ঢাকা , বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রতিযোগিতা নিশ্চিতে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত

যাত্রী পরিবহনে রেলের লোকসান নতুন নয়। এ থেকে উত্তরণে দাতা সংস্থা এডিবির ঋণের শর্ত হিসাবে ১৯৯৭ সাল থেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে কিছু লোকাল ও কমিউটার ট্রেন। এ ক্ষেত্রে একই প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে দরপত্র ডাকা হয়নি। এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও রয়েছে। বলা হচ্ছে, এতে করে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা হচ্ছে না, কতিপয় প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দি হয়ে পড়ছে রেল এবং হারাচ্ছে বাড়তি আয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতোমধ্যে ২৪টি ট্রেনের চুক্তি বাতিলপূর্বক নতুন করে দরপত্র আহ্বানের নির্দেশ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেও বলা হয়েছে।

বর্তমানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি ট্রেন সার্ভিস। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর আগে একই প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। রেলওয়ের অপারেশন বিভাগ মনে করছে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লোকসানের কারণে এডিবির পরামর্শে ট্রেন ইজারা দেওয়া হয়। প্রতিবার ১০ শতাংশ হারে চুক্তির দর বৃদ্ধিতে রেলের লাভ হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্রে অংশ নিয়ে লোকসানের কথা বলে নিজেরাই ইজারা প্রত্যাহার করেছে, এমন দৃষ্টান্ত আছে। আরেকটি পক্ষ মনে করছে, সমতা নিশ্চিত করতে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান জরুরি। একই প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ বারবার নবায়ন অনিয়মের পথকে প্রশস্ত করে।

এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী আমাদের সময়কে জানান, নতুন করে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে ট্রেন চলে ৩২৫টি। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন চলে ১১২টি। মেইল ও কমিউটার ট্রেন ১৩২টির মধ্যে ২৮টি বন্ধ। আর ৭৫টি লোকাল ট্রেনের মধ্যে ৩৫টি চলে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলওয়ের ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, পক্ষান্তরে আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। আয়ের তুলনায় ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা ব্যয় বেশি হয়েছে। এ ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, পেনশন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

প্রসঙ্গত, গত ৩ নভেম্বর চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে বেসরকারিভাবে পরিচালিত ২৪ ট্রেনের লিজ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। লিজ নেওয়া ইজারাদারদের বিষয়টি জানাতে রেলপথ মন্ত্রণালয় গত ৩ নভেম্বর রেলওয়ের মহাপরিচালককে চিঠি দেয়। চিঠিতে জানানো হয়, রেলওয়ের সঙ্গে তাদের চুক্তি এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর বাতিল হয়ে যাবে।

জানা গেছে, রেলওয়েতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে ২৭ বছর ধরে। ১৩টি চুক্তির আওতায় ৩৭টি ট্রেনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম বলতে কেবল টিকিট

বিক্রি ও ভাড়া আদায়কে বোঝায়। এ খাতে যুক্ত স্টাফরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। এ ছাড়া ট্রেন পরিচালন কাজ রেলই সারে। জ্বালানি খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ ও বাকি জনবল রেলের। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে- রেলের খরচে কেন বেসরকারি ট্রেন চলছে? এর জবাবে রেলওয়ের মহাপরিচালক জানান, কেবল বাণিজ্যিক সংক্রান্ত কাজ লিজে দেওয়া। বাকি কাজ রেল করবে এটিই স্বাভাবিক। সংস্থাটির জনবল কম। স্বল্পপথে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে ভাড়া আদায় কম হয়। বিনা ভাড়ায় যাতায়াত ঠেকাতেই এ পদক্ষেপ।

সূত্রমতে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব জনবল দিয়ে টিকিট প্রিন্ট, বিক্রয় ও চেকিং সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার কথা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানায় রেল। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে নতুন টেন্ডার ছাড়াই চুক্তির সময় বাড়িয়ে ট্রেন পরিচালনার বিপক্ষে একটা বড় অংশ রয়েছে। বিশেষ করে বরিশালের সালাহউদ্দিন রিপন, তার স্ত্রী মিসতাহুল জান্নাত লুনা এবং এ দম্পতির পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাপারে সম্প্রতি বেশ সমালোচনা হচ্ছে।

