ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

১৯ বছর ধরে আলো ছড়াচ্ছেন শিক্ষক নাসির উদ্দিন

গড়াই নদীর কূল ঘেঁষে সরু পাকা সড়ক। এরই পাশে দৃষ্টিনন্দন বাগান বাড়ি। সেখানে বড় একটি আমগাছের নিচে ত্রিপল বিছানো। তার ওপরে রঙ-তুলি ও কাগজ নিয়ে বসেছে শতাধিক শিশু। আপন মনে তারা আঁকছে গ্রামীণ জীবনের চিত্র। তাদের ঘিরে চেয়ার পেতে বসেছেন স্বজনেরা। বাগানের ভেতরে রয়েছে দোলনা, পাঠাগার, জাদুঘর, শরীরচর্চার সামগ্রী ও বিলুপ্তপ্রায় হরেক প্রজাতির গাছ। নানা বয়সী শিশুদের কেউ খেলা করছে, কেউ পড়ছে বই। আর বাগানের মালিক নাসির উদ্দিন চেয়ারে বসে থাকা স্বজনদের চিড়া-মুড়ি ও মুড়কি খেতে দিচ্ছেন।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের কয়া গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। এলাকার মানুষ তাকে নাসির স্যার বলে ডাকে। ৭৪ বছর বয়সেও তিনি শিশুমনা। সেজন্য সাদা মনের বা আলোকিত মানুষ হিসেবে তার চিন্তা-ভাবনা ও কাজের কথা এলাকার মানুষের মুখে মুখে। যেন অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছেন তিনি। বিলুপ্তপ্রায় গাছ, প্রাচীন নিদর্শন ও গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থাপনার নানা উপকরণ সংরক্ষণ এবং শিশুদের শৈশবটা যেন আনন্দ মুখর হয়, তারা যাতে আলোকিত ও প্রকৃতিপ্রেমী এবং মানুষের মত মানুষ হয় সেই লক্ষ্যে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন নাসির উদ্দিন। তবে এতদিনেও তেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারেননি তিনি। পাননি সরকারি কোনো বরাদ্দ। তবুও যেন অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছেন তিনি।

উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কয়া গ্রাম। যার একপাশে গড়াই এবং অপর পাশে পদ্মা নদী। এই গ্রামেই মামাবাড়িতে বিপ্লবী বাঘা যতীনের শৈশব কেটেছে। নাসির উদ্দিনের বাড়িটাও একই গ্রামে। ২০০৫ সালে পেনশনের টাকায় শিশুদের বিনোদন ও মেধা বিকাশের জন্য বাড়ির আঙিনায় বাবা-মায়ের নামে কুলসুম নেছা-জালাল গান্ধী শিশুপার্ক গড়ে তোলেন তিনি। সেখানেই প্রতি শুক্রবার এলেই শিশু নিকেতনে পরিণত হয় তার বাগান।

বিলুপ্তপ্রায় গাছ, প্রাচীন নিদর্শন ও গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থাপনার নানা উপকরণ সংরক্ষণ এবং শিশুদের শৈশবটা যেন আনন্দ মুখর হয়, তারা যাতে আলোকিত ও প্রকৃতিপ্রেমী এবং মানুষের মত মানুষ হয়। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন নাসির উদ্দিন। তবে এতদিনেও তেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারেননি তিনি। পাননি সরকারি কোনো বরাদ্দ। তবুও যেন অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছেন তিনি।

আলোকিত নাসির উদ্দিন: কুমারখালীর কয়া গ্রামে ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন নাসির উদ্দিন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নিজ গ্রামে শিক্ষার আলোর অভাব অনুভব করেন। ১৯৬৬ সালে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন কয়া নৈশ বিদ্যালয়। বিভিন্ন বয়সের অনেক নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন তাঁরা। দীর্ঘ ১০ বছর স্কুলটি পরিচালনা করেন। খেলাধুলার প্রতিও তার গভীর অনুরাগ। ১৯৭২ সালে তিনি নিজ গ্রামে ভলিবল দল গঠন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৭ সালে অবসরে যান। তার দুই ছেলে বেসরকারি চাকুরীজীবী। এক মেয়ে বিবাহিতা। স্ত্রী মরিয়ম বেগম গৃহিণী।

