীতিসহ সম্যক বিষয়ে কী হচ্ছে বা ঘটছে এবং জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকা কোথায় যায়, ব্যয় হয় কীভাবে। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার অধিকার। এই জানতে পারার ওপরই নির্ভর করে জনগণের মত বা প্রতিক্রিয়া জানার অধিকারটি। পেশার দায়িত্বশীলতায় সাংবাদিকেরা ভার নিয়েছে তথ্যের জগতকে জনগণের হাতের মুঠোয় তুলে ধরার।

অর্পিত দায়িত্বের জায়গা থেকেই সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগ্রহের শিকার হতে হয়।

একাধিক ভিডিও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রোজিনা কয়েকজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি ও পুলিশ দ্বারা একটি কক্ষে অবরুদ্ধ ও জিম্মি। তার বুকে হাঁটু গেড়ে হাতে গলার শ্বাসনালী চেপে ধরা হয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন খানে তল্লাশি ও আঘাত করা হচ্ছে। জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিচ্ছেন মোবাইল ও ভ্যানেটি ব্যাগসহ অন্যসব। বারবার কাকুতি-মিনতি করতে শোনা গেছে সচিবের সাথে দেখা করতে এবং ছেড়ে দিতে। অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে আক্রমণকারিদের সক্রিয় উপস্থিতিতে।

জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির পরিণতি গিয়ে গড়িয়েছে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে, যা দিয়ে তথ্য সংগ্রহকারীকে ১৪ বছরের জেল কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে। প্রকৃত কারণে কেউ দন্ডিত হলে প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। রোজিনা সত্যসত্যিই যদি অপরাধ করে থাকে, তবে তথ্য সংরক্ষণকারী ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে দলেবলে প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে আটকে রেখে ভীতসন্ত্রস্ত ও নিপীড়নে নিপাতের চেষ্টা করা কেন? এর আগে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম এই মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির কেলেঙ্কারির সাড়াজাগানিয়া অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় দেশ জেগে ওঠে।

সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংবাদ সম্মেলন বর্জন করায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গা বাঁচাবার চেষ্টা করতে গিয়েও সাংবাদিক রোজিনাকে ‘জনৈক’ বলে অচেনার ভান ধরেও বিস্তর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সচিবালয়ের মতো সংরক্ষিত এলাকায় কী করে ‘জনৈক’ ঢুকে? বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় অরক্ষিত থাকার দায়ভার তাহলে কার?

কর্তৃপক্ষের দাবি হলো জনৈক রোজিনা ইসলাম ‘গোপনীয়’ তথ্যের নথি চুরি করেছে, যাতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জড়িত। গোপনীয় তথ্য মানে কী? তথ্যটিকে আইনগতভাবে টপ সিক্রেট বা ক্লাসিফাইড ঘোষণা করা হয়ে থাকলে গোপনীয় তথ্যের নথি টেবিলে প্রকাশ্যে পড়ে  থাকে কী করে? অসঙ্গতি ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এমন  কী তথ্য থাকতে পারে, যা দেশের মালিক জনগণ জানতে এতই বাধা? দায়েরকৃত মামলার এজাহারেও না থাকার কারণইবা কী? সর্বোপরি পূর্ব অনুমতি ছাড়া এমনি প্রেক্ষাপটে এ মামলার করার এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

যে তথ্য গোপন করার চেষ্টা করা হয়, বুঝতে হবে তাতে গোমর রয়েছে। সেটা প্রকাশ করার মধ্যেই সাংবাদিকতার মুনশিয়ানা। সাংবাদিকের কাজই হচ্ছে স্কুপ খোঁজা। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সোর্সের মাধ্যমে তথ্য বের করে নেওয়া বিশ্বস্বীকৃত রীতিসম্মত কাজ। কেননা, অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো তথ্য অনুসৃত পথ অনুসরণ করে পাওয়ার নজির অন্তত বাংলাদেশে নেই। কোনো জঙ্গিকে রিমান্ডে নিয়ে ‘সোনা’ সম্বোধনে তথ্য বের করা যায় কিনা সংশ্লিষ্ট বিভাগই বলতে পারবে।