এ বিষয়ে কর্মকর্তারা জানান, সক্ষমতা তৈরি করে ফেলায় রিপনের প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া ব্যবসা করছে। অনেকে আবার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছে। সমস্যা তৈরি হয়েছে উন্মুক্ত দরপত্রের পরিবর্তে নবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে। একই ব্যক্তির পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ট্রেন সার্ভিস- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এমন মন্তব্য চলছে। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে একই প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও এতটা বিতর্ক হতো না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেলের দাবি- মেসার্স টিএম ট্রেডিং, এসআর ট্রেডিং, এনএল ট্রেডিং, নাজ কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে চলে এসব ট্রেন। ঢাকা ও দেওয়ানগঞ্জ রুটে কমিউটার ট্রেন চলে টিএম ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে। ২০১২ সাল থেকে ৪র্থ দফা বৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩ মার্চ। রেলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বছরে আয় ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত আয় ৫ কোটি ৬১ লাখ ১৫ হাজার ২৯ টাকা। আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪৪ শতাংশ। এসআর ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে কর্ণফুলি কমিউটার ট্রেন চলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। আগে এটির বছরে আয় ছিল ১ কোটি ৩৯ লাখ ১০ হাজার ৪০০ টাকা। বর্তমানে আয় ৪ কোটি ৮১ লাখ ১৯ হাজার ৯৪০ টাকা। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিলের ৪ দফা চুক্তিশেষে মেয়াদ আছে ২০২৬ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত। এসআর ট্রেডিংয়ের জামালপুর কমিউটারের আরেকটি ট্রেন চলে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটে। ২০১১ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে চার দফা এ রুটে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ১ কোটি ৯১ লাখ ২৫ হাজারের আয় দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬২ লাখ ৯৮ হাজার টাকায়। মহুয়া কমিউটার চলে টিএম ট্রেডিংয়ের নামে। রুট ঢাকা-মোহনগঞ্জ। ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ২০২৬ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত মেয়াদ হয়েছে ৪ দফায়। ৬৮ লাখ ৫৫ হাজার ছিল আগের আয়। এখন ২ কোটি ৯৬ লাখ ৭৭ হাজার ২২৭ টাকা। এভাবে প্রায় সব ট্রেনই রেলের বদলে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালালে আয় বাড়ে বলে জানায় সংস্থাটি। এনএল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বলাকা কমিউটার চলে ঢাকা-ময়মনসিংহ-ঢাকা-ঝারিয়াঝাঞ্জাইল রুটে। তাদের আরেকটি ট্রেন চলে চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রুটে। নাম সাগরিকা কমিউটার। টিএম ট্রেডিংয়ের তিতাস কমিউটার চলে ঢাকা-আখাউড়া রুটে। একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা-বিবাড়িয়া রুটে আরেকটি কমিউটার ট্রেন চলে। এ ছাড়া রাজশাহী কমিউটার এবং লোকাল হিসেবে ঢাকা-চাঁপাই-সি: বাজার-ঈশ^রদী রুটে চলে আরেকটি ট্রেন। টিএম ট্রেডিংয়ের আরও ট্রেন আছে। রকেট মেইল, ঘাগট মেইল নামে। চলে খুলনা-পার্বতীপুর-খুলনা ও পার্বতীপুর-চিলাহাটি-পার্বতীপুর রুটে। এনএল ট্রেডিংয়ের নামে চলে মহানন্দা এক্সপ্রেস, লোকাল ও নকশিকাঁথা এক্সপ্রেস। রুট খুলনা-গোয়ালন্দঘাট-খুলনা, রহনপুর-খুলনা ও খুলনা-ঢাকা-খুলনা। নাজ কনসোর্টিয়ামের আওতায় রাজবাড়ী-গোয়ালন্দঘাট-রাজবাড়ী, এনএল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বগুড়া এক্সপ্রেস এবং পদ্মরাগ কমিউটার চলে সান্তাহার-লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের চার দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। একই প্রতিষ্ঠানকে বিনা দরপত্রে দায়িত্ব দেওয়ায় রেলের কর্মচারীদের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টাফের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এটিও ঠিক, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। গাদাগাদি করে এমনকি ছাদেও যাত্রী তোলার অভিযোগ আসে। অবশ্য অনেক কর্মীর ভাষ্য-বেসরকারিভাবে পরিচালনার কারণে রেলওয়ের স্টাফরা নিজেরা যাত্রীদের ভাড়া পকেটে নিতে না পারার কারণে ক্ষুব্ধ। রেলওয়ের ব্যবস্থায় ট্রেন চালনাকালে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে ভাড়ার টাকা পকেটে রাখেন তারাও। জনবল সংকটের কারণে প্রতি কোচে টিকিট চেকার দেওয়ার সক্ষমতা নেই রেলের। তবে স্বচ্ছতার স্বার্থে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