শুক্রবার আসলেই যেন শিশুরাজ্যে পরিণীত হয় বাগান। শিশুদের জন্য গড়তে চাই আত্মভোলা স্বর্গরাজ্য। মুখভরা হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন নাসির উদ্দিন। তিনি জানান, ৩৩ শতাংশ জমির ওপর বাগানসহ তার বসতভিটা। ২০০৫ সালে অবসরের টাকা দিয়ে বাগানের ভেতরে গড়ে তুলেছেন কুলসুম নেছা-জালাল গান্ধী শিশুপার্ক। সেখানে শিশুদের জন্য বিনোদন ও শরীর চর্চা কেন্দ্র, পাঠাগার, জাদুঘর, সংবাদ সংগ্রহশালা রয়েছে। আশপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী শিশুরা আসে। তারা বই পড়ে, খেলা করে, বিলুপ্তপ্রায় হরেক প্রজাতির গাছের সঙ্গে পরিচিত হয়। জাদুঘরে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র দেখে গ্রামীণ জীবন-যাপন অনুভব করে। তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের তার বাগানে আসতে বলেন। বই পড়তে উৎসাহিত করেন। পাঠাগার গড়ে তুলতে স্থানীয় শিক্ষিত মানুষকে উৎসাহ দেন তিনি।

গাছের প্রতি ভালোবাসা: প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি বিলুপ্তপ্রায় গাছ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিজ উদ্যোগে বাড়ির আঙিনায় গড়ে তোলেন বাগান। বাগানটিতে প্রায় ২০০ প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছে কাগজ লেমিনেটিং করে নাম লেখা আছে, যাতে শিশুরা পড়ে চিনতে পারে। উল্লেখযোগ্য হলো বনকাঁঠাল, লাটা, ঢেপড়, ফলশাহী, মিষ্টি আমলকী, করমচা, জামরুল, হরগৌড়ি ইত্যাদি।

নাসির উদ্দিন বলেন, “গ্রাম থেকে হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্তপ্রায় ফলজ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনের গাছগুলো সংরক্ষণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বাগানে বেশির ভাগই ঔষধি গাছ। সেগুলো সেবামূলক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার যখন খুশি ইচ্ছেমত নিয়ে যাচ্ছেন।”

কুলসুম নেছা পাঠাগার, জাদুঘর ও সংবাদ সংগ্রহশালা: বাগানের ঠিক মাঝখানে একটি ছোট্ট আধাপাকা ঘরে মায়ের নামে একটি পাঠাগার, জাদুঘর ও সংবাদ সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন নাসির উদ্দিন। পাঠাগারে শিশুদের মেধা বিকাশ, শরীর গঠন বিষয়কসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক বই রয়েছে। দেওয়ালে ‘পড়িলে বই আলোকিত হয়, না পড়িলে অন্ধকারে রয়’, ‘নিজে বই পড়ুন অন্যদের বই পড়তে উৎসাহ দিন’, ‘বেশি বেশি বই পড়ুন বেশি বেশি জানুন’ ইত্যাদি বাণী লেখা আছে। এই পাঠাগারের বই নিয়েই তিনি আশপাশের এলাকার বিভিন্ন স্কুলে যান।

জাদুঘরে সেন ও পাল বংশ এবং ব্রিটিশ আমলের ইট, থালা, তার নানী ও মায়ের ব্যবহৃত পানের বাটা, কাঁসার বদনা, বিলুপ্তপ্রায় হারিকেন, ঢেঁকি, পালকি, ডাক টিকেট, হুকা, লাঙল, মাতাল, ঢালসহ শতাধিক উপকরণাদি সংরক্ষণ করা রয়েছে। ওই ঘরের এক দিকে সংবাদ সংগ্রহশালা। সেখানে শিশুদের মেধা বিকাশ, স্বাস্থ্যবিধি ও নানা বয়সী শিশুদের লেখা এবং দেশ বিদেশের আবিষ্কারক বিষয়ক পত্রিকা ও পত্রিকার কাটিং রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে কথা হলে নাসির উদ্দিন জানান, তার নানী ও মায়ের ব্যবহৃত পানের বাটা, পান ছেঁচা ও চিনামাটির পুতুল থেকে তিনি জাদুঘর স্থাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিলুপ্তপ্রায় শতাধিক উপকরণ সংরক্ষণ করেছেন। এগুলো দেখে আজকের শিশুরা প্রাচীন ধারণা লাভ করতে পারে।