সাংবাদিকতার মানেই হচ্ছে জনগণের কল্যাণে অচেনাকে জানাবার, অচেনাকে চেনাবার, সুপ্তকে ব্যাপ্ত ও ব্যক্ত করা এবং যা সত্য, যা কঠিন, যা মানুষের জানা দরকার তা বস্তুনিষ্ঠ ও তীর্যকভাবে তুলে ধরা। এতে কোনটির সমাধান হয়, কোনটি চলে সমাধানের পথ ধরে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণমাধ্যমের বন্ধুর মুখোশ পরে বিএনপি সরকারবিরোধী উসকানি দিচ্ছে। বক্তব্যটি আস্থায় এনে বলতে চাই, সরকার মাথা কাটা থেকে বাঁচতে আঙুল কাটা দিক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতক দুর্নীতিগ্রস্ত ও অন্তর্ঘাতীদের ঠেকাক আর জনগণের তথ্য অধিকার মুক্তি পাক তথা তথ্যবাহক সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম পাক মামলা থেকে অ্যাহতি।

স্মৃতিচারণ দিয়ে শুরু করা লেখাটি ইতিহাস দিয়ে শেষ করছি। শায়েস্তা খানের পর বাংলার সুবাদার হয়েছিলেন সম্রাট-পুত্র শাহজাদা মুআজ্জম। সুবাদার হওয়ার পর শাহজাদা মুআজ্জম কর্মবিমুখ হবার পাশাপাশি অহঙ্কারী, বিলাসী ও অপব্যয়ী হয়ে পড়েন। ঢাকায় নিযুক্ত একজন ওয়াকিয়ানবিস (রিপোর্টার) সুবাদারের এসব দোষত্রুটি সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন আওরঙ্গজেবের কাছে। এতে সম্রাট ধন্যবাদ জানিয়ে রিপোর্টারকে একটি চিঠি পাঠান তার সাহসিকতা ও তথ্যনিষ্ঠার জন্য। একই সঙ্গে সংশোধিত হওয়ার জন্য সতর্ক করে আরেকটি চিঠি পাঠান শাহজাদাকে।

গণমাধ্যমবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ আইনও প্রণয়ন করেছেন, যে আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। ফৌজদারি দন্ডবিধির ৫০১ ও ৫০২ ধারা সাংবাদিকদের বেলায় চলবে না, সমনজারি হবে; জবাব দিবে আদালতে গিয়ে।

গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে প্রকাশ্য সংস্কৃতি উপহার দিয়ে জনগণকে শক্তিশালীতে পরিণত করা বঙ্গবন্ধুকন্যা মানবসত্তার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওরঙ্গজেবের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে দেশ ও দশের এমনকি বিশ্বদরবারেও আসীন হবেন আরও অনন্য উচ্চতায়।

উপহার স্বরূপ পাক, গড়ো ইতিহাস আর ধন্যবাদে হও ধন্য।  #

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

গণমাধ্যম: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃষ্টান্ত গড়ো

আপডেট টাইম : ১২:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ মে ২০২১

রফিকুল ইসলামঃ‘রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির’ অভিযোগে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মামলায় কারারুদ্ধ থেকে জামিন পাওয়া প্রথম আলো পত্রিকার সচিবালয় বিটের অনুসন্ধানী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে অভিবাদন জানাতেই হয় সওগাদ পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তবে, বিশেষ তাৎপর্যের রেশ ধরে।

স্মৃতিচারণটি কবি নির্মলেন্দু গুণের মুখ থেকে শোনা। সাংবাদিক-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন গ্রামের বাড়ির পথে পথ চলতে গিয়ে জনতার ভিড় দেখে কৌতূহল বশে থমকে দাঁড়ান এবং ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে এক লোককে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। লোকটা ছিল সিঁদেল চোর এবং শত শাস্তিতেও চুরি না ছাড়ায় ক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে মারা গেছে শুনে চোরের পদধূলি নেন তিনি। এতে গণধিক্কারের শিকার হলে তিনি শোধান — কর্মকে ঘৃণা করি বটে, কিন্তু তার নিষ্ঠাকে অভিবাদন না জানিয়ে পারিনা।

সে ক্ষেত্রে সাংবাদিক রোজিনাকে যুক্তির খাতিরে তথ্যচোর না ধরাই গেল। তবে পরিপ্রেক্ষিত তলিয়ে দেখলে এটা তার পেশাগত বিশ্বস্বীকৃত রীতিসম্মত পদ্ধতি এবং আইনি অধিকারের পর্যায়ভুক্তও বটে।

