বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। প্রায় ২০টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বেড়েছে বেশির ভাগ নদনদীর পানি। এতে প্লাবিত হয়েছে কয়েকশ গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস বলছে দেশের প্রধান নদ নদীতে পানি বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। বরিবার সকালে দেয়া পূর্বাভাসে জানানো হয়, উত্তরাঞ্চলে বহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় আগামী ৭২ ঘণ্টায় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। পূর্বাঞ্চরলে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানিও আগামী ২৪ ঘন্টায় বাড়তে পারে।
ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমারসহ সব নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ১০৮ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার এবং পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমারের পানি বিপৎসীমার ১৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে কুড়িগ্রামের রাজারজাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের কালুয়ারচরে বাঁধ ভেঙে এক নারী ও এক শিশু নিখোঁজ হয়েছে।
কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী সড়ক তলিয়ে যাওয়ার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলাসহ সোনাহাট স্থলবন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থা।
তীব্র স্রোতে সদরের আরডিআরএস বাজারে ৩০ মিটার ও ফুলবাড়ী উপজেলার গোড়কমণ্ডলে ১৫ মিটার বাঁধ ভেঙে নতুন করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ সব এলাকার মানুষজন সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার পানি ওঠায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জেলার দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আগেই আভাস দেয়া হয়েছিল আগস্টে এক বড় বন্যা আসছে। সেই বন্যার পূর্বাভাস গত কয়েক দিন ধরেই শুরু হয়ে গেছে। ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে দেশের নিম্নাঞ্চল। তবে বন্যা শুরু হলেও এখনো সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণ তৎপরতা চোখে পড়েনি। এতে চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছেন বন্যার্তরা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে দেশের ১৪টি নদীর পানি বেড়েছে ১৭টি পয়েন্টে। গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৩৬ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে শেরপুরের ভুগাই নদীতে। এ ছাড়া ধরলা কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ৭৭ সেন্টিমিটার, তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার, যমুনেস্বরি বদরগঞ্জে ১৩২ সেন্টিমিটার, যমুনা বাহাদুরাবাদে ৬৩ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে ৪৭ সেন্টিমিটার, টাঙ্গন নদী ঠাকুরগাঁওয়ে ২৬১ সেন্টিমিটার, সুরমা কানাইঘাটে ৫১ সেন্টিমিটার, সুনামগঞ্জে ২৩ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা শেওলায় ১২ সেন্টিমিটার, সারিগোয়াইন সারিঘাট পয়েন্টে ৮৪ সেন্টিমিটার, মনু নদী মনু রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্ট ৩৬৮ সেন্টিমিটার, খোয়াই নদীর বাল্লায় ২২১ সেন্টিমিটার ও হবিগঞ্জে ৪৭০ সেন্টিমিটার, ধলাই কমলগঞ্জে ২৭৮ সেন্টিমিটার, ভোগাই নদী নাকোয়াগাও ৩২০ সেন্টিমিটার, সোমেশ্বরী দুর্গাপুরে ১০০, কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে ১০৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে।
অন্যান্য জেলা থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
সুনামগঞ্জ
প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নদ-নদী ও হাওরে পানি বাড়ছে। নতুন করে জেলার দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ সদর, দিরাই, ধর্মপাশা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন গ্রামের মানুষজন।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে দেশের ১৪টি নদীর পানি বেড়েছে ১৭টি পয়েন্টে। গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৩৬ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে শেরপুরের ভুগাই নদীতে। এ ছাড়া ধরলা কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ৭৭ সেন্টিমিটার, তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার, যমুনেস্বরি বদরগঞ্জে ১৩২ সেন্টিমিটার, যমুনা বাহাদুরাবাদে ৬৩ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে ৪৭ সেন্টিমিটার, টাঙ্গন নদী ঠাকুরগাঁওয়ে ২৬১ সেন্টিমিটার, সুরমা কানাইঘাটে ৫১ সেন্টিমিটার, সুনামগঞ্জে ২৩ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা শেওলায় ১২ সেন্টিমিটার, সারিগোয়াইন সারিঘাট পয়েন্টে ৮৪ সেন্টিমিটার, মনু নদী মনু রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্ট ৩৬৮ সেন্টিমিটার, খোয়াই নদীর বাল্লায় ২২১ সেন্টিমিটার ও হবিগঞ্জে ৪৭০ সেন্টিমিটার, ধলাই কমলগঞ্জে ২৭৮ সেন্টিমিটার, ভোগাই নদী নাকোয়াগাও ৩২০ সেন্টিমিটার, সোমেশ্বরী দুর্গাপুরে ১০০, কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে ১০৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে।
নীলফামারী