কয়া গ্রামের গৃহিণী প্রিয়াংকা দত্ত বলেন, “পয়লা বৈশাখ, নবান্ন উৎসবসহ নাসির উদ্দিন শিশু কিশোরদের নিয়ে শহীদ দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন করেন। গাছে ফল পাকলে শিশুদের নিয়ে উৎসব হয় বাগানে। আনন্দ করে ফল খায় শিশুরা। পাখিদের গাছে কিছু ফল রাখা হয়। শিশুদের মেধা বিকাশে তার উদ্যোগগুলো খুবই ভাল।”

বাগান জুড়ে বাণী: বাগানের ভেতরে প্রতিটি গাছের সঙ্গে টাঙানো মনীষীদের বাণী। ‘সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গড়ে তুলুন’, ‘সহজ পথে খ্যাতি বা সফলতা আসবে না, চাই বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা, ‘না বুঝে মুখস্থ করার অভ্যাস প্রতিভাকে ধ্বংস করে’, ‘গাইড বই কখনো মূল বইয়ের বিকল্প হতে পারে না’, ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করুন’ ‘মাদককে না বলুন, ‘গাছ লাগায় পরিবেশ বাঁচান’ ইত্যাদি। এগুলো শিশুদের পড়ানো হয়। শিশুদের এসব বাণীর মর্মকথা বুঝিয়ে বলেন তিনি।

কয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রাখী ঘোষ বলে, বিদ্যালয়ের ছুটির দিন সে বাগানে এসে নানা ধরনের বই পড়ে। দোলনায় খেলা করে। ছবি আঁকতে তার খুব ভালো লাগে। শুক্রবারের প্রতিযোগীতায় সে গ্রামের চিত্র এঁকেছে।

কয়া ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ইরিনা দত্ত বলে, নাসির স্যার বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও তার আচরণ শিশুদের মতো। যাদের গাছ, পাখি ও বই ভাল লাগে তারাই ছুটে আসে বাগানে। বাগানে অনেক কিছু শেখার আছে।

প্রাপ্তি-প্রয়োজন: ছোট্ট ঘরের দেওয়ালে পাঠাগার, জাদুঘর ও সংবাদপত্র সংগ্রহশালা লেখা থাকলেও নেই বসার চেয়ার টেবিল ও কক্ষ। তবুও পেনশনের টাকায় ১৯ বছর ধরে শিশুদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং বিলুপ্তপ্রায় গাছ, গ্রামীণ উপকরণ ও প্রাচীন নিদর্শন সংরক্ষণে আপন মনে কাজ করে চলেছেন নাসির উদ্দিন। গেল ১৯ বছরে মাত্র ৭০ হাজার টাকার সরকারি বরাদ্দ পেয়েছেন বলে জানান নাসির উদ্দিন। তিনি জানান, পেনশনের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে চান তিনি।

নাসির উদ্দিন আরো জানান, অসম্ভব হলেও পরিবারের সহযোগীতায় এতদূর আসতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কেউ আসলেই যেন আশ্চর্য হয়ে পড়েন, এমন একটি আত্মভোলা শিশুরাজ্য গড়ে তুলতে চান তিনি।

স্ত্রী মরিয়ম বেগম জানান, প্রথমদিকে না মানলেও স্বামীর খুশিতেই এখন তিনিও খুশি। সবসময় শিশুদের নিয়ে হেসে খেলে ভাল থাকেন স্বামী। তা দেখেই এখন সুখ পান তিনিও।

কুমারখালীর জিডি সামছুদ্দিন কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক কবি বিজয় কর বলেন, “শিল্প ও সাংস্কৃতিক মনা নাসির উদ্দিন  হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও গাছ সংরক্ষণে চেষ্টা করছেন। এগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।”

প্রায়ই বাগানে ছুটে আসেন সাংবাদিক এম এ ওহাব। তিনি বলেন, “নাসির উদ্দিন একজন সাদা মনের মানুষ। শিশুদের নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি কয়া গ্রামে মৃত পুরুষদের গোসল করাতে ছুটে যান তিনি।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, “দেশ ও জাতির কল্যাণে নাসির উদ্দিনের মতো আলোকিত মানুষের সংখ্যা আরো বেশি প্রয়োজন।”

এসময় তিনি আরো বলেন, “সরকারিভাবে বরাদ্দ পেলে প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

১৯ বছর ধরে আলো ছড়াচ্ছেন শিক্ষক নাসির উদ্দিন

আপডেট টাইম : ১২:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

গড়াই নদীর কূল ঘেঁষে সরু পাকা সড়ক। এরই পাশে দৃষ্টিনন্দন বাগান বাড়ি। সেখানে বড় একটি আমগাছের নিচে ত্রিপল বিছানো। তার ওপরে রঙ-তুলি ও কাগজ নিয়ে বসেছে শতাধিক শিশু। আপন মনে তারা আঁকছে গ্রামীণ জীবনের চিত্র। তাদের ঘিরে চেয়ার পেতে বসেছেন স্বজনেরা। বাগানের ভেতরে রয়েছে দোলনা, পাঠাগার, জাদুঘর, শরীরচর্চার সামগ্রী ও বিলুপ্তপ্রায় হরেক প্রজাতির গাছ। নানা বয়সী শিশুদের কেউ খেলা করছে, কেউ পড়ছে বই। আর বাগানের মালিক নাসির উদ্দিন চেয়ারে বসে থাকা স্বজনদের চিড়া-মুড়ি ও মুড়কি খেতে দিচ্ছেন।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের কয়া গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। এলাকার মানুষ তাকে নাসির স্যার বলে ডাকে। ৭৪ বছর বয়সেও তিনি শিশুমনা। সেজন্য সাদা মনের বা আলোকিত মানুষ হিসেবে তার চিন্তা-ভাবনা ও কাজের কথা এলাকার মানুষের মুখে মুখে। যেন অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছেন তিনি। বিলুপ্তপ্রায় গাছ, প্রাচীন নিদর্শন ও গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থাপনার নানা উপকরণ সংরক্ষণ এবং শিশুদের শৈশবটা যেন আনন্দ মুখর হয়, তারা যাতে আলোকিত ও প্রকৃতিপ্রেমী এবং মানুষের মত মানুষ হয় সেই লক্ষ্যে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন নাসির উদ্দিন। তবে এতদিনেও তেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারেননি তিনি। পাননি সরকারি কোনো বরাদ্দ। তবুও যেন অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছেন তিনি।

উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কয়া গ্রাম। যার একপাশে গড়াই এবং অপর পাশে পদ্মা নদী। এই গ্রামেই মামাবাড়িতে বিপ্লবী বাঘা যতীনের শৈশব কেটেছে। নাসির উদ্দিনের বাড়িটাও একই গ্রামে। ২০০৫ সালে পেনশনের টাকায় শিশুদের বিনোদন ও মেধা বিকাশের জন্য বাড়ির আঙিনায় বাবা-মায়ের নামে কুলসুম নেছা-জালাল গান্ধী শিশুপার্ক গড়ে তোলেন তিনি। সেখানেই প্রতি শুক্রবার এলেই শিশু নিকেতনে পরিণত হয় তার বাগান।

বিলুপ্তপ্রায় গাছ, প্রাচীন নিদর্শন ও গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থাপনার নানা উপকরণ সংরক্ষণ এবং শিশুদের শৈশবটা যেন আনন্দ মুখর হয়, তারা যাতে আলোকিত ও প্রকৃতিপ্রেমী এবং মানুষের মত মানুষ হয়। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন নাসির উদ্দিন। তবে এতদিনেও তেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারেননি তিনি। পাননি সরকারি কোনো বরাদ্দ। তবুও যেন অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছেন তিনি।

আলোকিত নাসির উদ্দিন: কুমারখালীর কয়া গ্রামে ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন নাসির উদ্দিন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নিজ গ্রামে শিক্ষার আলোর অভাব অনুভব করেন। ১৯৬৬ সালে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন কয়া নৈশ বিদ্যালয়। বিভিন্ন বয়সের অনেক নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন তাঁরা। দীর্ঘ ১০ বছর স্কুলটি পরিচালনা করেন। খেলাধুলার প্রতিও তার গভীর অনুরাগ। ১৯৭২ সালে তিনি নিজ গ্রামে ভলিবল দল গঠন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৭ সালে অবসরে যান। তার দুই ছেলে বেসরকারি চাকুরীজীবী। এক মেয়ে বিবাহিতা। স্ত্রী মরিয়ম বেগম গৃহিণী।

শুক্রবার আসলেই যেন শিশুরাজ্যে পরিণীত হয় বাগান। শিশুদের জন্য গড়তে চাই আত্মভোলা স্বর্গরাজ্য। মুখভরা হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন নাসির উদ্দিন। তিনি জানান, ৩৩ শতাংশ জমির ওপর বাগানসহ তার বসতভিটা। ২০০৫ সালে অবসরের টাকা দিয়ে বাগানের ভেতরে গড়ে তুলেছেন কুলসুম নেছা-জালাল গান্ধী শিশুপার্ক। সেখানে শিশুদের জন্য বিনোদন ও শরীর চর্চা কেন্দ্র, পাঠাগার, জাদুঘর, সংবাদ সংগ্রহশালা রয়েছে। আশপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী শিশুরা আসে। তারা বই পড়ে, খেলা করে, বিলুপ্তপ্রায় হরেক প্রজাতির গাছের সঙ্গে পরিচিত হয়। জাদুঘরে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র দেখে গ্রামীণ জীবন-যাপন অনুভব করে। তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের তার বাগানে আসতে বলেন। বই পড়তে উৎসাহিত করেন। পাঠাগার গড়ে তুলতে স্থানীয় শিক্ষিত মানুষকে উৎসাহ দেন তিনি।

গাছের প্রতি ভালোবাসা: প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি বিলুপ্তপ্রায় গাছ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিজ উদ্যোগে বাড়ির আঙিনায় গড়ে তোলেন বাগান। বাগানটিতে প্রায় ২০০ প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছে কাগজ লেমিনেটিং করে নাম লেখা আছে, যাতে শিশুরা পড়ে চিনতে পারে। উল্লেখযোগ্য হলো বনকাঁঠাল, লাটা, ঢেপড়, ফলশাহী, মিষ্টি আমলকী, করমচা, জামরুল, হরগৌড়ি ইত্যাদি।

নাসির উদ্দিন বলেন, “গ্রাম থেকে হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্তপ্রায় ফলজ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনের গাছগুলো সংরক্ষণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বাগানে বেশির ভাগই ঔষধি গাছ। সেগুলো সেবামূলক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার যখন খুশি ইচ্ছেমত নিয়ে যাচ্ছেন।”

কুলসুম নেছা পাঠাগার, জাদুঘর ও সংবাদ সংগ্রহশালা: বাগানের ঠিক মাঝখানে একটি ছোট্ট আধাপাকা ঘরে মায়ের নামে একটি পাঠাগার, জাদুঘর ও সংবাদ সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন নাসির উদ্দিন। পাঠাগারে শিশুদের মেধা বিকাশ, শরীর গঠন বিষয়কসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক বই রয়েছে। দেওয়ালে ‘পড়িলে বই আলোকিত হয়, না পড়িলে অন্ধকারে রয়’, ‘নিজে বই পড়ুন অন্যদের বই পড়তে উৎসাহ দিন’, ‘বেশি বেশি বই পড়ুন বেশি বেশি জানুন’ ইত্যাদি বাণী লেখা আছে। এই পাঠাগারের বই নিয়েই তিনি আশপাশের এলাকার বিভিন্ন স্কুলে যান।

জাদুঘরে সেন ও পাল বংশ এবং ব্রিটিশ আমলের ইট, থালা, তার নানী ও মায়ের ব্যবহৃত পানের বাটা, কাঁসার বদনা, বিলুপ্তপ্রায় হারিকেন, ঢেঁকি, পালকি, ডাক টিকেট, হুকা, লাঙল, মাতাল, ঢালসহ শতাধিক উপকরণাদি সংরক্ষণ করা রয়েছে। ওই ঘরের এক দিকে সংবাদ সংগ্রহশালা। সেখানে শিশুদের মেধা বিকাশ, স্বাস্থ্যবিধি ও নানা বয়সী শিশুদের লেখা এবং দেশ বিদেশের আবিষ্কারক বিষয়ক পত্রিকা ও পত্রিকার কাটিং রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে কথা হলে নাসির উদ্দিন জানান, তার নানী ও মায়ের ব্যবহৃত পানের বাটা, পান ছেঁচা ও চিনামাটির পুতুল থেকে তিনি জাদুঘর স্থাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিলুপ্তপ্রায় শতাধিক উপকরণ সংরক্ষণ করেছেন। এগুলো দেখে আজকের শিশুরা প্রাচীন ধারণা লাভ করতে পারে।