বিচারাধীন মামলা। বিজ্ঞ আদালতই ভালো জানেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ইতোমধ্যেই জাতির বিবেক হয়ে ওঠা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে এতটুকুনই আস্বস্ত করতে পারি — ”মিথ্যা যদি জিতেও যায় /বুনে যায় চারা, /সত্যটা হেরে গেলেও /একদিন দেবেই মাথাচাড়া।”

গেলো ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রের গোপন নথি চুরি ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৮ মে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করে তার বিরুদ্ধে। তথ্য অধিকার আইনের দেশে ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ নামীয় এসব কী প্রসব করল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করা সরকারের আমলাদের উর্বর মগজ থেকে! যা হালে টক অব দ্যা ওয়ার্ডে পরিণত হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হাওয়া ভবন থেকে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করা মানবতার মাতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার।

গণতন্ত্রে অবাধ তথ্যপ্রবাহ আইনের দ্বারা একটা অধিকার নিশ্চিত করে। মত প্রকাশের অধিকার সেই কারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার, যা ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস্’ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত। তাতে বিশ্বের স্বাক্ষরকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

শুধু তাই নয়, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে জনগণের তথ্য জানার অধিকারও নিশ্চিত করেছে ২০০৯ সালের ১ জুলাই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তথ্য অধিকার অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত করে। এ প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছিলেন — দেশের সরকারি, বেসরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান এখন তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য।’

একটা শিশু পঁচিশ-ছাব্বিশ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় ঋণ নিয়ে জন্মায়। জনগণ জানতে চায় সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার, দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য নীতি, পররাষ্ট্র নীতি, রাজনীতিসহ সম্যক বিষয়ে কী হচ্ছে বা ঘটছে এবং জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকা কোথায় যায়, ব্যয় হয় কীভাবে। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার অধিকার। এই জানতে পারার ওপরই নির্ভর করে জনগণের মত বা প্রতিক্রিয়া জানার অধিকারটি। পেশার দায়িত্বশীলতায় সাংবাদিকেরা ভার নিয়েছে তথ্যের জগতকে জনগণের হাতের মুঠোয় তুলে ধরার।

অর্পিত দায়িত্বের জায়গা থেকেই সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগ্রহের শিকার হতে হয়।

একাধিক ভিডিও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রোজিনা কয়েকজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি ও পুলিশ দ্বারা একটি কক্ষে অবরুদ্ধ ও জিম্মি। তার বুকে হাঁটু গেড়ে হাতে গলার শ্বাসনালী চেপে ধরা হয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন খানে তল্লাশি ও আঘাত করা হচ্ছে। জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিচ্ছেন মোবাইল ও ভ্যানেটি ব্যাগসহ অন্যসব। বারবার কাকুতি-মিনতি করতে শোনা গেছে সচিবের সাথে দেখা করতে এবং ছেড়ে দিতে। অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে আক্রমণকারিদের সক্রিয় উপস্থিতিতে।

জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির পরিণতি গিয়ে গড়িয়েছে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে, যা দিয়ে তথ্য সংগ্রহকারীকে ১৪ বছরের জেল কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে। প্রকৃত কারণে কেউ দন্ডিত হলে প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। রোজিনা সত্যসত্যিই যদি অপরাধ করে থাকে, তবে তথ্য সংরক্ষণকারী ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে দলেবলে প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে আটকে রেখে ভীতসন্ত্রস্ত ও নিপীড়নে নিপাতের চেষ্টা করা কেন? এর আগে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম এই মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির কেলেঙ্কারির সাড়াজাগানিয়া অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় দেশ জেগে ওঠে।

সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংবাদ সম্মেলন বর্জন করায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গা বাঁচাবার চেষ্টা করতে গিয়েও সাংবাদিক রোজিনাকে ‘জনৈক’ বলে অচেনার ভান ধরেও বিস্তর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সচিবালয়ের মতো সংরক্ষিত এলাকায় কী করে ‘জনৈক’ ঢুকে? বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় অরক্ষিত থাকার দায়ভার তাহলে কার?

কর্তৃপক্ষের দাবি হলো জনৈক রোজিনা ইসলাম ‘গোপনীয়’ তথ্যের নথি চুরি করেছে, যাতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জড়িত। গোপনীয় তথ্য মানে কী? তথ্যটিকে আইনগতভাবে টপ সিক্রেট বা ক্লাসিফাইড ঘোষণা করা হয়ে থাকলে গোপনীয় তথ্যের নথি টেবিলে প্রকাশ্যে পড়ে  থাকে কী করে? অসঙ্গতি ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এমন  কী তথ্য থাকতে পারে, যা দেশের মালিক জনগণ জানতে এতই বাধা? দায়েরকৃত মামলার এজাহারেও না থাকার কারণইবা কী? সর্বোপরি পূর্ব অনুমতি ছাড়া এমনি প্রেক্ষাপটে এ মামলার করার এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

যে তথ্য গোপন করার চেষ্টা করা হয়, বুঝতে হবে তাতে গোমর রয়েছে। সেটা প্রকাশ করার মধ্যেই সাংবাদিকতার মুনশিয়ানা। সাংবাদিকের কাজই হচ্ছে স্কুপ খোঁজা। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সোর্সের মাধ্যমে তথ্য বের করে নেওয়া বিশ্বস্বীকৃত রীতিসম্মত কাজ। কেননা, অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো তথ্য অনুসৃত পথ অনুসরণ করে পাওয়ার নজির অন্তত বাংলাদেশে নেই। কোনো জঙ্গিকে রিমান্ডে নিয়ে ‘সোনা’ সম্বোধনে তথ্য বের করা যায় কিনা সংশ্লিষ্ট বিভাগই বলতে পারবে।

সাংবাদিকতার মানেই হচ্ছে জনগণের কল্যাণে অচেনাকে জানাবার, অচেনাকে চেনাবার, সুপ্তকে ব্যাপ্ত ও ব্যক্ত করা এবং যা সত্য, যা কঠিন, যা মানুষের জানা দরকার তা বস্তুনিষ্ঠ ও তীর্যকভাবে তুলে ধরা। এতে কোনটির সমাধান হয়, কোনটি চলে সমাধানের পথ ধরে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণমাধ্যমের বন্ধুর মুখোশ পরে বিএনপি সরকারবিরোধী উসকানি দিচ্ছে। বক্তব্যটি আস্থায় এনে বলতে চাই, সরকার মাথা কাটা থেকে বাঁচতে আঙুল কাটা দিক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কতক দুর্নীতিগ্রস্ত ও অন্তর্ঘাতীদের ঠেকাক আর জনগণের তথ্য অধিকার মুক্তি পাক তথা তথ্যবাহক সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম পাক মামলা থেকে অ্যাহতি।

স্মৃতিচারণ দিয়ে শুরু করা লেখাটি ইতিহাস দিয়ে শেষ করছি। শায়েস্তা খানের পর বাংলার সুবাদার হয়েছিলেন সম্রাট-পুত্র শাহজাদা মুআজ্জম। সুবাদার হওয়ার পর শাহজাদা মুআজ্জম কর্মবিমুখ হবার পাশাপাশি অহঙ্কারী, বিলাসী ও অপব্যয়ী হয়ে পড়েন। ঢাকায় নিযুক্ত একজন ওয়াকিয়ানবিস (রিপোর্টার) সুবাদারের এসব দোষত্রুটি সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন আওরঙ্গজেবের কাছে। এতে সম্রাট ধন্যবাদ জানিয়ে রিপোর্টারকে একটি চিঠি পাঠান তার সাহসিকতা ও তথ্যনিষ্ঠার জন্য। একই সঙ্গে সংশোধিত হওয়ার জন্য সতর্ক করে আরেকটি চিঠি পাঠান শাহজাদাকে।

গণমাধ্যমবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ আইনও প্রণয়ন করেছেন, যে আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। ফৌজদারি দন্ডবিধির ৫০১ ও ৫০২ ধারা সাংবাদিকদের বেলায় চলবে না, সমনজারি হবে; জবাব দিবে আদালতে গিয়ে।

গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে প্রকাশ্য সংস্কৃতি উপহার দিয়ে জনগণকে শক্তিশালীতে পরিণত করা বঙ্গবন্ধুকন্যা মানবসত্তার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওরঙ্গজেবের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে দেশ ও দশের এমনকি বিশ্বদরবারেও আসীন হবেন আরও অনন্য উচ্চতায়।

উপহার স্বরূপ পাক, গড়ো ইতিহাস আর ধন্যবাদে হও ধন্য।  #

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।