ভারী বর্ষণে উজানের ঢলে তিস্তা নদী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। রবিবার সকাল ৯টায় নীলফামারীর ডিমলার ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ পূর্বাভাস কেন্দ্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
ভারী বর্ষণে উজানের ঢলে তিস্তা নদী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। রবিবার সকাল ৯টায় নীলফামারীর ডিমলার ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ পূর্বাভাস কেন্দ্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তিস্তায় ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
পানি বৃদ্ধির কারণে নীলফামারী জেলা প্রশাসনের নির্দেশে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার তিস্তা অববাহিকার গ্রাম ও চর এলাকায় মাইকিং ও ঢোল সহরত করে মানুজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালেদ রহীম জানান, প্রশাসনের সবস্তরের সরকারি কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বন্যার দুর্গত মানুষের জন্য ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ১০টি মেডিকেল টিম ও একটি অতিরিক্ত হাসপাতালের মেডিকেল টিম কাজ করছে।
নেত্রকোনা
হাওর ও পাহাড় অধ্যুষিত নেত্রকোনায় তিন নদীর পানি আরও বেড়েছে। এতে চার নদীর পানিই বিপদসীমা ছাড়ানোয় জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড রবিবার সকাল নয়টায় পানি পরিমাপ করে দেখেছে পাহাড়ি এলাকায় সোমেশ্বরীর পানি কিছুটা কমলেও বেড়েছে কংস, উব্দাখালি ও ধনু নদীর পানি। তবে সোমেশ্বরী এখনও বিপদসীমার ওপরে বইছে।
বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তাহের জানান, জেলার হাওরাঞ্চলের নদী ধনুর পানি নতুন করে বেড়ে বিপদসীমা পেরিয়েছে।
দুর্গাপুর পয়েন্টে পাহাড়ি সোমেশ্বরী আজ সকালেও বিপদসীমার সতি সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। তবে আগের চেয়ে পানি কিছুটা কমায় নদীর আশপাশ প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নেমেছে।
রাঙামাটি
ভারী বৃষ্টির কারণে কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসার কারণে হ্রদের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে গত শনিবার ডুবে যায় রাঙামাটির জুলন্ত সেতু।
ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার বাঘাইছড়ি লংগদু উপজেলায় বন্যাকবলিত নিম্ন এলাকা এখনো পানির নিচে আছে। বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে বন্যা দুর্গতরা।
গত শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে টানা বৃষ্টিপাত হওয়ায় রাঙামাটির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি নিচু এলাকায় বন্যার সৃষ্টির হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে নষ্ট হয়ে গেছে আউস ও আমন ফসলের।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রর ব্যবস্থাপক শফি উদ্দিন আহমেদ জানান, হ্রদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধের ১৬ দরজায় পানি ছাড়া হচ্ছে।
গাইবান্ধা
গত চার দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গাইবান্ধার সবকটি নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৫৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং ঘাঘট নদীর পানি ৫৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ০৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া তিস্তা নদীতে পানি ৫২ সেন্টিমিটার ও করতোয়া নদীতে ৮৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ফলে জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
যশোর
টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে যশোরের তিন উপজেলায় বন্যাপরবর্তী জলাবদ্ধতার আরও অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন মনিরামপুর, অভয়নগর ও কেশবপুরের দেড় লক্ষাধিক মানুষ।
বিশেষ করে হালসা, শ্যামকুড়, মশ্মিমনগর, নেহালপুর, ভোজগাতীসহ অন্তত ৯০টি গ্রাম বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
ময়মনসিংহ
ভারতীয় সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় নিতাই নদীর বাঁধ ভেঙে প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার রাতে প্রবল পাহাড়ি স্রোতে দুটি জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের ভেতর পানি ঢুকছে।
শনিবার বিকাল পর্যন্ত চারটি ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। উপজেলার কালিকাবাড়ী গোদারাঘাট সংলগ্ন নিতাই নদীর উত্তর পাড় ভেঙে প্রবল স্রোতে দোকানপাট ও বাড়িঘর ভাঙনের মুখে পড়েছে।
দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক জানান, দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের কালিকাবাড়ী এজাহারের বাড়ির কাছে প্রায় ১০০ ফুট নদীর পাড় ভেঙে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করে কালিকাবাড়ী, নয়াপাড়া, জাঙ্গালিয়াপাড়া, দুধকুড়া, ভলল্বপুর, খাগগড়া ও সোহাগীপাড়া গ্রামসহ ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বহু মানুষ উঁচু রাস্তায় মালামাল, গবাদি পশুসহ আশ্রয় নিলেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। একের পর এক তলিয়ে যাচ্ছে উঁচু রাস্তাগুলো। পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে।