শীতের কোমল হিমেল হাওয়া যেমন শীতের আবেশ জাগাচ্ছে, তেমনি বাজারে থরে-থরে সাজানো শীতের সবজিও রসনাবিলাসীদের রসনাতৃপ্ত করার জন্য প্রস্তুত। শীত এলেই বাজারে চলে আসে তাজা ব্রোকলি। শীতকালে এখন অনেকেই নানা ধরনের তরকারি তৈরি করেন ব্রোকলি দিয়ে। সুপার পুষ্টিকর সবজি ব্রোকলি আমাদের দেশে নতুন সবজি। ক্রসিফেরী গোত্রের ব্রোকলি এখন সব সময় পাওয়া যায়। উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি জাত যেমন- প্রিমিয়াম ক্রস, গ্রীন কমেট, জুপিটার প্রভৃতি জাতের ব্রোকলি চাষ করা যায়। লালতীর সীডস লিমিটেড ‘লিডিয়া’ নামে ব্রোকলির একটি জাত বাজারজাত করছে, যা আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী। জাতটি দ্রুত বর্ধনশীল, মাঝারি আকৃতির, তাপ সহিষ্ণু ও রোগ প্রতিরোধী, দেখতে আকর্ষণীয় ও খেতে সুস্বাদু।
ব্রোকলির উৎপত্তি ইতালিতে। ব্রোকলিকে ইতালিয়ান ব্যোকলি বলা হয়। ইতালি ভাষায় বরোক্কো শব্দ থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। ব্রোকলি দেখতে ফুলকপির মতই, তবে রংটা সবুজ। এর বর্ণ সবুজ বলে অনেকেই এক সবুজ ফুল কপি বলে। চাইনিজ খাবারের ব্যবহৃত অন্যতম প্রধান উপকরণ এই সবজী।
চমৎকার এই সবজিটি এখন বাংলাদেশেই চাষ হচ্ছে এবং এটি দেশের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট গুলোর চাহিদা মিটিয়ে এটি এখন দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। কারণ কপি গোত্রের অন্যান্য সবজির চেয়ে ব্রোকলি অপেক্ষাকৃত বেশি পুষ্টি সমৃদ্ধ ও ক্যানসার প্রতিরোধক। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, সি এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে এবং এর গন্ধটাও আকর্ষণীয়। ব্রোকলি ফুলকপির মত অত বড় হয় না। নিয়মিত ব্রোকলি খেলে তারুণ্যতা বৃদ্ধি পায়।
ব্রোকলিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, নানান ধরনের ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান। সঙ্গে ক্যালোরির পরিমাণও খুবই কম। ফলে এটি নিয়মিত খেলে এর উপকারিতা শরীর ও স্বাস্থ্যকে সমৃদ্ধ করে। আপনি যদি ডায়াবিটিসে ভুগে থাকেন, তবে এটি প্রতিদিন ডায়েটে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ সবুজ শাকসবজি খেলে ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি হ্রাস পায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ব্রোকলির এত গুণ থাকার কারণে অনেক সমস্যা সমাধান হতে পারে। আসুন সেই সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের সবজি খান, তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পেতে ব্রোকলি আরও কার্যকর। সুতরাং, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই তাদের ডায়েটে ব্রকোলি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জার্নাল অফ ট্রান্সলেশনাল মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, আপনি যদি ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন তবে আপনার প্রচুর পরিমাণে ব্রকলি খাওয়া উচিত। সাহেগার্জেনস্কা একাডেমি, গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুইডেনের লন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এই সমীক্ষায় দেখা গেছে যে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে ব্রোকলির প্রভাব বেশ কার্যকর হতে পারে।
হার্ট ভালো রাখে
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে হার্ট বা হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে পারে ব্রোকলি। এরমধ্যে রয়েছে সেলেনিয়াম এবং গ্লুকোজনলেটস. এই দুই পদার্থ হার্টের শক্তি বাড়াতে পারে। এছাড়া এর মধ্যে রয়েছে ভালো পরিমাণে ফাইবার। এই ফাইবার কোলেস্টেরল শরীর থেকে বের করে দেয়। ফলে শরীর ভালো থাকে। তাই চিন্তার কোনও কারণ নেই।
কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমায়
ব্রকলিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। অন্য বহু সব্জির তুলনায় এর ফাইবারের পরিমাণ বেশি। ফাইবার পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমায়। তা ছাড়া ফাইবার ধীরে পাচিত হয়। তাই দীর্ঘ ক্ষণ পেতে থাকে। খিদেও কম পায়। ফলে যাঁরা ওজন কমাতে চাইছেন, তাঁরা নিয়মিত ব্রকলি খেতে পারেন।
ব্রকলিতে ভিটামিন সি
ব্রকলিতে ভিটামিনের মাত্রাও অনেকটাই বেশি। সবচেয়ে বেশি মাত্রায় থাকে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শীতকালে নিয়মিত ব্রকলির খেলে সর্দি-কাশির মতো সমস্যা কমতে পারে।
ব্রকলি রক্তে লোহিত কণিকার পরিমাণ বাড়ায়
যাদের দেহে আয়রনের ঘাটতি আছে, তাঁদের জন্যেও উপকারী হতে পারে ব্রকলি। রক্তাল্পতা দেখা দিলে শরীর দুর্বল লাগতে পারে, হতে পারে শ্বাসকষ্ট। ব্রকলি এই সমস্যাও কমিয়ে দিতে পারে। আয়রনে ভরপুর ব্রকলি রক্তে লোহিত কণিকার পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
লেবুর দ্বিগুণ ও আলুর সাত গুণ ভিটামিন সি ব্রোকলিতে। বলা হয়, যাদের ভিটামিন সি দরকার, তারা অল্প করে হলেও ব্রোকলি প্রতিদিন খেতে পারেন। সেলিনিয়াম দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এতে প্রচুর ভিটামিন এ থাকায় ত্বকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে বাধা দেয়। সর্দি-কাশিও ঠেকাতে পারে ব্রোকলি।
গ্যাসট্রাইটিস প্রতিরোধ
গ্যাসট্রিক আলসার ও গ্যাসট্রাইটিস প্রতিরোধে দারুণ কার্যকর ব্রোকলি। বাঁধাকপির চেয়ে এতে অনেক বেশি ভিটামিন ইউ (মেথিওনাইনের উপজাত) থাকে। এতে সালফরাফেন নামের উপাদান থাকে যা গ্যাসট্রিক অ্যালসার ও ক্যানসার প্রতিরোধ করে।
ক্যানসার প্রতিরোধ
ব্রোকলিতে ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান রয়েছেন। এটি ক্রুসিফেরাস জাতীয় সবজি। এই গ্রুপের সব সবজি পাকস্থলী ও অন্ত্রের ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। ব্রোকলির বিটা ক্যারোটিন ও সেলিনিয়াম যৌথ ও ভিটামিন সি প্রোস্টেট, কোলন, ফুসফুস, যকৃত, স্তন ও প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে।
কোলেস্টেরল কমাতে
শরীর থেকে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে ব্রোকলি। কারণ, এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা দ্রবণীয় অবস্থায় থাকে অর্থাৎ এই ফাইবার জলে দ্রাব্য। এই ধরনের ফাইবার শরীর থেকে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল বের করে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রকলি শরীর থেকে ৬% হারে খারাপ কোলেস্টেরল দূর করতে পারে।
বয়স ঠেকাতে
শরীরে সক্রিয় অক্সিজেন প্রতিরোধ করে ও বিষমুক্ত করে দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া ঠেকাতে সাহায্য করে ব্রোকলি।
ত্বক সুন্দর করে
ব্রোকলিতে থাকা ভিটামিন সি ত্বক সুন্দর করে। এ ছাড়া এতে ডায়াটারি আঁশ থাকায় কোষ্ঠকাঠিণ্য প্রতিরোধ করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে
ব্রোকলিতে চর্বি ও ক্যালরি কম কিন্তু আঁশ বেশি। তাই বেশি করে ব্রোকলি খেলে ক্ষতি নেই। বেশি লৌহ থাকায় ডায়েটের সময় ব্রোকলি থেকে ঝিম ধরা ভাব দূর হয়।
হাড়ের ক্ষমতা বাড়ায়
অনেক বিশেষজ্ঞই বিশ্বাস করেন যে হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারে ব্রোকলি। এমনকী দাঁতও ভালো রাখতে পারে। আসলে এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হাড়ের ক্ষয় রোধ করে দিতে পারে। ফলে এই লাভ মেলে।