প্রতিযোগিতা নিশ্চিতে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত

আপডেট টাইম : ০৫:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

যাত্রী পরিবহনে রেলের লোকসান নতুন নয়। এ থেকে উত্তরণে দাতা সংস্থা এডিবির ঋণের শর্ত হিসাবে ১৯৯৭ সাল থেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে কিছু লোকাল ও কমিউটার ট্রেন। এ ক্ষেত্রে একই প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে দরপত্র ডাকা হয়নি। এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও রয়েছে। বলা হচ্ছে, এতে করে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা হচ্ছে না, কতিপয় প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দি হয়ে পড়ছে রেল এবং হারাচ্ছে বাড়তি আয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতোমধ্যে ২৪টি ট্রেনের চুক্তি বাতিলপূর্বক নতুন করে দরপত্র আহ্বানের নির্দেশ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেও বলা হয়েছে।

বর্তমানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি ট্রেন সার্ভিস। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর আগে একই প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। রেলওয়ের অপারেশন বিভাগ মনে করছে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লোকসানের কারণে এডিবির পরামর্শে ট্রেন ইজারা দেওয়া হয়। প্রতিবার ১০ শতাংশ হারে চুক্তির দর বৃদ্ধিতে রেলের লাভ হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্রে অংশ নিয়ে লোকসানের কথা বলে নিজেরাই ইজারা প্রত্যাহার করেছে, এমন দৃষ্টান্ত আছে। আরেকটি পক্ষ মনে করছে, সমতা নিশ্চিত করতে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান জরুরি। একই প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ বারবার নবায়ন অনিয়মের পথকে প্রশস্ত করে।

এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী আমাদের সময়কে জানান, নতুন করে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে ট্রেন চলে ৩২৫টি। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন চলে ১১২টি। মেইল ও কমিউটার ট্রেন ১৩২টির মধ্যে ২৮টি বন্ধ। আর ৭৫টি লোকাল ট্রেনের মধ্যে ৩৫টি চলে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলওয়ের ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, পক্ষান্তরে আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। আয়ের তুলনায় ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা ব্যয় বেশি হয়েছে। এ ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, পেনশন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

প্রসঙ্গত, গত ৩ নভেম্বর চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে বেসরকারিভাবে পরিচালিত ২৪ ট্রেনের লিজ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। লিজ নেওয়া ইজারাদারদের বিষয়টি জানাতে রেলপথ মন্ত্রণালয় গত ৩ নভেম্বর রেলওয়ের মহাপরিচালককে চিঠি দেয়। চিঠিতে জানানো হয়, রেলওয়ের সঙ্গে তাদের চুক্তি এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর বাতিল হয়ে যাবে।

জানা গেছে, রেলওয়েতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে ২৭ বছর ধরে। ১৩টি চুক্তির আওতায় ৩৭টি ট্রেনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম বলতে কেবল টিকিট

বিক্রি ও ভাড়া আদায়কে বোঝায়। এ খাতে যুক্ত স্টাফরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। এ ছাড়া ট্রেন পরিচালন কাজ রেলই সারে। জ্বালানি খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ ও বাকি জনবল রেলের। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে- রেলের খরচে কেন বেসরকারি ট্রেন চলছে? এর জবাবে রেলওয়ের মহাপরিচালক জানান, কেবল বাণিজ্যিক সংক্রান্ত কাজ লিজে দেওয়া। বাকি কাজ রেল করবে এটিই স্বাভাবিক। সংস্থাটির জনবল কম। স্বল্পপথে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে ভাড়া আদায় কম হয়। বিনা ভাড়ায় যাতায়াত ঠেকাতেই এ পদক্ষেপ।

সূত্রমতে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব জনবল দিয়ে টিকিট প্রিন্ট, বিক্রয় ও চেকিং সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার কথা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানায় রেল। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে নতুন টেন্ডার ছাড়াই চুক্তির সময় বাড়িয়ে ট্রেন পরিচালনার বিপক্ষে একটা বড় অংশ রয়েছে। বিশেষ করে বরিশালের সালাহউদ্দিন রিপন, তার স্ত্রী মিসতাহুল জান্নাত লুনা এবং এ দম্পতির পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাপারে সম্প্রতি বেশ সমালোচনা হচ্ছে।

এ বিষয়ে কর্মকর্তারা জানান, সক্ষমতা তৈরি করে ফেলায় রিপনের প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া ব্যবসা করছে। অনেকে আবার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছে। সমস্যা তৈরি হয়েছে উন্মুক্ত দরপত্রের পরিবর্তে নবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে। একই ব্যক্তির পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ট্রেন সার্ভিস- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এমন মন্তব্য চলছে। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে একই প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও এতটা বিতর্ক হতো না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেলের দাবি- মেসার্স টিএম ট্রেডিং, এসআর ট্রেডিং, এনএল ট্রেডিং, নাজ কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে চলে এসব ট্রেন। ঢাকা ও দেওয়ানগঞ্জ রুটে কমিউটার ট্রেন চলে টিএম ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে। ২০১২ সাল থেকে ৪র্থ দফা বৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩ মার্চ। রেলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বছরে আয় ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত আয় ৫ কোটি ৬১ লাখ ১৫ হাজার ২৯ টাকা। আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪৪ শতাংশ। এসআর ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে কর্ণফুলি কমিউটার ট্রেন চলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। আগে এটির বছরে আয় ছিল ১ কোটি ৩৯ লাখ ১০ হাজার ৪০০ টাকা। বর্তমানে আয় ৪ কোটি ৮১ লাখ ১৯ হাজার ৯৪০ টাকা। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিলের ৪ দফা চুক্তিশেষে মেয়াদ আছে ২০২৬ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত। এসআর ট্রেডিংয়ের জামালপুর কমিউটারের আরেকটি ট্রেন চলে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটে। ২০১১ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে চার দফা এ রুটে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ১ কোটি ৯১ লাখ ২৫ হাজারের আয় দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬২ লাখ ৯৮ হাজার টাকায়। মহুয়া কমিউটার চলে টিএম ট্রেডিংয়ের নামে। রুট ঢাকা-মোহনগঞ্জ। ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ২০২৬ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত মেয়াদ হয়েছে ৪ দফায়। ৬৮ লাখ ৫৫ হাজার ছিল আগের আয়। এখন ২ কোটি ৯৬ লাখ ৭৭ হাজার ২২৭ টাকা। এভাবে প্রায় সব ট্রেনই রেলের বদলে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালালে আয় বাড়ে বলে জানায় সংস্থাটি। এনএল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বলাকা কমিউটার চলে ঢাকা-ময়মনসিংহ-ঢাকা-ঝারিয়াঝাঞ্জাইল রুটে। তাদের আরেকটি ট্রেন চলে চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রুটে। নাম সাগরিকা কমিউটার। টিএম ট্রেডিংয়ের তিতাস কমিউটার চলে ঢাকা-আখাউড়া রুটে। একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা-বিবাড়িয়া রুটে আরেকটি কমিউটার ট্রেন চলে। এ ছাড়া রাজশাহী কমিউটার এবং লোকাল হিসেবে ঢাকা-চাঁপাই-সি: বাজার-ঈশ^রদী রুটে চলে আরেকটি ট্রেন। টিএম ট্রেডিংয়ের আরও ট্রেন আছে। রকেট মেইল, ঘাগট মেইল নামে। চলে খুলনা-পার্বতীপুর-খুলনা ও পার্বতীপুর-চিলাহাটি-পার্বতীপুর রুটে। এনএল ট্রেডিংয়ের নামে চলে মহানন্দা এক্সপ্রেস, লোকাল ও নকশিকাঁথা এক্সপ্রেস। রুট খুলনা-গোয়ালন্দঘাট-খুলনা, রহনপুর-খুলনা ও খুলনা-ঢাকা-খুলনা। নাজ কনসোর্টিয়ামের আওতায় রাজবাড়ী-গোয়ালন্দঘাট-রাজবাড়ী, এনএল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বগুড়া এক্সপ্রেস এবং পদ্মরাগ কমিউটার চলে সান্তাহার-লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের চার দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। একই প্রতিষ্ঠানকে বিনা দরপত্রে দায়িত্ব দেওয়ায় রেলের কর্মচারীদের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টাফের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এটিও ঠিক, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। গাদাগাদি করে এমনকি ছাদেও যাত্রী তোলার অভিযোগ আসে। অবশ্য অনেক কর্মীর ভাষ্য-বেসরকারিভাবে পরিচালনার কারণে রেলওয়ের স্টাফরা নিজেরা যাত্রীদের ভাড়া পকেটে নিতে না পারার কারণে ক্ষুব্ধ। রেলওয়ের ব্যবস্থায় ট্রেন চালনাকালে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে ভাড়ার টাকা পকেটে রাখেন তারাও। জনবল সংকটের কারণে প্রতি কোচে টিকিট চেকার দেওয়ার সক্ষমতা নেই রেলের। তবে স্বচ্ছতার স্বার্থে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।