কয়া গ্রামের গৃহিণী প্রিয়াংকা দত্ত বলেন, “পয়লা বৈশাখ, নবান্ন উৎসবসহ নাসির উদ্দিন শিশু কিশোরদের নিয়ে শহীদ দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন করেন। গাছে ফল পাকলে শিশুদের নিয়ে উৎসব হয় বাগানে। আনন্দ করে ফল খায় শিশুরা। পাখিদের গাছে কিছু ফল রাখা হয়। শিশুদের মেধা বিকাশে তার উদ্যোগগুলো খুবই ভাল।”

বাগান জুড়ে বাণী: বাগানের ভেতরে প্রতিটি গাছের সঙ্গে টাঙানো মনীষীদের বাণী। ‘সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গড়ে তুলুন’, ‘সহজ পথে খ্যাতি বা সফলতা আসবে না, চাই বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা, ‘না বুঝে মুখস্থ করার অভ্যাস প্রতিভাকে ধ্বংস করে’, ‘গাইড বই কখনো মূল বইয়ের বিকল্প হতে পারে না’, ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করুন’ ‘মাদককে না বলুন, ‘গাছ লাগায় পরিবেশ বাঁচান’ ইত্যাদি। এগুলো শিশুদের পড়ানো হয়। শিশুদের এসব বাণীর মর্মকথা বুঝিয়ে বলেন তিনি।

কয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রাখী ঘোষ বলে, বিদ্যালয়ের ছুটির দিন সে বাগানে এসে নানা ধরনের বই পড়ে। দোলনায় খেলা করে। ছবি আঁকতে তার খুব ভালো লাগে। শুক্রবারের প্রতিযোগীতায় সে গ্রামের চিত্র এঁকেছে।

কয়া ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ইরিনা দত্ত বলে, নাসির স্যার বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও তার আচরণ শিশুদের মতো। যাদের গাছ, পাখি ও বই ভাল লাগে তারাই ছুটে আসে বাগানে। বাগানে অনেক কিছু শেখার আছে।

প্রাপ্তি-প্রয়োজন: ছোট্ট ঘরের দেওয়ালে পাঠাগার, জাদুঘর ও সংবাদপত্র সংগ্রহশালা লেখা থাকলেও নেই বসার চেয়ার টেবিল ও কক্ষ। তবুও পেনশনের টাকায় ১৯ বছর ধরে শিশুদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং বিলুপ্তপ্রায় গাছ, গ্রামীণ উপকরণ ও প্রাচীন নিদর্শন সংরক্ষণে আপন মনে কাজ করে চলেছেন নাসির উদ্দিন। গেল ১৯ বছরে মাত্র ৭০ হাজার টাকার সরকারি বরাদ্দ পেয়েছেন বলে জানান নাসির উদ্দিন। তিনি জানান, পেনশনের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে চান তিনি।

নাসির উদ্দিন আরো জানান, অসম্ভব হলেও পরিবারের সহযোগীতায় এতদূর আসতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কেউ আসলেই যেন আশ্চর্য হয়ে পড়েন, এমন একটি আত্মভোলা শিশুরাজ্য গড়ে তুলতে চান তিনি।

স্ত্রী মরিয়ম বেগম জানান, প্রথমদিকে না মানলেও স্বামীর খুশিতেই এখন তিনিও খুশি। সবসময় শিশুদের নিয়ে হেসে খেলে ভাল থাকেন স্বামী। তা দেখেই এখন সুখ পান তিনিও।

কুমারখালীর জিডি সামছুদ্দিন কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক কবি বিজয় কর বলেন, “শিল্প ও সাংস্কৃতিক মনা নাসির উদ্দিন  হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও গাছ সংরক্ষণে চেষ্টা করছেন। এগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।”

প্রায়ই বাগানে ছুটে আসেন সাংবাদিক এম এ ওহাব। তিনি বলেন, “নাসির উদ্দিন একজন সাদা মনের মানুষ। শিশুদের নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি কয়া গ্রামে মৃত পুরুষদের গোসল করাতে ছুটে যান তিনি।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, “দেশ ও জাতির কল্যাণে নাসির উদ্দিনের মতো আলোকিত মানুষের সংখ্যা আরো বেশি প্রয়োজন।”

এসময় তিনি আরো বলেন, “সরকারিভাবে বরাদ্দ পেলে প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”